পৃথিবীটা যতই বিশাল হোক দুঃখকে ফাঁকি দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। আর তেমন দুঃখের ভার বয়ে বেড়ায় কয়জন সারাজীবন।তিনিত আমাদেরই সমাজের মানুষ। তিনিইতো একজন শিক্ষাগুরু সুধীর চন্দ্র সরকার।তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি সকরুন হত্যাযজ্ঞে তারই  এক চিলতে ইতিহাস আজকের বিষয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় নয়টি মাস জুড়েইতো আছে কতই না রক্তের ইতিহাস, কতইনা স্বজনহারা  মানুষের বুকফাঁটা আর্তনাদ।

 

 

 

 

 

 

ছবিঃ গচিহাটা রেল স্টেশন সংলগ্ন ধুলদিয়া ব্রিজ।এই ব্রীজটিতে ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী কিশোরগঞ্জের অসংখ্য মানুষকে গণহত্যা করে।

কি জানে কেন বিজয়ের মাসটা এলেই চলে যাই পিছনের দিকে,ঘরে ঘরে সাজানো ইতিহাসের নিশ্ছিদ্র ঘটনাগুলি একে একে দাগ কেটে যায় এতটুকু বুকের উপর। ফিরে তাকাই ১৯৭১ এ। ১১ সেপ্টেম্বরের একটি নারকীয় ঘটনা আমার বিবেক ব্যথিত করে উষ্ণ অশ্রুতে ভারাক্রান্ত করে তোলে।শিশির সিক্ত ভোর রাত।এ কপাল রাজাকার হানা দেয় কিশোরগঞ্জ উপজেলার কর্শাকড়িয়াল ইউনিয়নের কানপাটি( খালপার) গ্রামের বাড়ি সুদ্ধ মানুষ তখন ঘুমন্ত। সুরেশ চন্দ্র সরকারের বাড়ি চারদিক থেকে ঘেরাও করে রাজাকাররা বন্ধুক কাঁধে বাড়ি ঘর ,দরজা ভাঙতে শুরু করে।কা রো পালাবার সুযোগ নেই।এ কে একে ধরা পড়ল সুরেশ চন্দ্র সরকার,হর্ষ বর্ধন সরকার, জ্ঞানচন্দ্র নন্দী, জয় চন্দ্র নন্দী, ধুসুধন নন্দী,র জনীকান্ত সরকার, রাজমোহন সরকার, বিপিন চন্দ্র সরকার, খগেন চন্দ্র দাস,বৈ কুন্ঠ সরকার।

কাল বিলম্ব না করে রাজাকাররা বন্দীদের সবাইকে কিশোরগঞ্জে পাকহানাদের কাছে সোর্পদ করে সেদিনই। আর পাকহানাদাররা দিনের আলো ফুরিয়ে যাবার পর পরই অকথ্য নির্যাতনে বন্দীদেরকে বেঁধে নিয়ে যায় ধুলদিয়ার রেলসেতুতে।ম র্টারের গুলিতে অন্ধকারে গুটি কয়জন পালাতে পারলেও সাত সাতজন মানুষ আর কোনদিনও ফিরে আসেনি নিজ গ্রামে।তাদের জীবনে আর সূর্যোদয় হয়নি কখনো।

ছবিঃ হানাদার পাকবাহিনীর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া শহীদ পরিবারের একমাত্র সদস্য সুধীর চন্দ্র সরকার।

একটি পরিবারের সাত সাতজন মানুষ যদি একই সময়ে হারিয়ে যায় তবে তার দুঃখের ভার এত তীব্র যন্ত্রনার, তা পরিমাপ করার শক্তি একমাত্র ভূক্তভোগী ছাড়া কারো দ্বারা সম্ভব নয়।সেই যন্ত্রনার ভার যার বুকে এসে জমা হয়েছিল তিনি তৎকালীন স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ছাত্রনেতা। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করতে ভারতে চলে গিয়েছিল।তি নিই আজকের একজন শিক্ষাগুরু সুধীরচন্দ্র সরকার।পিতা সুরেশ চন্দ্র সরকারের একমাত্র উত্তরপুরুষ।

একটি নিষ্প্রভ বংশের শেষ ঠিকানা। সুধীর চন্দ্র সরকার বাল্যকাল থেকেই ছিলেন স্বাধীনতাপ্রিয়।বাংলার মুক্তিকামী আন্দোলনে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বংলাদেশের স্বনামধন্য অস্থায়ী  রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের একান্ত সহচর ও অনুগত।কি ন্তু দূর্ভাগ্য মানুষকে এমনভাবে আঘাত করে যা দূর্ভাগ্য কবলিত মানুষকে সারাজীবন সে আঘাত বুকে নিয়ে বাঁচতে হয়।আর সে বাঁচা যে কত নির্মম,নিষ্ঠুর যন্ত্রনার আকর তা সুধীর চন্দ্র সরকারই  তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে ভোগ করেছেন তার যাপিত জীবনে। সেই শুন্য স্বজন পরিজনহীন কানকাঠির ভিটায় কতো যে বুক থাবড়াতে হয়েছে তার,কত যে অশ্রুর বহর গড়িয়ে পড়েছে দিনরাত দগ্ধ জীবনের ছত্রিশটি বছর তার খবর কতজনই বা রাখে।

আজ বাংলার মুক্তি আলো হওয়ায় আমরা কতজনই বা ফিরে তাকাই আমাদের অতীতের দিকে।কত জনই বা রোমন্থন করি আমাদের অতীত ইতিহাস।যে ইতিহাস আমাদের শেকড়ের ভিত তৈরী করে দিয়েছে।আমাদের চোখ তুলে বুঁক উচু করে দাড়াঁবার শক্তি।আর সে ইতিহাসেই একটি ক্ষুদ্র অংশ কানকাঠি গ্রামের হত্যাযজ্ঞের সকরুন বিলাপ আজ চোখের জলে স্মৃতির দোলায় উসকে ওঠে সুধীর চন্দ্র সরকারের বুকের তলে।যার শেষ নেই,সমাপ্তি নেই।হয়ত আমরণ থেকে যাবে একটি হত্যাযজ্ঞের সকরুণ বিলাপ।তার রক্ত মাংসের প্রতিটি কোষের অনুরেনুতে।

লেখকঃ কবি ও প্রাবন্ধিক।