নাসরুল আনোয়ার ও শফিক আদনান, কিশোরগঞ্জ থেকে : ‘হাওরের মানুষ’ আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর উচ্ছ্বাসের জোয়ারে ভাসছে কিশোরগঞ্জ। বিশেষ করে তাঁর নির্বাচনী এলাকা কিশোরগঞ্জ-৪ আসনভুক্ত ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামবাসী আনন্দে আত্মহারা। হাওরজুড়ে চলছে উল্লাস। সবার মনেই জোর আশাবাদ, ‘এবার অবহেলিত হাওরাঞ্চলের উন্নয়ন হবে।’ তবে উৎসবমুখরতা ছাপিয়ে হাওর অধ্যুষিত এসব এলাকার ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে চলছে আলোচনা। আবদুল হামিদ অর্ধশতাব্দীকাল ধরে সংসদে হাওরবাসীর প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সেই শূন্য স্থানটি কিভাবে পূরণ হবে? স্বাধীনতার পর চার দশকের বেশি সময়ে আবদুল হামিদের বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে না ওঠায় এ নিয়ে তৈরি হয়েছে এক ধরনের সংকটও।

কেবল হাওর নয়, দীর্ঘকাল তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগেরও নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে জেলার রাজনীতিও সংকটে পড়বে বলে অনেকে মনে করছেন। ১৯৭৮ সাল থেকে আবদুল হামিদ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ২০০৯ সালে স্পিকার হওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দিয়ে চলছে আওয়ামী লীগ। সাধারণ সম্পাদকের মৃত্যুর পর এ পদটিও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের হাতে। তবে আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি হওয়ায় জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি পুনর্গঠন এবং নতুন নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ এসেছে বলেও অনেকে আশাবাদ প্রকাশ করেছে।

হাওরের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম বাদে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে আবদুল হামিদের মানের কোনো নেতা বা নেতৃত্বও দীর্ঘ সময়ে গড়ে ওঠেনি। তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ায় তাঁর আসনটি অচিরেই শূন্য ঘোষণা করা হবে। কিছুদিনের মধ্যে সেখানে হবে উপনির্বাচনও। তাই পরবর্তী নির্বাচনে কে দলীয় প্রার্থী হচ্ছেন বা সম্ভাব্য প্রার্থীর তরী নিয়ে পারে ফেরা সম্ভব কি না_এসব নিয়ে চলছে পর্যালোচনা।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের কেউ কেউ বলছেন,

এখানে বিকল্প নেতৃত্ব গড়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা হয়নি। এ ক্ষেত্রে আবদুল হামিদ নিজেও কিছুটা উদাসীন ছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। তাই হাওরাঞ্চল বা কিশোরগঞ্জ জেলায় হয়তো বা তাঁর সমপর্যায়ের কোনো নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। নিকলীর প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও জিসি উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি কারার মো. গিয়াসউদ্দিন বলেন, ‘হামিদ সাহেব রাষ্ট্রপতি হওয়ায় হাওর এমনকি জেলার রাজনীতিও সংকটে পড়েছে। তিনি দীর্ঘকাল সফলভাবে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাই তাঁর বাইরে এত দিন আর বিকল্প নেতৃত্বের কথা ভাবা হয়নি।’

ইটনার বাসিন্দা এক সময়ের তুখোড় আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান ওই আসনে তাঁর নিজ দল থেকে কখনো মনোনয়ন পাননি। এ অভিমানে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ হয়ে বর্তমানে তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অবশ্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেলেও ফজলুর রহমানই পরবর্তী সময়ে আবদুল হামিদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হন। বেশ কয়েকটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন করে চূড়ান্ত বিজয়ের কাছাকাছি গিয়েও তিনি হেরে যান। সাধারণ মানুষের মনে ফজলুর রহমানের প্রত্যাবর্তন নিয়েও রয়েছে গুঞ্জন। অনেকের প্রশ্ন, তিনি কি আবার আওয়ামী লীগে ফিরছেন? কেউ কেউ বলছেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে নাকি কিছু নেই। তাই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে ফজলুর রহমানের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র এ সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে।

বিএনপির সূত্রের ভাষ্যমতে, উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে নিশ্চিত অংশ নেবে। বিএনপি নেতৃত্ব মনে করছে, দীর্ঘদিন পর হলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনটি বিএনপির দখলে যাচ্ছে। এখন সবার মূল ভাবনা, কে হচ্ছেন আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি! ওই এলাকায় আছেন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান। তিনি এখন জেলা পরিষদের প্রশাসক। মিঠামইন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুল আহসান শাহজাহানও পরীক্ষিত আওয়ামী লীগ নেতা। শোনা যাচ্ছে, আবদুল হামিদের ছেড়ে দেওয়া আসনে তাঁদের কেউ মনোনয়ন পাচ্ছেন না। রাষ্ট্রপতির পরিবারের কেউই মনোনয়ন পাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে আবদুল হামিদের বড় ছেলে প্রকৌশলী রেজওয়ান আহমেদ তৌফিকের নাম শোনা যাচ্ছে জোরেশোরে।

জেলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা বজলুর রহমান বলেন,

‘পীরের ছেলে পীর হবে, নেতার ছেলে নেতা, এটাই আমাদের রীতি।’ ইটনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন জানান, আবদুল হামিদের শূন্যস্থান পূরণ করতে পারতেন ইটনার নেতা শাহবুদ্দিন ঠাকুর। তিনি মারা যাওয়ায় সে সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, ‘এখন উত্তরাধিকারের যুগ। সম্ভবত হামিদ সাহেবের ছেলেই এ আসন থেকে লড়তে যাচ্ছেন।’

এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে ইটনা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম রতন জানান, আগামী নির্বাচনে বিএনপি আবদুল হামিদকেই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চেয়েছিল। তিনি রাষ্ট্রপতি হয়ে যাওয়ায় এ সুযোগটি আর নেই। তিনি দাবি করেন, তাঁদের প্রার্থী ফজলুর রহমান আবদুল হামিদের সঙ্গেই আগে হাড্ডাহাড্ডি লড়েছেন। তাঁর জায়গায় অন্য কেউ প্রার্থী হলে এ আসন যে বিএনপির দখলে যাবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

সুত্রঃ কালেরকন্ঠ