ধর্মপাশার চামরদানী ইউনিয়নের বদলপুর গ্রামের ফুলবানু (৩৫)।  পাঁচ সন্তানের জননী। বড় মেয়েটি বিয়ের উপযুক্ত। অভাবের সংসার। ঠিক মতো তিন বেলা খাওয়াই যেন এক অনিশ্চিত বিষয়। তার উপর নিজেরই রুগ্নদশা।  তারপরও তিনি আবারো মা হতে যাচ্ছেন।  গর্ভের বয়স আট মাস চলছে।  দুঃখজনক হলেও সত্য, ৬ষ্ঠ বারের গর্ভের সময় ১বারের জন্যও তিনি গর্ভকালীন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান নি।  কোথায়, কার দ্বারা প্রসব হবে, সে বিষয়টিও তার দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাড়ায় নি।  নেই প্রসবের সময় জটিলতা হলে চিকিৎসার জন্য কোন আর্থিক সঞ্চয়।  পাঁচ সন্তান আর স্বামী নিয়ে ছোট্ট সংসার।  একটি কুঁড়ে ঘরেই চলে অভাবের সংসারের জীবনযাত্রার প্রতিটি প্রহর। শুকনো সময়েও কিছুটা যানবাহনহীন একটি গ্রাম।  পায়ে হেঁটে চালাতে হয় জীবন-জীবিকার নৈমিত্তিক কাজগুলো।  আর বর্ষায় নৌকা ছাড়া যোগাযোগ চিন্তাও করা যায় না।  আশে পাশে কোন বাজার-ঘাট বা নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশা করাও যেন আকাশ-কুসুম কল্পনা।  বর্ষায় গ্রামটি দেখতে যেন কিছুটা ছোট্ট একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো।  মাঝে মাঝে কিছু ঘর বাড়ি। তাছাড়া যে দিকেই তাকানো যায়, সেদিকেই শুধু অথৈ পানি আর পানি। তাতেও যেন এই সকল মানুষগুলোর ভ্রুক্ষেপ নেই।  এই বিরম্বনাকে মাথায় নিয়েই যেন চলছে ফুলবানু’র মা হওয়ার অনাগত দিনগুলো।  ক-দিন পরই প্রসব হবে ফুলবানু’র।

কিন্তু ফুলবানু ও তার পরিবারের লোকজনের চিন্তা, প্রসব ব্যাথা উঠার পর একজন ধাত্রীকে ডেকে আনলেই সমস্যার সমাধান ঘটবে। অনাগত সন্তানটিও অপরিকল্পিত পরিবার পরিকল্পনার ফল। সব মিলিয়ে যেন এক অজানা গন্তব্যের দিকে উদ্দেশ্যহীন যাত্রা। প্রসব পরিকল্পনা নিয়ে নেই ন্যূনতম চিন্তা, প্রস্তুতি, উৎকন্ঠা। সব দেখে শুনে যেন মনে হয়, এ সবই যেন হাওরের বিচিত্র প্রাকৃতিক পরিবেশের মতোই মানিয়ে নিয়েছে নিজেদের জীবনের সাথে। বিধাতার কাছে জীবন সঁপে দিয়েই যেন চলছে এ গতানুগতিক ভাবনাহীন পথে মা হওয়ার অন্তহীন জীবনধারা। এ চিত্র শুধু ফুলবানু’র একার নয়। হাওরাঞ্চলের দূর্গম পথগুলোয় এখনো অসংখ্য মা আধুনিক স্বাস্থ্য শিক্ষার ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত। মা ও শিশু স্বাস্থ্যের এ ভগ্নদশা মাথায় নিয়েই মা হচ্ছে ফুলবানু’র মতো অধিকাংশ অসংখ্য নারী। অধিকাংশ এলাকাতেই নেই পর্যাপ্ত পরিমাণে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী। আর যে স্বল্প সংখ্যক কর্মী আছে, তাদের নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন ও কর্মকান্ড নিয়েও রয়েছে বিস্তর অনুযোগ। ফলে তৃণমূল পর্যায়ের এসকল অঞ্চলের নারীদের প্রসবের ক্ষেত্রে প্রচলিত দাই বা ধাত্রীই একমাত্র ভরসা।

একাধিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, হাওরের বাসিন্দা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হতে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ৪৮টি উপজেলা হাওর অধ্যুষিত জনপদ হিসেবে স্বীকৃত। এসকল দাই বা ধাত্রীদের অধিকাংশের কোন প্রশিক্ষণ নেই। পারিবারিকভাবে দেখে দেখে রপ্ত করা ধাত্রী বিদ্যার জ্ঞান দিয়েই চলে আসছে প্রসবে সহায়তাকারীর কাজ। এ সকল দাইরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেদের উপস্থিত বুদ্ধি ও জ্ঞানকেই কাজে লাগিয়েই এ সংক্রান্ত জটিলতার মোকাবেলা বা উত্তরণ ঘটাতে চেষ্টা চালান।

অনেক ক্ষেত্রে ঐ দাই মহিলাও জানেন না, যে তাঁর একটু অজ্ঞতার কারণে একটা নারীর জীবনে কি পরিমাণ অপূরণীয় ক্ষতি হতে চলেছে। যার ভুক্তভোগী হয় ঐ প্রসূতি মা ও তার পরিবার। এক্ষেত্রে দায়ী কারণগুলো হলো তাদের অজ্ঞতা, অর্থনৈতিক দৈন্যতা, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। সর্বোপরি সামাজিক কুসংস্কার এ অঞ্চলের মায়েদের অনাকাঙ্খিত সমস্যায় ভোগার অন্যতম কারণ। ভৌগলিক অবস্থা আর আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় অধিকাংশ মানুষই গরিব। অনেকেই আবার শিক্ষার আলো থেকেও বঞ্চিত। সম্প্রতি বহু নির্দেশক গুচ্ছ জরিপ বা মাল্টিপল ইনডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১২-২০১৩ তে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে ধনী-গরিবের মধ্যে প্রকট সামাজিক বৈষম্যের চিত্র পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেও ধনীদের চেয়ে গরীবরা পিছিয়ে। এছাড়া তথ্য প্রাপ্তির উৎসগুলোর অসহজলভ্যতার কারণে গরীবদের মাঝে শিশু, প্রজনন স্বাস্থ্য সুবিধা ও তথ্য জানার প্রবণতা কম।

জাতিসংঘের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা কর্মসূচির এক তথ্যানুযায়ী, গর্ভাবস্থায় দরিদ্র নারীদের মাত্র ১৫ শতাংশ নারী দক্ষ ধাত্রী সেবা পান। ফলে দরিদ্র নারীদের মাঝে মৃত্যুহারও বেশী। সংশ্লিষ্ট সূত্রানুযায়ী, ৫৫ শতাংশ মায়ের ক্ষেত্রে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত হয়েছে। মোট প্রসবের ৬৮ ভাগ হয় বাড়ীতে। অবশিষ্ট ৩২ শতাংশ হয় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সেবা প্রদানকারীদের মাধ্যমে। আর হাওরাঞ্চলে এ হার মাত্র ১০ ভাগ। ৯০ ভাগ প্রসবই হয় বাড়ীতে এবং দাইয়ের হাতে।

সর্বোপরি, এ বিশাল সংখ্যক পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য সেবা বৈষম্যের মধ্যে রেখে কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন হাওরাঞ্চলগুলোতে সরকারি পর্যায়ের জরুরী প্রসূতি সেবা (ইওসি) সেবার মান ও সহজলভ্যতা বৃদ্ধি। শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমে যাতায়াতের জন্য নৌকা বা স্থানীয় যানবাহনের ব্যবস্থা রাখা। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ স্বাস্থ্য কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি। হত-দরিদ্র গর্ভবতী মায়েদের জন্য আর্থিক সহযোগিতা বৃদ্ধি। তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য কেন্দ্র সমূহে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্থানীয়দের অগ্রাধিকার, হাওর ভাতা, কমিউনিটি ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের স্থানীয় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি। স্বাস্থ্য বার্তা ও কর্মীর সেবা গ্রহণে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে স্থানীয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত প্রচার-প্রচারণাই পারে অবহেলিত এ জনপদের মা শিশুর অনাকাঙ্খিত মৃত্যুরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে।

তবে আশার কথা, ইতিমধ্যে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ স্বল্প পরিসরে এ ভগ্ন দশার উত্তরণে কিছু উল্লেখ্যযোগ্য কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

আশাকরি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য কর্মসূচীর কৌশলগত পরিকল্পনার ক্ষেত্রে উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে হাওরাঞ্চলের মায়েদের জীবনে অনাকাঙ্খিত দুর্ভোগ ও মৃত্যুরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

সুমিত বণিক – শিক্ষার্থী, জনস্বাস্থ্য বিভাগ
ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, ঢাকা।