এই বালিকা সাধারণ কোনো জীবিত বালিকাও নয়। ৫০০ বছর আগে মারা যাওয়া পেরুর বিস্ময়কর ইনকা সম্প্রদায়ের ১৫ বছর বয়সী বালিকা ‘ল্য দোঞ্চেলা’।

এতোকাল আগের বালিকাকে এ রকম জীবন্ত মনে হওয়া অস্বাভাবিক ব্যাপার বটে, কিন্তু কীভাবে সম্ভব? ইতিহাস বলছে, শিশু-কিশোরদেরকে সৃষ্টিকর্তাদের উদ্দেশে বলি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল ইনকাদের। তারপর মারা যাওয়া শিশুদের স্রষ্টারই সম্মানে মমি করে রাখা হতো।

অনুসন্ধিত্সু মানুষ পৃথিবীর অদ্ভুতুড়ে রহস্যময় ঘটনাগুলোর কোনোটিই কখনো ছাড় দেয়নি। রহস্য যতই গভীর হয়েছে, মানুষ ততই আগ্রহী হয়েছে রহস্য সমাধানে। যতই জটিল আর ভয়ংকর হয়, ততই মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে। যেমন পেরুর বিখ্যাত ইনকা সভ্যতার বিশাল রত্ন ভান্ডার! কোথায় লুকিয়ে আছে এই সাত রাজার ধন! এ প্রশ্নের উত্তর নেই।

যুগের পর যুগ ধরে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা আমেরিকার এই প্রাচীন সমৃদ্ধ সভ্যতার খোঁজ করে গেছেন। বিধ্বংসী স্প্যানিশ অভিযাত্রীরা বারবার আঘাত হেনেছিল ইনকাদের প্রাচুর্যে। তারা লুট করেছে, হত্যা করেছে, আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে ইনকা সভ্যতায় সমৃদ্ধ শহরগুলো। সে জন্যই বিশেষজ্ঞদের হাতে খুব অল্প প্রমাণাদি ও তথ্য এসে পৌঁছায়। ১৫২৭ সালে এক মহামারি ইনকা সভ্যতায় কালো মেঘের ছায়া বয়ে আনে। মারা যান রাজা ও তাঁর উত্তরসূরি ছেলে। রাজার অন্য দুই ছেলের মধ্যে সিংহাসনের

পিজারো নামমাত্র রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসান অ্যাটাহুয়ালপার শত্রু মানকোকে। নতুন রাজা অবশ্য কখনোই রাজার সন্মান পাননি। তাই প্রতিহিংসায় মেতে ওঠে মানকো। ইনকা রাজার সোনার মূর্তি এনে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ভিলকাবাম্বা শহরের পাহাড়ে হারিয়ে যান মানকো ও তার শক্তিশালী সেনারা। এরপর বহু বছর ধরে মানকো ও তাঁর ছেলেদের সঙ্গে ইনকা সভ্যতার সিংহাসন জয় নিয়ে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলতে থাকে স্প্যানিশ যোদ্ধাদের। এর মধ্যে কারও পক্ষেই আর সেই লড়াইয়ে দেশে দেখা দেয় রক্তাক্ত এক গৃহযুদ্ধ। জিতে যান অ্যাটাহুয়ালপা। সুখ অবশ্য তাঁর কপালে জোটেনি। তাঁকে ১৫৩২ সালে স্প্যানিশ যোদ্ধা ফ্রান্সিস পিজারো হারিয়ে দেন।

ভিলকাবাম্বা কিংবা ভিটেকাস নামের শহর দুটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। স্প্যানিশ কলোনির মানচিত্রেও শহর দুটির উল্লেখ নেই। কিন্তু এর মাঝেই লুকিয়ে আছে ইনকা সভ্যতার বিশাল রত্ন-ভান্ডার। ইনকার শেষ রাজা এ শহরেই পুঁতে রেখেছেন অমূল্য ধনসম্পদ। ১৭৬৮  ধারণা করা হয়, আপুরিমাক নদীর অববাহিকায় চোককেকিরোই প্রাচীন ভিলকাবাম্বা শহরটি। এ খবর নিয়ে আমেরিকান বিশেষজ্ঞ বিংহাম খোঁজ শুরু করেন ১৯০৯ সালে।

বর্তমান পেরুর কোস্কো এলাকায় সুপ্রাচীন ইনকা সভ্যতার সূচনা হয়েছিল একটি উপজাতি হিসাবে। পৃথিবীর দীর্ঘতম পর্বতমালা হল দক্ষিন আমেরিকা আন্দিজ

