১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু জেলা গভর্নর পদ প্রবর্তন করেন। আমার বয়স তখন ২৮। ওই অল্প বয়সেই আমাকে টাঙ্গাইলের জেলা গভর্নর পদে নিয়োগ করা হয়। জেলা গভর্নরদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ছিল বৃহস্পতিবার। সে ট্রেনিংয়ের শেষ দিন। আমি আমার রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসভবন থেকে ওই ট্রেনিংয়ে অংশ নেই। ১৫ আগস্ট সকালেই শুনি সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা। জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের কথা শুনেই আমি প্রতিবাদ জানাবার জন্য এককাপড়ে বাসা থেকে বের হয়ে যাই।

বঙ্গবন্ধু হত্যার মর্মান্তিক খবরটি আমাকে প্রথম দেন আমার ছোট বোন সেলিমা সিদ্দিকী। আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে সে ওই শোকের খবরটি জানায়। তার আগের এক মাস আমার কেটেছে ভীষণ ব্যস্ততায়। সকালে যেতে হতো ট্রেনিংয়ে। ফিরতে হতো সন্ধ্যার পর। রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে গভীর রাত পর্যন্ত কর্মীদের সময় দিতে হতো। আগস্টের ৮ বা ৯ আগস্ট আমার মা তখনকার পিজি বা আজকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আমরা ভাই-বোনেরা সবাই মা অন্তঃপ্রাণ। মায়ের পাশেও সময় কাটাতে হতো। সে জন্য অন্য কিছু ভাবারও সময় ছিল না।

স্বাধীনতা সংগ্রামের পর কাদেরিয়া বাহিনীর অস্র জমাদান

গভর্নর ট্রেনিং যেদিন শেষ হয় সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। আমরা জেলা গভর্নররা স্ব-স্ব জেলায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তবে তার আগে মন্ত্রীর দফতরে জেলা গভর্নরদের কাজ দেখানোর কথা ছিল। আমি বলেছিলাম, আমাকে যেন দেরিতে ঘুম থেকে ডাকা হয়। কারণ ১০টার আগে তো সচিবালয়ে যাওয়া হবে না। কিন্তু তখন ভোর ৫টা ১০ কিংবা ১৫ মিনিট। আমার বোন দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে। ছোট ভাই ছোট ভাই দরজা খোলেন বলে সে ডাকা শুরু করে। আমি দরজা খুলতেই সে জানায়, ক্যু হয়েছে। সত্যিকার অর্থে ক্যু কাকে বলে আমি তখন জানতাম না। বোনকে জিজ্ঞাসা করলাম ক্যুর কথা বলছো কি ক্যু হয়েছে। সেলিমা বললো, সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। আমার কাছে ওর কথা বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হয়নি। বললাম ধুর; এটা কিভাবে সম্ভব? সে আমাকে রেডিও শুনতে বললো। আমার ইমিডিয়েট এক ছোট বোন থাকতো ধানমন্ডিতে। সে তার বাসা থেকে ফোন করে বললো ভাইয়া বাসা থেকে বের হয়ে যান। আর্মিরা বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে। আমি সে কথা শুনেও নাকচ করে দেই। বলি, এটা কিভাবে সম্ভব। বঙ্গবন্ধুকে কেউ হত্যা করতে পারে তা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনেই হচ্ছিল না। সে বললো, তুমি রেডিও অন করো তা হলেই বুঝতে পারবে। তখনই আমি রেডিও অন করি। শুনি মেজর ডালিম নামের এক ব্যক্তি রেডিওতে ঘোষণা করছে খুনি মুজিবকে উৎখাত করা হয়েছে। তাকে হত্যা করা হয়েছে। বারে বারে বলছে এ কথা।

বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা যখন শুনি তখনকার প্রতিক্রিয়া কাউকে বোঝানো সত্যিকারভাবে দায়। এটা শুধু উপলব্ধি করা যায়। অনুভব করা যায়। মানুষের জীবনে দুঃসময় আসে। বলা হয় আকাশ ভেঙে পড়া বিপদ। আমি আমার জীবনেও অনেক কষ্ট দেখেছি। বিবাদ দেখেছি। কিন্তু তার কোনোটিই বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরের মতো নয়। বুকের ভেতর প্রচণ্ড কষ্ট, প্রচণ্ড বেদনা সৃষ্টি করেছিল এ ঘটনা।

