burnযেকোন রাজনীতিক মান্যবরের স্বজনের অসুস্থ্যতায় বা স্বাভাবিক মৃত্যুতে সেই মৃতের নিথর মুখখানা দেখে তাদের ও তাদের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও শুভাকাঙ্খীরা অশ্রুস্বজল হয়ে পড়েন। আর এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে এসকল মানুষের মৃত্যুর পর শোকবার্তাসহ নানাবিধ সামাজিক-ধর্মীয় কর্মসূচী পালন করা হয়। অথচ এদেশের সাধারণ মানুষের নিরপরাধ সন্তান যখন জীবিকার তাগিদে কাজ করতে গিয়ে রাজনৈতিক সংহিসতার বলি হিসেবে পেট্রলবোমায় পুড়ে অঙ্গার হয়, তখন তো তথাকথিত সেই রাজনীতিকরা পুড়ে যাওয়া মানুষটির প্রতি শোক বা তার অসহায় পরিবারটির প্রতি কোন প্রকার সমবেদনা জানানোর সংস্কৃতি দেখা যায় না! হয়তো সাধারণ মানুষ বলেই আমাদের মতো মানুষের ভাগ্যে এতটুকু আশা করাও উচিত নয়। কারণ আমাদের নামের সাথে পরিচিতি হিসেবে উপাধি বা পদবী যাই বলি না কেন, ‘সাধারণ’ শব্দটিই হয়তো এর প্রমাণ বহন করে। আমি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের কর্মসূচি প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ নিয়ে সত্যিই সন্দিহান।

কত মানুষ পুড়ে ঝলসে ও অঙ্গার হচ্ছে, কিন্তু কর্মসূচি প্রণেতাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই বললেই চলে। বর্তমান সময়ে যেকোন মধ্যবিত্ত মানুষকেও জীবনের নানা টানাপোড়নে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হয়। সেখানে একজন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবন মানেই এক সংগ্রাম। তার দৈনন্দিন সংগ্রামী কর্মতৎপরতার উপরই নির্ভর করে তার ও তার পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষণ। আর সেই কর্তা ব্যক্তিটিই যদি রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে, তখন সেই পরিবার ও পরিবারের মানুষগুলোর কি বেহাল দশা হয়, তা ভাবলে চোখের কোণে শুধু জলই এসে যায়। পেট্রলবোমায় দগ্ধদের মধ্যে যারা সুস্থ হয়ে ওঠবেন, তাদের অনেকেই আর স্বাভাবিক কর্মজীবনে ফিরতে পারবে না। বিশেষ করে যাদের শরীরে এক বা একাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এ ঝুঁকি খুব বেশি। এ ধরণের রোগী শারীরিকভাবে সুস্থ্য হয়ে ওঠার পরও দীর্ঘসময় মানসিক সমস্যায় ভোগার সম্ভাবনা খুব বেশি। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের মতে, পেট্রলবোমায় দগ্ধরা ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার কারণে, তাদের মধ্যে সাইকোলজিক্যাল ট্রমা সৃষ্টি হওযার সম্ভাবনা খুব বেশি।

সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক তথ্যানুযায়ী, ঢামেক হাসপাতালের বার্ণ ইউনিট থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ৮৭জন, চিকিৎসাধীন আছেন ৪৬জন, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ৬জন এবং আশঙ্কাজনক অবস্থায় ১৩জন।

গণতান্ত্রিক নিয়মে হরতাল-অবরোধের প্রায়োগিক চর্চার সংস্কৃতি থাকলেও বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এর চরম অপব্যবহারের মাধ্যমে নাগরিক জীবনে দুর্বিষহ অশান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কর্ণধারদের একঘেয়েমি স্বভাবের দায় বয়ে বেড়াচ্ছে সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের দোহাই নিয়ে রাজনীতির বড় বড় বুলি ছাড়লেও, সাধারণ মানুষের জীবনে যে চলমান এ কর্মসূচি একধরণের বিপর্যয় ডেকে আনছে, তা তারা বুঝেও না বোঝার ভান করে বসে আছেন। এমনকি শিক্ষাজীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এসএসসি পরীক্ষা উপলক্ষ্যেও তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির নমনীয়তা লক্ষ্য করা যায় নি।

হায়রে আমাদের রাজনৈতিক কর্ণধার! সহিংসতার আগুনে ঝলসে ও পুড়ে যাওয়া মানুষের যন্ত্রণায় হাহাকার আর করুণ আর্তনাদও তাদের কর্মসূচির শিথিলতা আনতে সমর্থ হয়নি।
এদিকে দগ্ধ ও পুড়ে যাওয়ার পর নিহত স্বজনরা নিঃস্ব হয়ে কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলও শুকিয়ে যাচ্ছে। তবুও বোধোদয় ঘটছে না আমাদের কথিত নীতি-নির্ধারকদের! আমরা এটতাই ক্ষমতান্ধ হয়ে গেলাম? সাধারণ মানুষের জীবনে আর কতটুকু বিপন্নতা আসলে আমাদের রাজনীতিকদের বোধোদয় বা অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে? এতটা পাষাণ আর অমানবিকতা আমাদের মানসিকতায় ভর করেছে? ভাবলে নিজেদের মানুষ ভাবতে কষ্ট হয়। আমাদের রাজনৈতিক মান্যবরগণ বংশ পরম্পরায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতি নামক খেলায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঠিক। কিন্তু আপনারাও তো মানুষ। আপনারা নিজেরাও তো অমরত্ব নিয়ে জন্মাননি। হয়তো সেদিন দূরে নয়, যেদিন সময়ের আবর্তে আপনারা থাকবেন না, কিন্তু মানুষ আপনাদের কৃতকর্মের কথা ভেবে ঘৃণায় থুথু ফেলবে।

দয়াকরে দেশের চেতনা কে পূঁজি করে নিজেদের পারস্পারিক সমঝোতা আর ক্ষমতা দখলের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনে এই অস্থিতিশীলতা আর পুড়িয়ে মারার রাজনীতি বন্ধ করুন।

সুমিত বণিক, উন্নয়নকর্মী, কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ।