ছোটবেলায় শুনেছি, কোথায় নাকি একটি জায়গা আছে, যেখান দিয়ে কোনও জাহাজ বা উড়োজাহাজ গেলে তা হারিয়ে যায়; তার খবরই নাকি আর পাওয়া যায় না। জাহাজ-উড়োজাহাজগুলো কোথায় যায়, কীভাবে যায় তা কেউ বলতে পারে না। শুনে খুব অবাক হতাম। আবার কখনও মনে হতো, সব মিথ্যা, বানোয়াট। কাউকে প্রশ্ন করে মনমতো কোনও উত্তর পেতাম না, একেকজন এক এক রকম উত্তর দিতো। অনেকে আবার কিছু না জেনেই গুল মারতো। বড় হয়ে জানলাম, সেই রহস্যঘেরা জায়গাটির নাম বার্মুডা ট্রায়েঙ্গল। যদিও এ নামের কোনও জায়গা মানচিত্রে নেই। মুখে মুখে ও লেখালেখির মাধ্যমে এ জায়গাটি এ নামেই বিশ্বখ্যাত হয়ে যায়। বার্মুডা দ্বীপ, ফ্লোরিডার মায়ামি ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপ পার্তো রিকো- এই ৩টি বিন্দুকে সরলরেখা দিয়ে যোগ করলে একটি ত্রিকোণ তৈরি হয়, এই ৩ কোণবিশিষ্ট অঞ্চলটিই বার্মুডা ট্রায়েঙ্গল । অবশ্য কয়েকজন বার্মুডা ট্রায়েঙ্গলের অবস্থান সম্পর্কে ভিন্ন মত প্রকাশ করেন।

তবে মতপার্থক্যটা খুব বেশি না। এই অঞ্চলটির আরেক নাম, শয়তানের ত্রিকোণ। ট্রায়েঙ্গলের কোণগুলিই শুধু স্থল, বাকি পুরোটাই সমুদ্রভাগ। ইউরোপ, আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপের বন্দরগুলোতে যেতে-আসতে প্রতিদিন শত শত জাহাজকে বার্মুডা ট্রাইঅ্যাঙ্গেল পাড়ি দিতে হয়। বার্মুডা ট্রায়েঙ্গল নিয়ে এতো কথা হওয়ার কারণ, বার্মুডা ট্রায়েঙ্গল ও তার আশপাশ থেকে ১৪৯২ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জাহাজ-উড়োজাহাজ-নৌকাসহ কমবেশি ১শ ৭০টি স্থল ও জলযান নিখোঁজ হয়েছে! নিখোঁজ হওয়ার অনেকগুলো ঘটনাই রহস্যজনক ও অমীমাংসিত । বার্মুডা ট্রায়েঙ্গলচর্চার শুরু ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৫০ থেকে। ওইদিন এসোসিয়েটেট প্রেস-এ প্রকাশিত ইভিডব্লিউ জোন্সের একটি লেখা আর্টিক্যাল মানুষের দৃষ্টি প্রথম বার্মুডা ট্রায়েঙ্গলের দিকে ফেরায়। এর দুবছর পর একই বিষয়ে ফেইট ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় জর্জ এক্স স্যান্ডের একটি সংক্ষিপ্ত লেখা। স্যান্ড তার লেখায় উল্লেখ করেন, অনেকগুলো জাহাজ ও উড়োজাহাজ বার্মুডা ট্রায়েঙ্গল থেকে উধাও হয়ে গেছে। উড়োজাহাজের মধ্যে আছে, আমেরিকান নৌবাহিনীর ৫টি উড়োজাহাজ। ফ্লাইট-১৯ নামের এই বিমান দলটি নিখোঁজ হয়েছিল ১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর।

লেখক স্যান্ডই প্রথম বার্মুডা ট্রায়েঙ্গলে অঞ্চল নির্দিষ্ট করেন। আমেরিকান লিজিয়ন (১৯৬২ সালের এপ্রিল সংখ্যা) পত্রিকা দাবি করে, সেই বিমান দলটির প্রধান নিখোঁজ হওয়ার কয়েক মুহূর্ত আগে বেতারের মাধ্যমে জানায়, ‘আমরা সাদা পানির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি, ভালো ভাবে কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমরা কোথায় আছি তা বুঝা যাচ্ছে না, পানি সাদা না, সবুজ…।’ এই তথ্য প্রকাশের মধ্য দিয়েই বার্মুডা ট্রায়েঙ্গলের ললাটে অলৌকিকতার টিকা লেগে যায়। এ সম্বন্ধে মানুষের আগ্রহ তীব্রতর হয়, দিনের পর দিন পত্র-পত্রিকাগুলো এ বিষয়ে সত্য-মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করতে থাকে, লেখা হতে থাকে অসংখ্য বই।

এ নিয়ে কল্পনাবাসী লেখকরা বিচিত্রসব কল্পকাহিনী তৈরি করেন। অনেকে মনে করেন, নিখোঁজ হওয়া ঘটনার পেছনে এলিয়েনদের হাত আছে। বার্মুডা ট্রায়েঙ্গলে অলৌকিকতার রঙ আরোপে লেখক ভিন্সেন্ট গ্যাডাইস প্রথম (১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে) ভূমিকা পালন করেন। লেখক চালর্স বার্লিৎজও ঘটনাগুলোর সাথে অতিপ্রাকৃত শক্তি যুক্ত করে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান, তার বইয়ের নাম The Bermuda Triangle (১৯৭৪)।