বঙ্গবন্ধু হত্যা যত বেদনাসিক্ত হোক না কেন_ এটি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর যেদিন আমরা বিজয় লাভ করি, সেদিন থেকেই পরাজিত শক্তি বদলা নেওয়ার জিঘাংসায় ভুগছিল। স্বীকার করতেই হবে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় হলেও পরাজিত শক্তি দুর্বল ছিল না। পরাজিত শক্তি বলতে আমরা পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনকেও বলতে পারি। সন্দেহ নেই চীন আজ আমাদের বন্ধু হয়ে গেছে। কিন্তু চীনও একাত্তরে পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়েছে। সহায়তা দিয়েছে। এমনকি পাকিস্তানের সহায়তায় চীনা সৈন্য আসতে পারে মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন কথাও শোনা গেছে। তবে তা হয়নি। চীন হয়তো তার অর্থনৈতিক বাস্তবতায় কোনো যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়নি। একাত্তরের আগে থেকেই চীনের পলিসি হলো অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া। এ জন্য তারা বাধ্য না হলে কোনো সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে চায় না। মনে হয় আরো ২০ বছর হয়তো তাদের এই নীতি অব্যাহত থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধ পলিসি সম্পর্কে আমি যেটুকু পড়াশোনা করেছি_ তাতে আমার মধ্যে এমন ধারণার সৃষ্টি হয়েছে।

একাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয় তখন সে বিষয়টি ছিল আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য। আজ এত বছর পর অনেক কিছুই মনে হতে পারে। কিন্তু সে সময় শেখ মুজিব ছিলেন আমাদের কাছে, বাঙালি জাতির কাছে ভিন্ন এক অস্তিত্ব। বিশালতার দিক থেকে যার তুলনা ছিলেন তিনি নিজেই। ফলে তাকে হত্যা করা যায়, বাঙালিরা তাকে হত্যা করতে পারে এমনটি ভাবা ছিল কঠিন। ফলে বিশ্বাসের ঘোর কাটতে সেদিন সময় লেগেছিল। আমার ক্ষেত্রেও এটি এক সত্যি।

আমি মনে করতাম বঙ্গবন্ধুকে যারা মারতে পারে তারা আমাকে টার্গেট করবে। তারা যদি আমাকে অবহেলা করে তবে আমি গেইনার হবো। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল ছায়ার মতো। ফলে বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করতে পারে তারা আমাকেও হত্যা করার কথা ভাববে এমনটিই স্বাভাবিক। তাই যখন আমাদের হত্যাই করা হবে তখন তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই হবে। গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিরোধ গড়ার সুযোগ থাকলে তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিরোধ করা হবে। আর অগণতান্ত্রিকভাবে শত্রুরা আমাদের মোকাবেলা করতে চাইলে অর্থাৎ অস্ত্রবলে আমাদের দমন করতে চাইলে সেভাবেই প্রতিরোধ করা হবে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা যেহেতু ছিল অস্ত্রধারী, সেহেতু আমরাও তাদের প্রতিরোধে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হই। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমাদের দেশান্তরী হতে হয়েছে। জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আমরা দীর্ঘদিন প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছি দেশে থেকেই। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীরা সে সময় ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। তাদের প্রতিরোধ করতে প্রয়োজন ছিল ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। কিন্তু আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতৃত্বের কাছ থেকে আমরা এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাইনি। আওয়ামী লীগ নেতারা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে খুবই অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। তাদের এ ব্যর্থতা ক্ষমাহীন। বলা যায়, দুনিয়ার আর কোথাও কোনো দল এ ধরনের ব্যর্থতার পরিচয় দেয়নি । আওয়ামী লীগ কখনোই আঘাতপ্রাপ্ত হলে দলীয় নেতারা সবসময়ই ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। ভবিষ্যতেও যদি কখনো ওই দলটির ওপর আঘাত আসে তবে দলের নেতারা যে ব্যর্থতার পরিচয় দেবে তাতে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই। আওয়ামী লীগকে এ পর্যন্ত বহুবার কর্মীরা বাঁচিয়েছে। বাঁচিয়েছে দেশের মানুষ।আগামীতে যদি বাঁচে কর্মীদের দ্বারা বাঁচবে। দেশের মানুষের দ্বারা বাঁচবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করলেও আওয়ামী লীগ নেতাদের পূর্ণাঙ্গ সমর্থনের অভাবে আমরা সফল হতে পারিনি।

