মোগলদের আবির্ভাবের সাথে সাথেভারত উপমহাদেশের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়েরসূচনা হয় ১৫২৬ খৃষ্টাব্দে পানিপথের যুদ্ধক্ষেত্রেবাবরের বিজয়ের ফলে ভারতে মোগল শাসনের বিজয়ের ফলে ভারতে মোগল শাসনের গোড়া পত্তনহয়। কিন্তু ১৫২৬ খৃষ্টাব্দের পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধপর্যন্ত ত্রিশ বছর কাল ভারতের ইতিহাস প্রধানতআফগান মোগল সংঘর্ষের ইতিহাস।

ভারতে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলায় তখনও মোগল শাসনের সূর্য উদয় হয়নি। তখনবাংলায় শেরশাহী বংশের অভ্যুদ্বয় ঘটে। এই বংশ ১৫৩৯ তেকে ১৫৬৪ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা শাসনকরে। শেরশাহী বংশের অবসানে বাংলায় কররানী বংশের অভ্যুদয় ঘটে। তারা ১৫৬৪ খৃষ্টাব্দ থেকে১৫৭৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা শাসন করে। অতঃপর মোগল সম্রাট আকবর ১৫৭৬ খৃষ্টাব্দে বাংলা জয়করেন।

মোগল শাসকরা বাংলা দখল করে বাংলা শাসন পরিচালনা করার জন্য তখন এক একজন সুবেদারবা শাসন কর্তা নিয়োগ করেন। ১৫৮৯ খৃষ্টাব্দে রাজা মানসিংহ বাংলার ষষ্ঠ সুবেদার হিসেবেশাসনভার গ্রহণ করেন। তার সময়ে রাজমহলে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার রাজধানী স্থাপিত হয়।মানসিংহের বাংলা শাসনভার গ্রহণ করার পূর্ব থেকেই বিহার ও উড়িষ্যার আফগান বিদ্রোহীরাবিভিন্নভাবে উৎপাত শুরু করে। সে সময়ে ধীরে ধীরে বাংলায় বিভিন্ন অংশে ভৌমিক বা ভূইয়াগণস্বাধীনতা লাভের চেষ্টা চালায়। ভারত বা প্রাচীন বাংলায় দীর্ঘকাল বিভিন্ন সভ্যতার শাসনামলেবিভিন্ন সংস্কৃতির ঐক্যসমন্বয়ে বাঙালী জনগোষ্ঠী একটি স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের জাতীয়তাবোধ অনুভবকরে। সেই জাতীয়তাবোধ থেকেই বাঙালী বার ভূইয়ারা মোগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেথাকে। এই প্রতিবাদের ইচ্ছা থেকেই সংস্কৃতির নৃতাত্ত্বিক চেতানায় তাদের রাষ্ট্রগঠনের ভিত্তির পরিচয়স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে এ সমুদয় ভৌমিকগণের অভহ্যদয় ঘটে এবং সেলিম বাজাহাঙ্গীর বাদশাহের শাসনামলে তারা পরাজিত হন।

পরবর্তীতে মোগল সম্রাট কর্তৃক নির্বাচিত শাসনকর্তারাই বাংলা শাসন করতে থাকেন। পলাশীর প্রন্তরেশাসন করতে থাকেন। পলাশীর প্রান্তরে বাংলা তখা ভারতের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হবার পূর্ব পর্যন্তএই ব্যবস্থাই অব্যাহত ছিল। মোগলদের শাসন ব্যবস্থা প্রধানতঃ আকবরেরই রচনা। এই সম্পর্কেএডওয়ার্ডস ও গ্যারেট মন্তব্য করেছেন ‘আধুনিক মোগল শ্রেষ্ঠ আকবরের শাসন প্রতিভার নিকটবাহ্যিকভাবে যতটা প্রতীয়মান হয় তার চেয়ে বেশি ঋণ।’ বাবর ও হুমায়ুন নব প্রতিষ্ঠিত সামাজ্যেরবহুবিধি সমস্যায় ব্যাস্ত ছিলেন বলে তাদের কেহই শাসন ব্যবস্থার দিকে মনোযোগ দিতে পারেনি।ভারতয়ি ও বৈদেশিক মাসন ব্যবস্থার সমন্বয়ে মোগল শাসন ব্যবস্থা রচিত হয়েছিল। মোগলঅধিপতিরা সম্ভবতঃ এশিয়ার বাসিন্দা। মোগল সভ্যতার বিজয় তোরণ যেমন ভারত তথা বাংলারজনসাধারণ স্মরণ করে তরুণ মেগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্রমপুর থেকে প্রতিবাদের ঝড়ও বাঙালীজাতি তার আত্ম বিকাশের প্রথম ভিত্তি হিসেবে শ্রদ্ধা জানায়।

