সুন্দরবন সংলগ্ন জেলাগুলোর জলজ ঝোপঝাড়বহুল বিল-ঝিল-হাওরসহ যেকোনো জলাশয়-খেতে দেখা যেতে পারে এই পাখিটি। ফকিরহাট-বাগেরহাট-চিতলমারীসহ বাগেরহাট সদর উপজেলার জোড়া উত্তরের হাওরের আখঘাস, বন-নলখাগড়া, হোগলা, কেনি-হোগলা, হাজিবনসহ অন্যান্য জলজ ঝোপঝাড়ে এদের দেখা মেলে। দেখা মেলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের হাওরেও। খোদ সুন্দরবনেও দেখা মিলবে।

মোহনা-হ্রদের পারের ঝোপঝাড়েও এরা গেরিলা কৌশলে ঘুরে বেড়ায়। অতি সাবধানি, চতুর, ভীতু ও অতি চঞ্চল এক পাখি। বিপদ বা মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই নলখাগড়াসহ অন্যান্য বনের ভেতরে ঘাপটি মারবে। চুপচাপ থাকবে। ধৈর্য নিয়ে আড়ালে বসে অপেক্ষা করলে চকিতে এদের দেখা মিলবে। এই দেখা যায়, এই নেই! ডাকবে ভোরে অথবা সকালে, পাঁচ-সাতটি পাখি মিলে ‘কিরিচ কিচ’জাতীয় শব্দে ডাকবে। অন্য সময় চুপচাপ। শীতে রোদ পোহাবে। দুপুরে দোয়েল পাখির মতো অল্প জলে বুক-পেট ডুবিয়ে ডানা ঝাপটে গোসল করবে। খাবার নিয়ে প্রয়োজনে স্বজাতির সঙ্গে লড়াই করে। এ ক্ষেত্রে যুদ্ধংদেহী ভঙ্গিটা হয় খুবই উপভোগ্য।

মূল খাদ্য এদের কুচো চিংড়ি, জল-কাদা-শেওলা এবং পচা জলজ পাতার স্তূপে জন্ম নেওয়া ল্যাদা পোকা ও নলনাটা বনের ভেতরের ডানাওয়ালা একধরনের ছোট পোকা। এই পোকা ধরার জন্য এরা হাস্যকর লম্ফঝম্প দেয়। মশাও অতি প্রিয় খাদ্য এদের। এই পোকাগুলো বিকেল বা গোধূলিতে ঝোপঝাড় থেকে উড়ে উড়ে বের হয়। বড়শিতে ছোট চিংড়ি গেঁথে এদের শিকার করে অনেকেই—বিশেষ করে উত্তরের হাওরে।

বহুবার চিংড়িঘেরের টংঘরে বসে খুব কাছ থেকে এ ধরনের ক্রেক রেইলজাতীয় পাখির কর্মকাণ্ড আমি মন-প্রাণ ভরে দেখেছি। প্রায় রংহীন কারেন্ট সুতার জালের ফাঁস-ফাঁদ ও দড়ির ফাঁস-ফাঁদেও আটকা পড়ে এরা। ফকিরহাট-চিতলমারী-মোল্লাহাট এলাকায় প্রতি শীত মৌসুমে এ-জাতীয় পাখি ধরা হয় শত শত। বাজারে বিক্রিও হয়। এই লেখার সঙ্গে ছাপা হওয়া ফাঁস-ফাঁদে আটকে পড়া পাখিটিকে আমি জানুয়ারি মাসে অবমুক্ত করেছিলাম। জাল-ফাঁদ এদের শত্রু। শত্রু ঢোঁড়াসাপও। এরা রাতে আশ্রয় নেয় নলখাগড়া-আখঘাসের মাঝামাঝি বরাবর, মাটিতে নয়। বাসা করে মাটির ওপরে—আখঘাসের পাতা ও অন্যান্য পাতা দিয়ে। ঝোপঝাড়, ঘাসবন, এমনকি ধানবনেও বাসা করে। ডিম ছয় থেকে আটটি। দুজনে তা দেয়। ডিম ফোটে ২০ থেকে ২৪ দিনে। বাসা করে বর্ষাকালে।

পাখিটির নাম ‘লালখেনি’। ইংরেজি নাম Ruddy-Breasted Crake। বৈজ্ঞানিক নাম porzana fusca। মাপ ২০-২১ সেন্টিমিটার। ওজন ৮০-১০০ গ্রাম।
একনজরে শরীরের রং এদের পোড়া ইটের মতো। তাতে লালচে বাদামি রঙের আভা মাখানো। গলা সাদা। পেটের দুপাশে ও লেজের তলায় আড়াআড়ি সাদা-কালো সরলরেখা টানা—রঙের চমৎকার সমন্বয়। লেজের ডগা ঘন ঘন নাড়ে। মাথায় খোঁট মারে ঘন ঘন। দৌড় ও লম্ফ দিতেও ওস্তাদ। অহেতুক উত্তেজনায় ভোগে সারাক্ষণ।

লিখেছেনঃ শরীফ খান