ঘাগড়া বাজারের জনসভা করেই আমাদের আন্দোলন থেমে যায়নি।এর মধ্যে বিদেশী বতার কেন্দ্রের সংবাদ সূত্রে দেশবাসী বঙ্গবন্ধুর ভাগ্য সম্পর্কে অবহিত করতে পেরেছে।সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর নেতা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখনে বন্দী অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে। আমি তখন দেখেছি, ভাটি এলাকার মতো অজপাড়াগাঁয়ের মূর্খ নরনারী গুলো থেকে শুরু করে কিশোর, যুবকসহ আবালবৃদ্ধ বণিতা স্বাধীনতার চেয়ে তখন বঙ্গবন্ধুর প্রয়োজনীয়তাই বেশী মনে করেছিল দেশের মানুষ।

বঙ্গবন্ধুর জীবিত থাকার সংবাদ জেনে একদিকে যেমন আশার আলো জ্বেলে ওঠেছিল তেমনি অন্যদিকে তাকে যেন হত্যা করতে না পারে সেজন্য জনগণ মহান প্রভুর দরবারে প্রার্থনা জানাতে ওঠে পড়ে লাগলো। অনেক কে রোজা রাখতেও দেখেছি। আমার বাড়ীর এক বোয়া ইংগির মা সারাদিন আমাদের বাড়িতে কাজ করে যে খাবার টুকু পেয়েছিল তা সে নিজে না খেয়ে অন্য আর এক গরীবকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য মহাপ্রভুর নামে দিয়ে দিতে আমি দেখেছি।

ঢাকায় নির্বিচারে গণহত্যা হচ্ছে। গ্রামের মানুষগুলো বেতারের সংবাদে বিমূঢ় হয়ে ওঠলো।এর বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে বিশ্ব বিবেক দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ল। এই দুটি পরাশক্তির মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পক্ষালম্বন করে। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে পাকবাহিনীর নির্বিচারে বাঙালী হত্যাকে যেমন সমর্থন জানায় অন্য দিকে পাকিস্তান তথাকথিত অখন্ডতা রক্ষার নামেও পাক সরকারকে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতে থাকে। এর মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিশ্বাসী  বিশ্ববিবেক ও বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষার ব্যাপারে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে।আমি পূর্বেই বলেছি যে, এ সময় মানুষের সবচেয়ে বড় শান্তনা ছিল তাদের প্রানের ধন, চোখের মনি বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন। দিন যত অতীত হতে চলেছে দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর নামে, স্বাধীনতার নামে ততবেশি উন্মাদ ও উদ্দীপ্ত হতে থাকে।

অজপাড়াগাঁয়ের মানুষ যাদের মগজে কখন রাজনৈতিক ঢোকেনি, এ নিয়ে কখনো ভাবেওনি, পাকিস্তানের বিমাতা বৈষম্যের সম্পর্কে যাদের কখন কোন ধারণা ছিলনা, গ্রামের সেই খেটে খাওয়া দিন মজুর কৃষক, বোয়া তারাও পাকিস্তনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার দাবীতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তৎকালীন ইটনা থানার অন্তর্গত বর্তমান মিঠামইন উপজেলাধীন তেলীখাই গ্রামের কৃষক, মজুর ও ঘরের বোয়াদের মাঝে সেদিন আমি স্বাধীনতার যে দৃঢ়তা ও শক্তির সৃষ্টি আমি দেখেছি তা ভাষায় লিপিবদ্ধ করে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মার্চের ২৬ তারিখ গণহত্যা চালানোর মধ্য দিয়ে পাকসেনারা ঢাকার কর্তৃত্ব গ্রহনের পর সারাদেশে তাদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার কাজে রত হয়ে পড়ে। তারা ২৬ শে মার্চের কায়দায় বড় বড় জেলায় ও মহকুমায় প্রবেশ করতে থাকে। এছাড়া কিছু কিছু শহর ও থানা গুলোও তাদের দখলে নিয়ে যায়।আমি গ্রাম থেকেই তা বুঝতে পারলাম। কারণ তেলখাই গ্রামের উত্তর শেষ সীমান্তে আমার বাপ চাচাদের বাড়ি। এই বাড়ির তিন চার গজ তফাৎ হলো ঐতিহাসিক তেলীখাই বাজার। এই বাজারে প্রায় আড়াইশত বছর পূর্বের একটি বটবৃক্ষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে।