মোগল সাম্রজ্যের শাসন আমলে বাংলাকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে তদ্রুপ সাম্রাজ্য বিস্তারের নামে মগ,ফিরিঙ্গী ও জলদস্যুরা বাংলার সম্পদ লুন্ঠন করেছে। বিক্রমপুর সেই লুন্ঠনের হাত থেকে রেহাইপায়নি। জলদস্যুরা তার হাজার বছররের শ্রমসিক্ত শিল্প-ভাস্কর্যের উপরও নগ্ন থাবা দিয়েছে।বিক্রমপুর মোগল সাম্রাজ্যের যেমন ইতিহাস সমহিসায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ঠিক বিপরীতভাবে বাংলারশেষ নবাব সিরজাদৌল্লার হত্যাকান্ডের সাথে রাজা রাজবল্লভের জড়িত থাকার ঘটনা বিক্রমপুরবাসীর আত্মসচেতনতার পথে কালিমা লেপন করেছে।

মোগল সাম্রাজ্যের শাসনামলে সম্রাট শাহজাহা বিক্রমপুরে এসে যেমন ধন্য হয়েছেন বিক্রমপুরবাসীওতার পদার্পণে গৌরববোধ করেছে। বাংলার মোগল সাম্রাজ্যের বিশাল শাসনামলের পটভূমিকারইতিহাস বিক্রমপুর চোখ নিবন্ধে দু’পূর্ব আলোচিত হবে। নতুন প্রজন্মদের এগিয়ে আসতে হবে।গৌরবদীপ্ত বাঙ্গালীর ইতিহাস নির্মাণে। মধ্যযুগের হীনমন্যতার চিন্তা পরিহার করে আমাদের ইলেকটোমাইক্রো আধুনিক সাম্রাজ্য ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

বিক্রমপুরের দুঃসহোদর চাঁদরায় কেদাররায় বাংলায় মোগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ষোড়শ শতাব্দীরশেষভাগে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সেই বিদ্রোহর দৃঢ়তাই বাঙ্গালীর আত্মচেতনার চির গৌরবময়ইতিহাস। সেই প্রতিবাদের অগ্নিস্ফহলিঙ্গ ভারত তথা প্রাচীন বাংলায় বাঙ্গালীর রাজনৈতিক চেতনাকেসমৃদ্ধ করেছিল। মধ্যযুগে সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থায় শাসকগোষ্ঠীর অভুদ্যয় হলেও দেশের স্বাধীনতারক্ষায় তারা ছিল আপোষহীন। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, ভহমি বন্দোবস্ত, শিল্প ব্যবসা ও ধর্মীয়অনুভহতির কারণে শ্রেণীগত বৈষম্য সৃষ্টি হলেও বাংলার স্বাধীনতা সূর্য রুখতে শ্রেনী সমন্বয়ের চিন্তাছিল এক ও অভিন্ন। শ্রেণী সমন্বয়ের এক ও একাধিক চিন্তা থেকে বাঙ্গালী অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেগণতান্ত্রিক দীর্ঘতম চর্চার পথই শোষক-শোষিতের চরিত্রে জাতীয়তার ভিত্তি রচিত হয়। তাই মোগলআগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলার রাজ, কৃষক ও মেহনতি জনতার সুসংগঠিত বিদ্রোহর বহিশিখাইআমাদের জাতীয় ইতিহাস।