এক পর্যায়ে আমরা দেশান্তরী হতে বাধ্য হই। সে অবস্থায়ও আমাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম চলতে থাকে। ভারতকে আমরা প্রতিরোধ সংগ্রামের পশ্চাৎভূমি হিসেবে ব্যবহার করি। ইতোমধ্যে ভারতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে। ক্ষমতায় আসেন মোরারজী দেশাই। জিয়াউর রহমান নানা ছলাকলার আশ্রয় নিয়ে তার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ভারতের সঙ্গে চুক্তি করে তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামীদের প্রতি ভারতের সমর্থন বন্ধের ব্যবস্থা করেন। শুধু তাই নয়, ওই সময় মোরারজী দেশাইর সরকার অসংখ্য প্রতিরোধ সংগ্রামীকে ধরে জিয়াউর রহমানের হাতে তুলে দেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত ১০৪ জন প্রতিরোধ সংগ্রামী শাহাদাতবরণ করে। ১৯৭৭ পর্যন্ত আমি দেশেই ছিলাম। দেশে থেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে এবং খুনিচক্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখি। মোরারজী দেশাই সরকারের ভিন্ন ভূমিকার কারণে আমাদের পক্ষে প্রতিরোধ টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় ১৯৭৭ সালে আমি ভারতের বুকে পা রাখি। ১৯৭৭ থেকে ‘৯০ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৪ বছর সে দেশে থাকি। একজন দেশপ্রেমিকের জন্য নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশে বসবাস, বিশেষ করে নিজের দেশে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া দোজখে থাকার সমান। ভারতের মানুষ সে সময় আমাদের প্রচুর সম্মান দেখিয়েছে। মোরারজী দেশাই সরকারের কাছ থেকে প্রতিকূল অবস্থায় পড়তে হলেও সে দেশের সাধারণ মানুষের উষ্ণ ভালোবাসা সবসময় পেয়েছি। এখানো ভারতে গিয়ে কেউ আমার কথা জিজ্ঞেস করলে আমাকে চেনেন কিংবা আমার সম্পর্কে সমীহ করে কথা বলবেন এমন অনেককেই পাওয়া যাবে।

প্রবাস জীবন ছিল আমাদের জন্য প্রচণ্ড কষ্টের। আর্থিক কষ্টেও ভুগতে হয়েছে। ১৯৭৭ সালে আমি যখন ভারত যাই তখন কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। ১৯৯০ সালে যখন দেশি ফিরে তখন ক্ষমতায় ছিল চন্দ্র শেখরের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। মোরারজী দেশাইর সরকার ছিল ক্ষণস্থায়ী। সে সময় আমাদের বেশ প্রতিকূল অবস্থায় পড়তে হয়েছে। চন্দ্র শেখরের সঙ্গে ব্যক্তিগত সখ্যতা ছিল। সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের শিষ্য ছিলেন তিনি। সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ ভারতে আশি থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত কার্যত এ যুগের মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি আমাকে সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন। চন্দ্র শেখর ছিলেন জনতা পার্টির সভাপতি। ১৯৭৭ সালে এই জনতা পার্টিই কংগ্রেসকে হটিয়ে ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। আমি যখন দেশে ফিরি তখন ওই চন্দ্র শেখর ক্ষমতায় ছিলেন। আগেই বলেছি, এটা ছিল অন্তর্বর্তীকালীন বা একটি অস্থায়ী সরকার। ভারতের শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক সর্বস্তরের লোকজনের সঙ্গে প্রবাস জীবনে পরিচয় হয়। শেষদিকে আমি ছিলাম বর্ধমানে। শান্তিনিকেতন ছিল খুবই কাছে। মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে। কবিগুরুকে দেখার সুযোগ না থাকলেও তার রেখে যাওয়া স্মৃতি দেখার সুযোগ হয়েছে। শান্তিনিকেতনে আমার ছোট বোন সেলিমা সিদ্দিকীকে ভর্তি করে দিয়েছিলাম লেখাপড়ার জন্য।

