গত ৪ জুলাই জেনেভার সার্ন গবেষণাগারে ঈশ্বর-কণা, যা হিগস-বোসন নামে পরিচিত, তার দেখা মিলল পদার্থবিদ ও প্রকৌশলীদের দীর্ঘ গবেষণায়। প্রথম আলো সাম্প্রতিক কালে বেশ কয়েকজন লেখকের লেখনীর মাধ্যমে সাধারণের জন্য বিজ্ঞানের এই জটিল কণার কথা তুলে ধরেছে,লেখক হুমায়ুন রেজা লিখেছেন, ‘১৯৪৮ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পাওয়া ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের বিকিরণতত্ত্ব ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু দেখলেন, কোথায় যেন একটা লুকোচুরি রয়েছে, মিলছে না।’ লুকোচুরিটা ছিল এ রকম: বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কোয়াইস বলবিদ্যা এক অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিল পদার্থবিদ্যার জগতে।

আণবিক ও পারমাণবিক কণাগুলোর অন্তর্নিহিত ধর্মগুলো এই বলবিদ্যার সাহায্যে সফলতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল, যা চিরায়ত নিউটনীয় বলবিদ্যার সাহায্যে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। তত দিন পদার্থের তাপগতিবিদ্যাবিষয়ক ধর্মাবলির অনেকগুলোই চিরায়ত বলবিদ্যার সাহায্যে মোটামুটি সফলভাবে ব্যাখ্যা করা গেলেও গোল বাধল কালো বস্তুর বিকিরণের ব্যাখ্যা নিয়ে। অনেকেই চিরায়ত তাপগতিবিদ্যার আলোকে এই বিকিরণের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিফল হলেন; অনেকে আবার কোয়াইস ও চিরায়ত বলবিদ্যার এক জগাখিচুড়ি দিয়ে এর ব্যাখ্যা দিলেন। কিন্তু ফলাফল একই!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সত্যেন বসু এগিয়ে এলেন কালো বস্তুর বিকিরণের ব্যাখ্যা দিতে, সম্পূর্ণ কোয়াইম বলবিদ্যার ধারণা নিয়ে। ১৯২৪ সালে শাইট শ্রিফট ফুয়র পিদিতে প্রকাশিত চার পাতার তাঁর গবেষণাপত্রটি পদার্থবিদ্যার চলমান এই বন্ধ্যাত্ব ঘুচিয়ে এক নতুন সংখ্যায়নের জন্ম দিল, যা বোস-আইনস্টাইন কোয়ান্টাম সংখ্যায়ন নামে পরিচিত। যেসব বস্তুকণা এই সংখ্যায়নের আওতায় কাজ করে, সেগুলোকেই বলা হয় ‘বোসন’। আজকের হিগস-বোসন বসুর কোয়াইম সংখ্যায়ন মেনে চলে, যা আমরা সবাই জানি। বিশ্বদরবারে, বিশেষ করে বিজ্ঞানের জগতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সত্যেন বসু অদ্বিতীয় মেলবন্ধন। হিগস-বোসনপ্রাপ্তি আবার এই মেলবন্ধনের জবাব দিল।

এবার আসি আজকের পরিপ্র্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বসুর কথায়। যে মানুষকে নিয়ে আমরা অপার গর্ববোধ করি, তাঁকে কি আমরা ১৯৪৬ সালে অনেকটা ধাক্কা মেরে গোয়ালন্দে পাঠিয়ে দিইনি কলকাতাগামী জাহাজ ধরার জন্য? কার্জন হলে বসে যে মানুষটি বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক মাইলফলক সৃষ্টি করে গেছেন, তাঁর চেয়ারটি দখল করার জন্য আমাদেরই পূর্বপুরুষদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা হয়েছে। এই লজ্জার দায় আমরা নিই না, কিন্তু বসুর সম্মানের ভাগ নিতে কী আগ্রহ আমাদের!

শুনেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে ‘এস এন বোস সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ’ নামে রংচটা একটি নামফলক রয়েছে। বছরে গবেষকদের কিছু টাকা দেওয়া ছাড়া ওই নামফলকের আর কিছু আছে বলে মনে হয় না। একটি সেন্টার থাকলে একজন পরিচালক থাকতে হয় এবং তা-ও আছে। তবে শুনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির ধারা অনুসরণ করেই ওই পরিচালক বাছাই করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বোস চেয়ার নামে একটি চেয়ার আছে। আমার জানামতে, যে তিনজন অধ্যাপককে পর পর ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁদের মধ্যে মাত্র একজনই ওই চেয়ারের যোগ্য ছিলেন, বাকি দুজনকে দেওয়ার জন্য দেওয়া আরকি! আমার এই মন্তব্যে অনেকেই ক্ষুব্ধ হবেন, তবে সত্য যা, তা-ই বলছি। আরও বলছি, চেয়ারটি শূন্য থাকবে না, অচিরেই কেউ না কেউ ওটা পাবেন!