১৫৭৬ সালে মেদিনীপুর ও বালেশ্বরের মধ্যবর্তী মোগলমারি স্থানে মোগল পাঠানের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধেদাউদ খান পরাজিত হলে বাংলায় পাঠান রবি অস্তমিত হয় এবং মোগল শাসন বাংলায় প্রতিষ্ঠিতহয়। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে আকবর শাহের শাসনামলে বাঙলায় ভৌমিক বা ভহইয়াদেরঅভহ্যদয় ঘটে। সেই বার ভহইয়ার প্রাদেশিক শাসন কর্তাদের উৎপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে সমগ্র বাংলায়বিদ্রোহ করে। বার ভহইয়াদের মধ্যে বমোহরের প্রতাপাদিত্য, খিজিরপুরের ঈশা খাঁ ও বিক্রমপুরেরঅন্তর্গত শ্রীপুরের কেদাররায় চাঁদরায় মোগলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বাংলার ইতিহাস। সম্রাট আকবর১৫৮০ খৃষ্টাব্দে রাজা টোডরমল্লকে বাংলার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। রাজা টোডরমল্ল সমগ্রবাংলাকে ১৯ সরকার ও ৬৮ টি পরগনায় বিভক্ত করেন। বিক্রমপুর সোনার গাঁয়ের একটি পরগণাহিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন মেঘনা নদীর পূর্ব তীরব্যাপী শীলহাটের দক্ষিণ ও ত্রিপুরারপশ্চিমসীমা পর্যন্ত সোনারগাঁও বিস্তৃত ছিল।

ঐতিহাসিকদের ধারণা, কেদাররায় চাঁদরায় আদি পুরুষ নিমরায় কর্ণাট থেকে এসে বিক্রমপুরস্থআড়ফুলবাড়িয়া নামক গ্রামে বসবাস করতেন। এই নিমরায়ের বংশেই দু’সহোদর বিপ্লবী জন্মগ্রহণকরেন। খিজিরপুরের ঈশা খাঁর সাথে এই রাজবংশের বন্ধুত্ব ছিল। সোনারগাঁয়ের ভুভাগ ষোষণাদিলেও চাঁদরায় কোদাররায় মোগলদের শাসন শৃংখল ছিন্ন করে বিক্রমপুরস্থ পদা তীরবর্তী শ্রীপুরস্বাধীন রাজা হিসেবে রাজ কাজ পরিচালনা ব্যাপ্ত থাকেন। ফলে বীরশ্রেষ্ঠ কেদাররায় তিন তিনবারমোগল বাহিনীর সাথে মাতৃভহমির স্বাধীনতা রক্ষার্থে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং বাঙ্গালীর শৌর্য-বীর্যইতিহাসে প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রথমবারের যুদ্ধে কেদাররায় মানসিংহের সেনাপতি মন্দারায়কে পরাজিত ও নিহত করেন। দ্বিতীয়বারমানসিংহ স্বয়ং বিক্রমপুরে সৈন্য নিয়ে উপস্থিত হন এবং কেদারের অদ্ভহত রণকৌশলে মুগ্ধ হয়েকেদাররায়কেই বিক্রমপুরের অধিপতি প্রতিষ্ঠিত করে চলে যান। অতঃপর কেদাররায় মোগল কর্তৃকসন্দ্বীপ পুনরুদ্ধারের জন্য কৃতসংকল্প হয়ে উঠেন। সন্দ্বীপের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাঙ্গালী, মগ ওফিরিঙ্গীদের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ হয় এবং সে যুদ্ধও বাঙ্গালীদের ইতিহাসকে বলিষ্ঠ করে তুলে।১৬২০ খৃষ্টাব্দে কেদাররায় কার্ভালিয়ন এবং মার্টিন নামক ফিরিঙ্গীর সহায়তায় নৌযুদ্ধে মোগলদেরপরাজিত করে সন্দ্বীপ উদ্ধার করেন এবং আরাকান রাজকে দু’বার পরাজিত করেন। কিন্তু পরিশেষেযুদ্ধে জয়লাভ করেও সন্দ্বীপ আরাকান রাজ্যের দখলে চলে যায়। এদিকে খিজিরপুরের ঈশা খাঁরসাথে কেদার রায়ের মতবিরোধ ঘটে। কথিত আছে ঈশা খাঁর শ্রীপুরে আতিথ্য গ্রহণের সময়কেদাররায় লাবণ্যবতী বিধবা যুবতী বোন সোনামণির রূপ দেখে বিমোহিত হয়ে পড়ে এবং তাকেপাবার প্রবল ইচ্ছা প্রকাশ করে। ঈশা খাঁ খিরিজপুরে পৌঁছে দূত মারফত কেদারের কাছে তারবোনকে বিয়ে কারার প্রস্তাব দেন। এতে কেদাররায় ঈশা খাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেখিজিরপুরে রওনা হয় এবং যুদ্ধে ঈশা খাঁর নগরী বিধ্বসত্ম করে কিন্তু কেদারের আমলা শ্রীমমত্মখাঁ কৌশলে সোনামনিকে খিজিরপুরে ঈশা খাঁর হাতে অর্পণ করেন। চাঁদরায় বোনের কথা শোনেশয্যাশায়ী হয়ে মারা যায়।

