আমাদের অধিকাংশ শারিরিক সমস্যা লাইফ স্টাইলের ত্রুটির কারনে সৃষ্ট। সেই অভ্যাসগুলো বদলালে অনেক গুলোই ঠিক হয়ে যায়; আর কিছু যোগ ব্যায়াম করলে আরো ভালো থাকা সম্ভব। সনাতন ভারতিয় এই স্বাস্থ বিদ্যার প্রয়োজনিয়তা এখনকার শহুরে ঘর বন্দি মানুষের জন্য আরো বেড়েছে। আজকাল কর্মব্যাস্ততা আর নানান সিমাবদ্ধতায় দৈনন্দিন অনেক কাজও বাদ থেকে যায়; সেখানে ইয়োগা করার সময় কোথায়! আবার সময় বের করতে পারলেও শেষমেষ আগ্রহ ধরে রাখা সম্ভব হয়না। তাই এমন ইয়োগা করতে হবে, যেগুলোর জন্য আলাদা আয়োজন দরকার হবে না। মানে আমাদের গোসল, খাওয়া, শোয়া, লেখা পড়ার মতো অপরিহার্য্য কাজের ভঙ্গি বা পদ্ধতির সাথে ট্যাগ্ড। মনেই হবে না এগুলো ইয়োগা, বরং ভালো অভ্যাসে পরিনত হয়ে যাবে।

১) জোরে স্বাস-প্রস্বাস : স্রেফ জোরে জোরে নাক দিয়ে স্বাস নিন আর মুখ দিয়ে ছাড়ুন। একবারে যে ক’বার আর সারা দিনে যে ক’বার ভালো লাগে করুন। এতে ফুসফুসে বাতাস বেশি ঢুকবে; ফুসফুস আবার রক্তে অক্সিজেনও বেশি সরবরাহ করে। আমাদের মস্তিষ্কেও আক্সিজেন সরবরাহ বেড়ে যায়; তাতে মাথা ব্যাথা থাকলে সেরে যায়। আক্সিজেনের ঘাটতি জনিত এই মাথা ব্যাথাকে অনেকেই মাইগ্রেনের পেইন মনে করে ভুল করেন। এছাড়া এতে করে কোলেস্টেরল সহ রক্তের বর্জ্য পরিশোধনে ফুসফুসের কার্যকারিতা বাড়ে। পরিশুদ্ধ রক্ত আবার পাম্প করা হার্টের জন্যও সহজ হয়। তাই এই প্রানায়নটি হার্টের জন্যও বিশেষ উপকারি। আমরা সাধারনত যে ভাবে ব্রিদ করি তাতে রক্তে অক্সিজেন ঘাটতি থেকেই যায়। ফুসফুস আর হার্টেও কোন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় না। তাই কখনো ছোট ছোট স্বাস নিন, কখনও লম্বা টানা নিন। কখনও বুক ফুলিয়ে নিন, কখনও পেট ফুলিয়ে স্বাস নিন। বৈচিত্রময় এসব ভঙ্গিতে ব্রিদ করলে দেখবেন আপনার হার্টবিট বেড়ে যাবে; আর এটাই এই ইয়োগাটির কার্যকারিতার প্রমান। এজন্য এই প্রানায়নটি করলে রক্ত ঠিক মতো পরিশোধিত হয়ে আমাদের শরির থাকবে রোগ মুক্ত সুস্থ-সবল ।