ভারতে প্রবাস জীবনে নিজের দেশ, মা, মাটি ও মানুষের সানি্নধ্য থেকে বঞ্চিত হওয়া ছাড়া অন্য সব দিক থেকে ভালোই ছিলাম। তবে একজন রাজনীতিক হিসেবে এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার কাছে প্রবাসের মুখ স্বাচ্ছন্দ্যের হাতছানির চেয়ে দেশের কষ্টকর জীবনই ছিল বেশি কাম্য।

আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে প্রতিরোধ গড়তে গিয়েই এক পর্যায়ে আমাকে দেশ ছেড়ে ভারত যেতে হয়েছিল। ভারতে আমি ছিলাম সে দেশের সরকারের অতিথি হিসেবে।

১৯৯০ সালে আমি দেশে ফিরি। দীর্ঘ ১৫ বছরের সামরিক শাসন বা সামরিক স্বৈরাচারের অবসানের পর আমার দেশে ফেরার সুযোগ হয়। ১৯৭৭ সালে আমি যেমন স্বেচ্ছায় দেশান্তরী হয়েছিলাম, তেমনি ১৯৯০ সালের বিজয় দিবসের দিনে দেশে ফিরি আমি নিজের সিদ্ধান্তবলে। যখন দেশে ফিরি তখন আমি আওয়ামী লীগ করতাম। দলের ওয়ার্কিং কমিটির এক নম্বর সদস্য ছিলাম। রাজনৈতিক দলে ওয়ার্কিং কমিটির এক নম্বর সদস্যপদ খুবই মর্যাদাসম্পন্ন। যারা অতীতে দলের সভাপতি ছিলেন এবং পরবর্তীতে সভাপতি হতে পারেন এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদাসম্পন্ন নেতাদের ওই পদে বসিয়ে সম্মান দেখানো হয়। আমাকে আওয়ামী লীগ সে সম্মান দিয়েছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তার পিতার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করায় হয়তো আমার প্রতি খুবই সুপ্রচ্ছন্ন ছিলেন। সে জন্যেও হয়তো আমাকে এ সম্মান দেখানো হতে পারে। স্মর্তব্য যে, আমাকে যখন ওয়ার্কিং কমিটির এক নম্বর সদস্য করা হয় তখন শেখ হাসিনা দিলি্লতে ছিলেন। স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা অবস্থায় তাকে আওয়ামী লীগের মতো বিশাল দলের সভাপতি করা হয়। আমাকেও ওয়ার্কিং কমিটির এক নম্বর সদস্য করা হয় দেশান্তরী থাকা অবস্থায়। ১৯৯০ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমি দেশে ফেরার পরিকল্পনা করি। আমি আমার এ সিদ্ধান্তের কথা টেলিফোনে সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে জানাই। আমি জানি না কেন তিনি তাতে আপত্তি জানান। বলেন, এ সময়ে তোমার দেশে ফেরা ঠিক হবে না। তুমি আরো পরে আসো। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। কয়েক মাস ধরেই আমি দেশে ফেরার কথা ভাবছিলাম। এর আগে ৫ বছর ধরে কাদের সিদ্দিকী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সংগ্রাম পরিষদ নামে একটি কমিটি গঠন করে আমার সহকর্মীরা যারা আমাকে ভালোবাসত তারা আন্দোলন করছিল। সে কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন আমার স্ত্রী নাসরিন সিদ্দিকী। তিনি একজন সাধারণ মহিলা। তারপরও তার নেতৃত্বে এ কমিটি সারাদেশ চষে বেড়ায়। এ কারণেই ‘৯০ সালের ডিসেম্বরের আগেই দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যেহেতু আমি কারো অনুমতি নিয়ে দেশান্তরি হইনি সেহেতু দেশে ফেরার ব্যাপারে কারো অনুমতির তোয়াক্কাও করিনি। দেশে ফেরার আগে দিলি্লতে আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাতে মিলিত হই। ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতিবসুর সঙ্গে দেখা করি। ১৪ ডিসেম্বর রাতে দিলি্লতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার দিলি্ল থেকে কলকাতায় হাজির হন। তিনি আমাকে বললেন, দেশে ফেরার জন্য আপনার একটা পাসপোর্ট দরকার। উপ-যাজক হয়ে তিনি আমার নামে পাসপোর্ট ইস্যুর আগ্রহ দেখালেন। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আমি তো পাসপোর্টের মাধ্যমে আসিনি। দেশে ফিরতে পাসপোর্টের কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না। তিনি নানাভাবে রাজি করানোর চেষ্টা করলেও আমি পাসপোর্ট নিতে অস্বীকৃতি জানালাম। তিনি বললেন, আপনি একটু দেরি করে দেশে ফেরেন। আপনাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। বললাম আমি তো বেড়াতে আসিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে করতে দেশান্তরি হয়েছি। আমার রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ১৪ ডিসেম্বর সারাদিন চলে আমাকে ম্যানেজ করার কসরত। আমাকে দেশে ফেরা থেকে বিরত রাখতে নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়। ১৫ ডিসেম্বর তারা অধির হয়ে পড়েন। আমাকে বারবার বোঝানো হলো দেশে ফেরার জন্যই আমাকে পাসপোর্ট নিতে হবে এবং এটাই নিয়ম।