মহারাজা মানসিংহ বাংলায় এসে যশোরের প্রাতাপদিত্যের সাথে জামাতা চন্দ্রদীপের রাজা রামচন্দ্রের,রামচন্দ্রের সাথে ভুলুয়ার লক্ষণ মানিক্যের, বিক্রমপুরাধিপতি কেদারের সাথে খিজিরপুরের ঈশা খাঁরদ্বন্দ্ব বিরোধ অবহিত হন। এই দ্বন্দ্ব বিরোধের দুর্বলতা এবং বিশ্বাসঘাতক ভবানন্দ মজুমদার ওশ্রীমন্ত খাঁর সহায়তায় বার ভহইয়াদের স্বাধীনতা মোগলদের হাতে তুলে দিল। অপরদিকে বাংলারস্বাধীনতা রুখতে মানসিংহের সাথে বিসর্জন দেয় মধুরায়। কিন্তু দুই মহাপুরুষ স্বাধীনতা রুখতেমানসিংহের সাথে যুদ্ধের আহববান জানায়। তারা মানসিংহের আধিপত্য স্বীকারে অস্বীকৃতি জানায়।প্রতাপের স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পরেই পদ্মার তটস্থিত বিক্রমপুরের রাজধানী কেদার রায়েরপ্রিয়তম শ্রীপুর দুর্গ থেকে গৌরবের সাথে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়।

মেঘনার উপকূলে কেদারের সাথে মোগলের নৌযুদ্ধের পরাজয়ের সংবাদ পেয়ে মানসিংহ বিরাটসৈন্যবাহিনী বিক্রমপুরের শ্রীপুরে পাঠায়। ১৬০৬ সালে প্রতাপাধিত্যকে পরাজিত করেন। প্রতাপের পরেমুকুন্দরায়ের রাজধানী ভহষণা নগরী বিধ্বস্ত ও হস্তগত করে মোগল বাহিনী বিক্রমপুরে পৌছেঁ।মানসিংহ শ্রীপুরে সৈন্য শিবির স্থাপন করে কেদাররায়ের কাছে দূত মারফত তরবারি, শৃখল ও একটিচিঠি প্রেরণ করেন।