তবে আগের মতো ডাল পালা নেই। তেলীখাই গ্রামের পূর্ব দিক দিয়ে একটি মাটির রাস্তা।এই রাস্তা দিয়ে উত্তরে মেঘালয় পর্যন্ত পথে পথে যাওয়া যায় যদিও অনেক নদীনালা পার হয়ে যেতে হয়। আর দক্ষিণ দিকে পূর্ব দক্ষিণ পশ্চিমের যে কোন শহর বন্দর ও গ্রামে যাওয়া যায়। আমাদের পুরোনো বাড়ির (আলগা বাড়ি) দক্ষিণ পাশ দিয়ে পূর্ব দিকে রাস্তা রয়েছে।এই রাস্তা দিয়েও অনেক থানায় যাওয়া যায়।আমাদের গ্রামের পশ্চিমে হাটুরিয়া নদী। তবে হাটুরীয়া নদীর পশ্চিওম দিক থেকেও বিভিন্ন জেলা মহকুমা বা থানা থেকে জনগণ আসার রাস্তা রয়েছে।তবে হাটুরীয়া পার হয়ে আসতে হয়। হাটুরীয়া খুব একটা গভীর জলের নদী নয়। চৈত্র বৈশাখে হেটেও আসা যায়।

তেলীখাই বাজারের সেই ঐতিহাসিক বটবৃক্ষের নিচে আমি, আমার চাচাতো ভাই, গিয়াসউদ্দিন আলমাছ, জসিমউদ্দিন, টেনামিয়া, রেনু, রইছ, আঃহক, হানিফ, সুরজমিয়া, সোনামিয়া, চাঁন মিয়া বসে সারাদিন দেশের অবস্থা নিয়েই আলোচনা ও জল্পনা কল্পনা করতাম। কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া যায়,কখন যাব ইত্যাদি।এর মধ্যেই উল্লেখিত রাস্তা গুলো দিয়ে পাকসেনা এর নির্বিচারে হত্যা অগ্নিসংযোগ এবং নির্যাতন থেকে রক্ষা পাবার জন্য বিভিন্ন শহর বাসীরা একটু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দিগ্বিবিক আস যাওয়া করতে থাকে।স্বপ্নের শহর আর সুখের আস্তানা ছেড়ে শুধু নিজেদের প্রাণ বাচাঁনোর জন্য সহায় সম্পদ ফেলে শহরের মানুষ পঙ্গপালের মতো উত্তর থেকে দক্ষিণে,দক্ষিণ থেকে উত্তরে এমনিভাবে তেলীখাই গ্রামের চারিদিক দিয়ে দলে দলে মানুষ গ্রামের দিকে ছুটে যাচ্ছে।এসব মানুষ গুলির মধ্য দিনমজুর থেকে সরকারী ছোট বড় অনেক কর্মচারী কর্মকর্তাও ছিলেন।