অনেকেই বলেন, সত্যেন বসুকে আমরা যথাযথ সম্মান দিতে পারিনি। আমি বলি, বসুকে সম্মান দেওয়ার দরকার নেই। জগৎ তাঁকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছে। এবার বসুর নাম ব্যবহার করে আমরা আমাদের সম্মানিত করতে পারি কিছুটা হলেও। এ ব্যাপারে আমার প্রস্তাবগুলো হলো: এক. ‘বসু বিজ্ঞান গবেষণার’ নামে প্রথম শ্রেণীর একটি গবেষণাগার চালু করতে হবে। সেখানে ভৌত ও গাণিতিক বিজ্ঞানে বিশ্বমানের গবেষণা হবে; দেশ-বিদেশে যাঁরা আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত, একমাত্র তাঁদেরই নিয়োগ দিতে হবে ওখানে। দলবাজি ও গলাবাজির কোনো স্থান থাকবে না ওখানে। গবেষণা উৎকর্ষ সাধন করার জন্য দেশি-বিদেশি গবেষকদের আমন্ত্রণ জানানো হবে এই গবেষণাগারে নানা মেয়াদে কাজ করার জন্য। নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক আবদুস সালাম প্রতিষ্ঠিত ইতালির ত্রিয়েস্ত শহরে স্থাপিত তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের আদলে গড়ে তুলতে হবে এই গবেষণাগার।

দুই. বাংলাদেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরব পরিব্রাজক, ইয়েমেনি ধর্মপ্রচারক, অবাঙালি শাসক খান-পাঠান, পশ্চিমবঙ্গের বশিরহাটের ব্রিটিশবিরোধী যোদ্ধা, আধ্যাত্মিক ধর্মগুরুসহ অনেকের নামেই ছাত্রাবাস আছে। তাঁদের অনেকেরই ভাষা বাংলা ছিল না এবং অনেকেরই সর্বজনীন অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে বড় ধরনের কোনো অবদান আছে বলে আমাদের জানা নেই। তাঁদের আদানের প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র অশ্রদ্ধা নেই। তবে আমার দাবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সত্যেন বসু আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস’ নামে একটি ছাত্রাবাস তৈরি করা হোক, যাতে ‘বসু বিজ্ঞান গবেষণাগারের ছাত্ররা থাকার প্রাধান্য পাবেন।’

তিন. আমার মতে ‘বোস চেয়ার’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকীর্ণ রাজনীতির শিকার। নীল-সাদার খপ্পর থেকে এই চেয়ারের ছাড়া পাওয়ার কোনো উপায় দেখছি না আপাতত। পদার্থবিদ্যা বিভাগের চল্লিশোর্ধ্ব শিক্ষকের মধ্য থেকে আবশ্যই একজন রাম-রহিমকে পদটির জন্য পাওয়া যাবে, তবে গবেষণায় তাঁদের আন্তর্জাতিক পরিচিতি সম্পর্কে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে। কাজেই বর্তমান পরিস্থিতিতে পরামর্শ হলো: পদটি পূরণের জন্য উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই করা হোক। প্রার্থীর গুণাবলির মধ্যে থাকবে বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পদার্থবিদ্যার গবেষণায় তাঁর স্বীকৃত অবদান।

এটা করতে না পারলে বোস চেয়ারটি একটা ঠাট্টার বস্তুতে পরিণত হবে। এবং তা বসুর স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখানোর বদলে তা অশ্রদ্ধার পরিচায়ক হবে। প্রথম আলোয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক যেমনটি বলেছেন, আমরাও তেমনি মনে করি, বোস চেয়ারের শূন্যতা পূরণ করতে এখন সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।’ তবে ঘরপোড়া গরুর অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, বছর দুই আগে উপাচার্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতাবিরোধী এক ব্যক্তির নামে একটি বিভাগীয় পাঠাগার না জেনে প্রায় উদ্বোধন করেই ফেলেছিলেন। স্বাধীনতার পক্ষের একজনের ত্বরিত হস্তক্ষেপে সেটার আপাতত সমাপ্তি ঘটে! আশা করি, উপাচার্য ও সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে এমনি করে আবার কোনো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বোস চেয়ারে বসাবে না। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার পক্ষের ধ্বজাধারী নীল দলেও লুকিয়ে আছে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি!

চার. প্রায় প্রতিবছরই বাংলাদেশ পদার্থবিজ্ঞান সমিতি সফলতার সঙ্গেই তাদের বার্ষিক বিজ্ঞান সম্মেলন করে যাচ্ছে। সমিতির একজন আজীবন সদস্য হিসেবে আমার পরামর্শ থাকবে, এই বার্ষিক সম্মেলনে সত্যেন বসুর নাম কোনোভাবে সংযোজন করা যায় কি না। যদি যায়, তবে সম্মেলনের একটি আন্তর্জাতিক আবেদন থাকবে এবং এর একটি প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের পদার্থবিদ্যা তথা বিজ্ঞান গবেষণায়.

-prothom alo