চিঠিতে লেখা ছিল …

‘‘ত্রিপুর মঘ বাঙ্গালী কাককুলী চাকালী, সকল পুরুষ মেতৎ ভাগি যাও পালায়ী, হয় গজ নর নৌকাকম্পিত বঙ্গভহমি
বিষম-সমর হিংহো মানসিংহং  প্রযাতি।’’

কেদার রায় মানসিংহের মনোভাব বুঝে তরবারিখানা গ্রহণ করেন এবং শৃখংল ফেরত দিয়ে দূতেরকাছে পত্রত্তোর লিখে পাঠান –

‘‘ভিনত্তি নিত্যং কবিরাজ কুম্ভং
বিভর্ত্তি বেগং পবনাতিরেকং।
করোতি বাসং গিরিরাজ শৃঙ্গে
তথাপি সিংহং পশুর নান্যঃ । ।’’

মানসিংহ কেদাররায়ের কাছ থেকে এই রকম পত্রের উত্তর পেয়ে তৎক্ষণাৎ শ্রীপুর নগরী অবরোধকরবার জন্য সৈন্য প্রেরণ করেন। সেই যুদ্ধে কেদাররায় ৫ শত রণতীর নিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।কেদাররায় একটানা নয়দিন যুদ্ধ করে মোগল বাহিনীর নিকট আহত ও বন্দী হন। অতঃপরমানসিংহের কাছে তার অবসন্ন রক্তাক্ত দেহ পৌছাঁনোর অব্যবহতি পরই বাঙ্গালীর কাংক্ষিত অগ্নিপুরুষ কেদাররায়ের মৃত্যু ঘটে। অবশেষে বাংলার স্বাধীনতা মোগল অধিপতিদের দখলে চলে যায়।

যুদ্ধ জয়ের পর মানসিংহ কেদাররায়ের গৃহ অধিপতি শিলামাতাকে জয়পুরে নিয়ে যান। সেইশিলামাতা অদ্যবধি জয়পুর রাজ্যের প্রাচীন অম্বর নগরী প্রতিষ্ঠিত আছে। মানসিংহ কেদাররায়ের এককন্যাকে বিয়ে করেন। বীরেন্দ্র মধুরায় এই যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন করেন। মধুরায়ের বীরত্বের জন্যমুকুটরায় নামে পরিচিত। বিক্রমপুরে আজও মধুমুকুটরায়ের স্মৃতিচিন্হ বিরাজমান। মুকুটরায়ের যেস্থানে নিজস্ব বাসভবন (রাজধানী) নির্মাণ করেন তা এখনও মুকুটপুর নামে খ্যাতি রায়।

চাঁদরায় কেদাররায়ের শাসনামলে বিক্রমপুরের বহু উন্নতি সাধিত হয়। তারা ‘দে’ উপাধিধারী বঙ্গক্তকায়স্থ ছিল। তারা কুলীন না হয়েও বিক্রমপুরে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত ছিল।রায় রাজাগণের সময় বহু ব্রাক্ষণ, বৈদ্য ও কুলীন কায়স্থ বিক্রমপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেথাকে। মালখানাগরের বসু পরিবার, শ্রীনগরের গুহ এবং কাঠালিয়ার দত্তগণ ঐ সময় এসে বসবায়করে।

বিক্রমপুরের দক্ষিণ পূর্বে চাঁদরায় কেদাররায়ের রাজধানী শ্রীপুর অবস্থিত ছিল। পরে পদ্মায় ভেঙেযায় এবং বাকী অংশ রাজাবাড়ী নামে পরিচয় লাভ করে। পরে রাজবাড়ীর মঠও তলিয়ে যায়।কেদাররায় বিক্রমপুর ও কার্তিকপুর এই উভয় পরগণার মধ্যস্থলে একটি বৃহৎ বাড়ী নির্মাণ করারজন্য ইট, সুরকী সংগ্রহ করেছিল। কিন্তু অট্টালিকার মূলভিত্তি স্থাপন করা হলেও উহার কাজ শেষকরে যেতে পারেনি। তখন থেকেই প্রজাসাধারণ ঐ স্থানকে কেদারপুর বা কেদারবাড়ী বলে পরিচয়দিত।