যাইহোক, নিখোঁজ সংবাদগুলো কিন্তু গুজব ছিল না। জল-স্থল-আকাশযান নিখোঁজ হচ্ছিল ঠিকই। কীভাবে নিখোঁজ হচ্ছিল তা নিয়েই আলোচনা, জল্পনা-কল্পনা, গবেষণা ও মতবিরোধ। অ্যারিজোনা স্ট্যাট ইউনিভার্সিটির গবেষক লরেন্স ডেভিড কুশের The Bermuda Triangle Mystery : Solved ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে বার্মুডা ট্রায়েঙ্গলের সাথে কোনও প্রকার অতিপ্রাকৃত শক্তির জড়িত থাকার বিষয়টিকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। বার্মুডা ট্রাইঅ্যাঙ্গেল থেকে যানবাহন হারিয়ে যাওয়ার বিভিন্ন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, সাক্ষী ও লেখকের কথা কুশে অনেক অসঙ্গতি দেখতে পান। তিনি সেগুলো যুক্তি দিয়ে খন্ডনও করেন ।

যেমন, তিনি লক্ষ্য করেছেন, রহস্যজনক নিখোঁজ ঘটনা সবাই বর্ণনা করলেও, নিখোঁজ হওয়ার দিন বার্মুডা ট্রায়েঙ্গলের আবহাওয়া যে বেশিরভাগ সময়ই ভীষণ প্রতিকূল ছিল তা কেউ কোথাও উল্লেখ করেনি। কুশে অনেকগুলো বিষয় প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন, যেমন- সবগুলো ঘটনা বার্মুডা ট্রাইঅ্যাঙ্গেলে সংঘঠিত হয়নি, বার্মুডা ট্রায়েঙ্গল ঝড়প্রবণ এলাকা যা কেউ বলেনি, হারিয়ে যাওয়ার সংবাদ প্রচার করা হয় কিন্তু যে যানগুলো ফিরে এসেছিল তা প্রকাশ করা হয়নি, অনেকগুলো নিখোঁজ সংবাদ মনগড়া, লেখার খোরাক যোগাতে সাংবাদিক ও লেখকরা উদ্দেশ্যমূলক ভাবে বার্মুডা ট্রায়েঙ্গলক ইস্যু বানিয়েছে ইত্যাদি। কুশের মতো পরবর্তীতে আরও অনেক গবেষক বার্মুডা ট্রায়েঙ্গলকে নিছকই একটি বাস্তবতাবর্জিত মিথ বলে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন; আর্নেস্ট ট্যাভ্স্ ও ব্যারি সিঙ্গার তাদের মধ্যে অন্যতম। ট্রাইঅ্যাঙ্গেলের ভিতরের একটি শহরের নাম ফ্রিপোর্ট।

গবেষকদের প্রশ্ন, বার্মুডা ট্রায়েঙ্গলের পেছনে যদি অতিপ্রাকৃত শক্তির হাত থাকতো তা হলে বছরে প্রায় ১০ লাখ পর্যটক কীভাবে এই শহরে বেড়াতে আসে? কীভাবে এ শহরে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিপইয়ার্ড ও এয়ারপোর্ট থাকতে পারে? এবং কীভাবেইবা সেই এয়ারপোর্টে বছরে ৫০ হাজার বিমান নির্বিঘ্নে ওঠানামা করে? তাদের উত্তর, প্রকৃতির প্রতিকূল অবস্থানই দুর্ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী এবং সেগুলো কাকতালীয় ও ধারাবাহিকতাহীন।

বার্মুডা ট্রায়েঙ্গলে ঘটে যাওয়া কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্ঘটনা :

১৮৪৩, ইউএসএস-গ্রাম্পাস জাহাজ উধাও হয়।
১৯১৮, ইউএসএস-সাইক্লপ্স জাহাজ ৩শ ৯জনসহ চিরতরে হারিয়ে যায়।
১৯২৫, ডিসেম্বর। এসএস কোটোপাক্সি স্টিমার ৩০ জনের বেশি মানুষ নিয়ে নিখোঁজ হয়।
১৯৪৫, ৫ ডিসেম্বর। ফ্লাইট-১৯ বিমান দল ১৪জনকে নিয়ে উধাও হয়, একদিন পর বিমান দলটিকে খুঁজতে গিয়ে পিবিএম মেরিনার বিমান ১৩জনকে নিয়ে নিজেই নিখোঁজ হয়।
১৯৪৮, ৩০ জানুয়ারি। আভ্রো টুডর জি-এএইচএনপি স্টার টাইগার বিমান ৩১জনকে নিয়ে নিখোঁজ হয়।
১৯৪৮, ২৮ ডিসেম্বর। ডগলাস ডিসি-৩ এনসি১৬০০২ বিমান ৩২জনকে নিয়ে হারিয়ে যায়।
১৯৪৯, ১৭ জানুয়ারি। আভ্রো টুডর জি-এজিআরই স্টার এরিয়েল ২০জনকে নিয়ে নিখোঁজ।
১৯৬৭, ২২ ডিসেম্বর। বিখ্যাত উইচক্রাফ্ট জাহাজ গুম হয়।

এছাড়াও ট্রায়েঙ্গলের বাইরে থেকেও অনেক যান নিখোঁজ হয় এবং নিখোঁজ হওয়ার পর ফিরে পাওয়া যায় বেশকয়েটিকে।

ছবির ক্যাপশন :
০১ বার্মুডা ট্রায়েঙ্গলের মানচিত্র
০২ শিল্পীর আঁকা কল্পিত বার্মুডা ট্রায়েঙ্গল

লিখেছেন : সুদীপ্ত সালাম