১৮৮৫ সালে নরসিংদীর শিবপুরের আশ্রাফপুর গ্রামে দুটি তাম্রশাসন ও একটি ব্রোঞ্জচৈত্য পাওয়া যায়। এর রহস্য উদ্ঘাটিত হয় ১৯০৫ সালে। একই সালে তাম্রশাসনের পাঠোদ্ধারও হয়।তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, রাজা দেব খড়ক ছিলেন খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকের সমতটের শাসক। ওই সময় মধুপুর গড় অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটে। রাজা দেব খড়ক এই অঞ্চলে চারটি বিহার ও বিহারিকা নির্মাণের জন্য ভূমি দান করেছিলেন। উৎ খননের আগ পর্যন্ত বিহার ও বিহারিকাগুলো অজানা ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, রাজা দেব খড়কের তাম্রশাসনে নির্মিত হয়েছিল বিহার ও বৌদ্ধ পদ্মমন্দির।

আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন দুর্গনগর হিসেবে আলোচিত নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বরে দশম ধাপের খননে ওই সব বিহার ও বিহারিকা এবং বৌদ্ধ পদ্মমন্দিরের গর্ভগৃহের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়, যা খননকাজে নতুন মাত্রা যোগ করে।খনন দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, উয়ারী-বটেশ্বরে দশম ধাপের খননকাজ শেষ হয় ২৫ জুন। এই খননে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষ করে শিবপুরের জানখারটেক থেকে আবিষ্কৃত ইটের স্থাপত্য ও ধুপিরটেকে বৌদ্ধ পদ্মমন্দিরের গর্ভগৃহ উল্লেখযোগ্য।

আবিষ্কৃত ইটের স্থাপনা এই অঞ্চলে রাজা দেব খড়কের শাসনপরিধি বিস্তারের সাক্ষ্য বহন করে। স্থাপত্যিক কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করে, এটি বিহার ও বিহারিকা মন্দিরের মাঝখানে থাকে প্রতিমা। মন্দিরের এই স্থানকে বলা হয় গর্ভগৃহ। দশম ধাপের খননে আবিষ্কৃত গর্ভগৃহটির আয়তন চার বর্গমিটার। সব মন্দিরে গর্ভগৃহ থাকে না। ফলে ওই মন্দিরে যে উপাসনা হতো, তা নিশ্চিত হওয়া যায়

মন্দিরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে ইট বিছানো একটি বেদী রয়েছে। মন্দিরে আটটি পাপড়িযুক্ত একটি পদ্ম অনেকটা অক্ষত রয়েছে। পদ্মের উপস্থিতি মন্দিরটিকে পদ্মমন্দির বা লোটাস টেম্পলের মর্যাদা দেয়। বৌদ্ধ ধর্মে পদ্ম খুবই তাৎ পর্যপূর্ণ এবং বহুল ব্যবহূত। বৌদ্ধ ধর্মের আটটি শুভলক্ষণ প্রতীকের মধ্যে পদ্ম একটি। প্রায় অক্ষত পদ্মটিতে আটটি পাপড়ি রয়েছে। ধারণা করা হয়, আটটি পাপড়ি বৌদ্ধ ধর্মের অষ্টমার্গের প্রতীক। সৎ বাক্য, সৎ চিন্তা, সৎ কর্ম, সৎ জীবন, সৎ সংকল্প, সৎ চেষ্টা, সম্যক দৃষ্টি ও সম্যক সমাধিকে অষ্টমার্গ বলা হয়।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দুর্গ এলাকাগুলোতে খনন দলের কেউ নেই। কারণ দশম ধাপের খননকাজ শেষ হয়ে গেছে। টানা বর্ষণের কারণে দর্শনার্থীর সংখ্যাও কম। প্রতিটি দুর্গ এলাকা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।খননকাজের উপপ্রধান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রভাষক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বৌদ্ধ মন্দিরে সাদা, লাল, গোলাপিসহ চার ধরনের পদ্ম ফুল থাকে। এগুলো ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। দশম ধাপের খননে আবিষ্কৃত পদ্মটি লাল। সংস্কৃত ভাষায় একে কমল বলা হয়। এই পদ্ম প্রতীকী অর্থে প্রেম, সহানুভূতি ও আকাঙ্ক্ষার।

খননকাজের পরিচালক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মুস্তাফিজুর রহমান  বলেন, উয়ারী-বটেশ্বর প্রাচীন নগর ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র। বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্ন নিদর্শনের অপার সম্ভাবনাময় স্থান। প্রয়োজন শুধু খনন করে তা বের করে আনা। একই সঙ্গে গবেষণা ও সংরক্ষণ জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা জানি, প্রত্নতাত্ত্বিক খনন একটি জটিল, সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল কাজ। এরই মধ্যে ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাতব ও বস্তুবিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর, স্থাপত্য বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র উয়ারী-বটেশ্বরে গবেষণায় অংশ নিয়েছে। কাজ এগিয়ে নিতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন।

১৯৩০ সালে স্থানীয় স্কুলশিক্ষক হানিফ পাঠান প্রথমে উয়ারী-বটেশ্বর সুধী সমাজের নজরে আনেন। পরে তাঁর ছেলে হাবিবুল্লা পাঠান স্থানটির গুরুত্ব তুলে ধরে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। ২০০০ সালে বঙ্গীয় শিল্পকলা চর্চার আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের আর্থিক সহায়তায় খননকাজ শুরু হয়। গত কয়েক বছরের খননকাজে বের হয়ে আসে আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন নগরের সমসাময়িক মানববসতির বিস্তৃত (দৈঘ্য ও প্রস্থে ৬০০ মিটার করে) দুর্গ এলাকা, ইটের স্থাপত্য, প্রশস্ত রাস্তা, পার্শ্বরাস্তা, দুর্গপ্রাচীর, পরিখা, অসম রাজার গড়, লৌহনির্মিত হস্তকুঠার, বল্লম, পোড়া মাটির নিক্ষেপাস্ত্র, তাবিজ, ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা, উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎ পাত্র, কাচের পুুঁতি, বাটখারা, গর্তনিবাস, মুদ্রাভান্ডার, নবযুক্ত মৃৎ পাত্র, ধাতব চুড়ি বা তাম্র বলাই, পোড়া মাটির চাকতি ইত্যাদি আবিষ্কৃত হয়। সর্বশেষ খননে ধুপিরটেকে বৌদ্ধ পদ্মমন্দির ও ইটের স্থাপত্য বের হয়ে আসে।

-সুমন মোল্লা