পূর্বে বিক্রমপুরের মধ্যদিয়ে কালীগঙ্গা নদীর স্রোত প্রবাহিত ছিল। তখ কালীগঙ্গা বিক্রমপুরেরনানাস্থানে নানা নামে অভিহিত হত। কোথাও কাথারিয়া কোথাও বা কালীগঙ্গা নামে ডাকা হত।এই কালী গঙ্গার তটদেশেই চাঁদরায় ও কেদারারায় ঐশ্বর্যশালী শ্রীপুর নগরী অবস্থিত ছিল। কোটীশ্বরনামক পল্লীতে তখন অসংখ্য সুন্দর সুন্দর দেবমন্দির শোভা পেত এবং সুউচ্চ সবুজ বৃক্ষ দাঁড়িয়েরাজকীয় অনুভহতির পরিচয় বহন করতো। এই কোটীশ্বর পল্লীতেই দশমহাবিদ্যা এবং সুবর্ণনির্মিতদশভুক্তা দুর্গা মূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। আজ আর সেই স্বর্ণময়ী শ্রীপুর নগরীর অসিত্মত্ব টিকে নেই।কেদাররায় ও চাঁদরায়ের অমরকীর্তি ধ্বংস করেই পদ্মা কালিগঙ্গা নামে পরিচয় লাভ করেছে। ভট্টকবিরা শত বছর আগেও পূজা পার্বণে গান করত

‘‘চাঁদ কেদাররায়ের কীর্ত্তি চমৎকার
ভেঙ্গে নিল কোটীশ্বর,
গোবিন্দ মঙ্গল, সোনার দেউল
খাকুটিয়ালি গ্রাম বহুতর।’’

বিক্রমপুরে কেদারায়ের ‘‘কাচকীর দরজা’’ জনসাধারণের কল্যাণে নির্মাণ করা হয়। ইদিলপুরেরবুড়ীর হাট থেকে আরাম্ভ করে এই রাস্তাটি বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ধলেশ্বরীর নদীর তট পর্যন্ত বিস্তৃত।রাজবাড়ীর এই মাইল উত্তরে প্রায় আধা মাইল দীর্ঘ ও পোয়ামাইল প্রশস্ত কেশার মার দীঘিঅবস্থিত। বিক্রমপুর অঞ্চলে কেশার মার দীঘি সম্পর্কে একটি জনশ্রুতি থেকে জানা যায় – রাজাকেদাররায় প্রজাসাধারণের কল্যাণে উক্ত দীঘি খননকালে পানি উথিত না হলে সবাই অবাক ওহতবিহবল হয়ে পড়েন। ঐ দিনই রাতে কেদার স্বপ্নে নির্দেশ পেলেন যে তার ধাত্রীমাতার গর্ভপ্রসূতপুত্র কেশা দীঘির মাঝপথ দিয়ে অশ্বারোহেণ করলে দীঘির চারদিক থেকে পানি ধারা বেরুতে থাকেফলে কেশা পানিতে ডুবে মারা যায়। কেশার মা পুত্রের শোচনীয় মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শোকবিহবলচিত্তে কেশা কেশা চিৎকার করে সেই দীঘির প্রবল ধারায় ঝাঁপিয়ে পড়ে মারা যায়। পুত্র ও মায়েরএই মর্মান্তিক আত্মবির্সজনের ঘটনায় প্রজাকুল বিস্মৃত হয়ে এই দীঘির নামকরণ করেন কেশার মারদীঘি।

কেদাররায়ের চাঁদরায়ের পরাজয়ের পর বিক্রমপুর মোগলদের দখলে চলে যায়। তখন থেকেইবিক্রমপুরে মগদস্যুদের বর্বরতা বেড়ে চলে।

লিখেছেনঃ গৌতম ব্যানার্জী , সুত্রঃ মুন্সিগঞ্জ নিউজ