কিন্তু কোনো যুক্তিতেই আমাকে রাজি করা গেল না। বলতে পারি আমিই ছিলাম খুব সম্ভব একমাত্র বাঙালি, যে বিনা পাসপোর্টে ঢাকা বিমাবন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করেছে। আমি যে দেশের নাগরিক, মুক্তিযুদ্ধ করে আমি যে দেশের জন্ম দিয়েছিলাম সে দেশে প্রবেশ করেছি। বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ নিয়ে শেষ পর্যন্ত কোনো বাদ-প্রতিবাদের চেষ্টা করেনি। আমার দেশে ফেরার ব্যাপারে সরকারের বা অন্য কারো কোনো ভূমিকা নেই। ১৫ বছর আগে ঘর ছেড়েছিলাম বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ জানানোর জন্য। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ জানাতেই ১৫ বছর পর দেশের মাটিতে পা রেখেছি। আমাদের প্রতিবাদের ফসল হিসেবেই বঙ্গবন্ধু হত্যার দীর্ঘদিন পর হলেও সে হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। খুনিদের ফাঁসি হয়েছে।

আজ অনেকেই বাহাদুরি করতে পারে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যদি আমরা প্রতিবাদী ভূমিকা না রাখতাম তাহলে আজ আওয়ামী লীগেরও অস্তিত্বও থাকত না। জিয়াউর রহমানের লোকেরা আওয়ামী লীগ নেতাদের কচু কাটা করতেও পিছ-পা হতো না। তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারীদের ভয়ে সে সাহস পায়নি। স্পষ্টভাবেই বলতে পারি ১৯৭৫ সালের প্রতিরোধকারীদের রক্তের ওপরে আজকের আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত। আজকের সরকার প্রতিষ্ঠিত। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের বিনিময়ে যেমন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে ঠিক তেমনি ১৯৭৫ সালের প্রতিরোধ সংগ্রামীদের ত্যাগের বিনিময়ে আওয়ামী লীগ টিকে আছে। তারা আবার ক্ষমতায় আসতে পেরেছে। প্রতিরোধ সংগ্রামীদের রক্তের ওপর দিয়েই গড়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ।

লেখক: রাজনীতিক।