ইনকা সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একটি দৃঢ় অর্থনৈতীক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ছিল। এই এন্দীজ সভ্যতায় টাকার প্রচলন ছিল এবং ভোগ্যপন্য ও বিলাসপন্যের ব্যাবসা বানিজ্য বিস্তৃতি লাভ করেছিল। এই সভ্যতায় কর ব্যাবস্থার প্রচলন ছিল। বলা হয়ে থাকে যে কর উত্তোলোকরা বিভিন্ন পশু, বৃদ্ধ বা দাশের বলি উৎসর্গ হিসেবে গ্রহন করত।পর্বতমলা। এই পার্বতয ভূভাগে পরষ্পর সম্পর্কযুক্ত কয়েকটি প্রাচীন সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছিল। সম্মিলিতভাবে এসব সভ্যতাকে মূলত এন্দীয় সভ্যতা বলা হয়। দ্বাদশ শতাব্দিতে মধ্য আমেরিকা থেকে আগত একদল ভাগ্যান্বেষি পেরুর কুজকো (Cuzko) উপত্যাকায় এসে বসবাস শুরু করে। আগত এই জনগোষ্ঠির মধ্যে ছিল কৃষক, কারিগড়, কামার ইত্যাদি। স্থানীয় লোকেদের পরাভূত করে হাতুন তামাক নামক এক সাহসী যোদ্ধা ১৩৯০ সালের দিকে কুজকো উপত্যাকায় একটি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। রাজত্বের নাম হয় ইনকা এবং রাজা তাপাক নিজেকে ভিরাকোচা ইনকা (জনগণের ইশ্বর) নামে ভূষিত করেন। বলা যেতে পার ইনকা সভ্যতার সূচনা কিছুটা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে হয়েছিল।

‘ল্য দোঞ্চেলা’ নামের এই বালিকার মমিটিকে ১৯৯৯ সালে বিস্ময়কর মাচুপিচু নগরীর লুলাইকো আগ্নেয়গিরির ৬,৭৩৯ মিটার (২২,১১০ ফুট) উঁচুতে আবিষ্কার করেন একজন আর্জেন্টাইন-পেরুভিয়ান অভিযাত্রী।

বিজ্ঞানী ও গবেষকরা বলেন,

ল্য দোঞ্চেলার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এখনও অক্ষত রয়ে গেছে এবং মনে হচ্ছে সে কেবল কয়েকসপ্তাহ আগে মারা গেছে। তার অক্ষত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে কোনো ঔষুধ বা নেশা জাতীয় দ্রব্য খাইয়ে ‍তাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে, চুল পরীক্ষা করেই তার মৃত্যুর সময় নির্ণয় করেন গবেষকরা।

ইতিহাস মতে, সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে বলি দেওয়া শিশুদের হত্যার আগে সুষম খাবার খাইয়ে মোটা-তাজা করা হতো এবং সমাধিস্থলে পৌঁছানোর আগে শিশুদের ভীতি ও ব্যথা নাশক উন্মাদক পানীয় পান করানো হতো, তারপর তাদের হত্যা করা হতো।
গবেষকরা বলেন, সাম্রাজ্যবাদে বিশ্বাসী ইনকারা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ধর্মবিশ্বাসের আড়ালে অপেক্ষাকৃত নিম্নশ্রেণীর সন্তানদের প্রতি এ ধরনের নির্মম আচরণ করতো।

ইনকা সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র সিলুসতানি এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা ৪৪টি শিশুর দেহাবশেষ আবিষ্কার করেছেন তারা। ধারণা করা হচ্ছে, এই শিশুদের এখন থেকে ৬০০-৭০০ বছর আগে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার জন্য হত্যা করে এখানে সংরৰণ করা হয়। মরদেহ সংরৰণের জন্য নির্মিত একটি সত্দমে্ভর মধ্যে পাথরের খাঁজে রাখা বাক্সে দেহগুলো জোড়ায় জোড়ায় রাখা ছিল। উদ্ধার করা দেহাবশেষগুলোর মধ্যে নবজাতক থেকে তিন বছর বয়সী শিশু রয়েছে বলে জানান গবেষকরা।

গবেষকরা বলেন, দেহাবশেষগুলো কলস্না সভ্যতার নিদর্শন। এই সভ্যতার শাসকরা আনুমানিক ১২০০ থেকে ১৪৫০ সাল পর্যনত্দ পেরম্নর দৰিণের পুনো অঞ্চলের কিছু এলাকা শাসন করত। দেহাবশেষগুলোর চারপাশ উৎসর্গীকৃত বিভিন্ন সামগ্রী যেমন পশু, খদ্যোসামগ্রী এবং থালাবাসন দিয়ে সাজানো ছিল বলে জানিয়েছেন পুরাতাত্তি্বক দলের সদস্য এদোয়াদরাউা আরিসাকা। এছাড়া দেহাবশেষগুলোর পাশ থেকে যদু্ধের বিভিন্ন চিত্র আঁকা চীনামাটির ফলক পাওয়া গেছে। এ থেকে গবেষকরা ধারণা করছেন, এই শিশুদের কলস্না সভ্যতার সঙ্গে অন্য প্রতি্দ্বন্দীদের যদু্ধ চলাকালীন দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হত। শিশুদের এই দেহাবশেষগুলো চুলপা লাগেরতো নামের ১০ মিটার উচ্চতার একটি বৃত্তাকার সত্দমে্ভর পাশ থেকে উদ্ধার করা হয়। রাজধানী লিমা থেকে ১৩০০ কিলোমিটার দৰিণ-পূবরাউ সিলুসত্দানির ওই সত্দমে্ভর নিকটে আরও ২০০ মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে।

সুত্রঃ ইন্টারনেট