তারা অনাহার অনিদ্রায় মাইলের পর মাইল হেঁটে পথ চলতে গিয়ে অনেকেই এসে এই তেলীখাই গ্রামের বটবৃক্ষের নিচে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিতেন। তবে অনেকেই চলার গতি থামাইনি।তারা দ্রুতগতিতে আপন আপন নিরাপদ স্থানে যেতে থাকেন। আমরা প্রথমেই ধন সম্পদ,সুখের আবাস ছেড়ে পালিয়ে আসা ক্ষুধার্ত ক্লান্ত, মানুষ গুলোর সেবায় নিয়োজিত হলাম। আমাদের মা চাচিরা চিড়া মুড়ি তৈরী করে দিত। খিঁচুরী কখন ভাত রান্না করে দিলে সেই বট বৃক্ষের নিচে বসিয়ে সেই সব মানুষগুলোর ক্ষুধা নিবারণ করে দিতাম। শুধু আমাদের পরিবারই নয়।আমার গ্রামের অত্যন্ত গরীব দিনমজুরও তখন হৃদয়ের প্রেমের দ্বার খুলে এগিয়েছিল সেই সব মানুষগুলোর সেবায়।শুধু তাই নয় রাত জেগে নিজে থাকার মত একটি মাত্র ঘরটিও ছেড়ে দিতেন শহর থেকে পালিয়ে আসা পরিবারের জন্য।এমনও দেখা গেছে নিজেরই কোনো খাবারেও সংস্থান নেই,তবুও আশ্রিত মানুষ গুলোর জন্য খাবার সংগ্রহের জন্য দূর গ্রামে গিয়েও দরিদ্র মানুষটি হাত পেতেছিল।

এমন আন্তরিকতা আজকের প্রজন্ম রুপকথার গল্পের মতই মনে করবে। প্রকৃত পক্ষে যারা স্বাধীনতার চেতনায় চোখ মেলে দেখেছে,অনুভব করেছে, তারা অবশ্যই বলত বাধ্য হবে যে, বিশ্বের কোন স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে মানুষের প্রতি মানুষের এমন সহমর্মিতা ও প্রেম ভালবাসা, আন্তরিকতা মানবতার ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয়না।

বর্তমান মিঠামইন উপজেলার সীমা রেখায় হাতেগণা কয়েকটি পরিবার ছিল যাদের পরিচয় সবাই জানতো।এদের মধ্যে আমাদের বাড়ি ছিল উল্লেখযোগ্য।বড় পরিবার ও বংশে লোক ছিল অনেক।আমার বাপ চাচারা ছিল সাত ভাই,যেমন-আলহাজ্ব হাফিজ উদ্দিন ভূঞা,আলহাজ্ব মুলক হোসেন ভূঞা,আলহাজ্ব ময়ধর আলী ভূঞা,আলহাজ্ব হায়দার আলী ভূঞা,মাধবর আলী ভূঞা, আলহাজ্ব জয়ধর আলী ভূঞা ও আমীর হোসেন ভূঞা। আমরা দুই ভাই এক বোন।

এছাড়া অন্যান্য ছয় চাচা জেঠার কারো কারো দশ বারো ছেলে। এ হিসেবে ছেলেদের সন্তানাদী নিয়ে আমাদের বংশটা ছিল আশ পাশের বংশ থেকে অনেক বড়। স্বাধীনতার পয়ত্রিশ বছর পর আজকের এই দিনেয়ামার বংশের সবাইকে আমি চিনতেই পারছিনা।বাড়িতে যাওয়া আসা করলে পরিচয় হয় কিন্তু এত লোকের নাম স্মরণ রাখাই সম্ভব হচ্ছেনা। সে হিসেবে আমরা দৃঢ়তার সাথে বলতে পারছি যে,আমাদের এই বড় বংশের মধ্যে একজন মানুষও স্বাধীনতা বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়নি।বরং তখনকার সময় আমাদের পরিবার ও বংশে শিক্ষিতের হার তুলনামুলক ভাবে বর্তমান মিঠামইন উপজেলার ভৌগলিক সীমারেখায় বেশি ছিল।এছাড়া কেওয়ারজোর ইউনিয়নের কাঞ্চনপুর গ্রামের আয়ুব রেজা চৌধুরীর পরিবার শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং ধুবাজোরা গ্রামে আঃআজিজ ভূঞার পরিবার দাবী করতে পারত।আমাদের দেখাদেখি অনেকেই শিক্ষার দিকে পা বাড়াল এবং শিক্ষিত হল।সে কারণে দেশের চরম সন্ধিক্ষণে চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা পিছপা ছিলাম না।বিপদ অনিবার্য জেনেও সেদিন আমরা বংশের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নয়ে স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলাম।

পৃথিবীতে কোন সত্যই গোপন থাকেনা। আমাদের এই অবস্থানের কথাটিও লুকানো থাকেনি।য়ামাদের গ্রামেরই এক প্রভাবশালী ধনাঢ্য ব্যক্তি সাহেব আলী ভূঞা আমাদের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। তার বংশের কাছে, স্বাধীনতা বিরোধী এই চক্রের কাছে আমরা চিহ্নিত হয়ে পড়ি,এবং আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের মদদ দাতা হিসেবে গণ্য হতে থাকি।আর সেই চিহ্নিত হওয়ার কারণে আমাদেরকে পরে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই আমরা শহর থেকে পালিয়ে আসা মানুষগুলোর সেবার কাজ করে যাচ্ছি।পাকবাহিনী তখনো আমাদের হাওড়ের কোন স্থানেই স্থায়ী ভাবে ঘাঁটি স্থাপন করতে পারেনি। ইতিমধ্যে পাকবাহিনী সহযোগী হিসেবে সাহেব আলী ও তার ছেলেদ্বয় এবং জামাতারা নিজেদের কে দালালীতে নিয়োজিত করলো।

আমরা তখন পাকবাহিনী সম্পর্কে যত না ভীত ছিলাম,তার চেয়ে বেশি ভীত ছিলাম সাহেব আলীর বংশের দালালদের সম্পর্কে।প্রচন্ড উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার মধ্যে পুরো এপ্রিল মাস অতিবাহিত হচ্ছে।আমাদের পরিবার সাহেব আলী গংদের নিকট পাকিস্তান বিরোধী শক্তি হিসেবে গণ্য হয়ে পড়ে।

দিনই যত যাচ্ছে শহরের অবস্থা ততোই অবনতির দিকে যাচ্ছে।পাকবাহিনী এদেশের কয়েকটি ইসলামী সংগঠনের সহায়তায় শহরে বসবাসকারী স্বাধীনতার পক্ষ সমর্থক জনগণের বাড়ি ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।মা বোনদের সম্ভ্রম হানি সহনির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে। প্রাণের ভয়ে মানুষ সারাজীবনের উপার্জিত সম্পদ রেখে নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যাচ্ছে। সে সময় শহর লোকশুন্য হয়ে পড়ে।শহর পালানোর ভীড়ে বাংলার প্রতিটি অজপাড়া পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ গুলির পথ যাত্রায় সন্ধ্যা হলে কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, বাজিতপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, আশুগঞ্জ, বি-বাড়িয়া, কুমিল্লার মানুষ আমাদের বাড়িতে রাত্রি যাপণের জন্য আশ্রয় গ্রহন করত।

আমাদের বাড়িতে এসব অসহায় উদ্ভাস্তু মানুষগুলোর আশ্রয় দেবার বিষয়টা সাহেব আলী গংদের চোখে ভালো লাগেনি।তাদের ধারনা ছিল শহর থেকে পালিয়ে আসা লোকরা জয় বাংলার লোক।তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি।তাদের আশ্রয় দেয়ার অর্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করা।এসব কান্ড দেখে সাহেব আলী গংদের দৃষ্টি আমাদের প্রতি আরও প্রখর হয়ে ওঠলো।আমরাও আমাদের বংশের পুরো বাড়িতে সবাই মিলে লাইলেন্স করা একটি বন্দুক,বল্লম জাতীয় দেশীয় অস্ত্র নিয়ে নিজেদের বাড়ি পাহারা দেবার ব্যবস্থা করলাম। এভাবে আমরাও স্বাধীনতার জন্য মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম একটি স্বাধীন বাংলার জন্য।