২) ঘুমের আগে-পরে শবাসন: আলাদা করে কোন যোগাসন করাই আমাদের হয়ে ওঠে না। কিন্তু ঘুমানোর আগে এবং ঘুম থেকে জেগে বিছানায় শবাসন করা কোন ব্যাপারই না; শুধু মনে থাকলেই হলো। স্রেফ বিছানায় শুয়ে আপনি মাথার নিচ থেকে বালিশটা সরিয়ে দিয়ে, হাত-পা ছড়িয়ে সটান মৃতের মত রিল্যাক্স মোডে শুয়ে থাকুন। যতক্ষন ভালো লাগে থাকুন, তার পরে বালিশটা মাথার নিচে দিয়ে ঘুমিয়ে পরুন। আবার ঘুম থেকে উঠে মাথার বালিশটা সরিয়ে দিয়ে আসনটি করুন, তার পরে উঠে পরুন। ব্যাস এই আসনের কারনে মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ হয়ে আপনার ঘুমটাও ভালো হবে আর দিনের শুরুটাও ভালো হবে। কারন বালিশে মাথা রেখে চিত হয়ে ঘুমানোর সময় আমাদের ঘাড়টা একটু বেন্ড হয়ে মাথায় রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটায়। সেজন্য বালিশে মাথা রেখে শুধু কাত হয়ে ঘুমান; চিত হয়ে ঘুমানোর সময় বালিশ যথাসম্ভব এভয়েড করুন। সাধারন মনে হলেও এই আসনটা বিশেষত কর্মক্লান্তদের জন্য দারুন হিলিং।

৩) দাড়িয়ে খাওয়া: খাবার সময় মেরুদন্ড সোজা করে বসা উচিত; এতে পরিপাক তন্ত্রও সোজা থাকে। কিন্তু আমরা বসে খেলে সেটা মনে রাখতে পারি না, সামনের দিকে একটু ঝুকে যাই। দাড়িয়ে খেলে আমাদের মেরুদন্ড এমনিতেই সটান থাকে; হজম ভালো হয় আর স্টমাকের কার্যক্ষমতা বাড়ে। তাই দিনে অন্তত এক বেলা বুফে স্টাইলে খাবার অভ্যাস করা উচিত। এটাও আমাদের ঘর কুনো-বসে থাকা জিবনের জন্য খুবই উপকারি একটা অভ্যাস ।

৪) দাড়িয়ে কাজ করা: কয়েকশ বছর আগেও আমাদের চেয়ার-কেদারার তেমন প্রচলন ছিলোনা; দিনের অনেকটা সময় মানুষ দাড়িয়েই থাকতো। আর কয়েক দশক আগেও বেশিরভাগ মানুষের দাড়িয়েই কাজ করতে হতো। যাদের বসে কাজ করার সুযোগ ছিলো, তাদেরও হাটাহাটি হতো যথেষ্ট। এই অল্প সময়ে মানুষের মেরুদন্ড এতোটা সময় বসে থাকার মতো অভিযোজিত হয় নি। যে জন্য, স্পাইনাল কডের শেষপ্রান্তের অসহ্য ব্যাথা, মহামারির মতো বিমারি হয়ে দাড়িয়েছে; বিশেষত ঘরে-আফিসে বসে থাকাদের ক্ষেত্রে। তাই লেখা পড়া করুন দাড়িয়ে, কম্পিটার চালান দাড়িয়ে। এজন্য টেবিলটা উচু করে নিন। অথবা উচু কাবার্ড, চেষ্ট অব ড্রয়ার্স এমনকি উচ্চতায় ঠিক হলে ফ্রিজও ব্যাবহার করতে পারেন। সিস্টেম করে নিলে অফিসেও দাড়িয়ে কাজ করতে পারেন; এমনকি মিটিংও। বিশেষ করে যারা কম্পিউটারে বসে থাকেন, তাদের জন্য এটা খুবই কার্যকর। কষ্টকর মনে হলেও আসলে এটা একদম সহজ; ২/১ দিনেই অভ্যাস হয়ে যায়। বেশিক্ষন হলে পা একটু টনটন করে ঠিকই; কিন্তু কিছুক্ষন পরপর একটু বসে নিলেই হয়। মেরুদন্ডের অধিকাংশ রোগ নিরাময়ে এই দাড়িয়ে থাকাটা অব্যার্থ একটা সমাধান।

৫) শোয়া অবস্থায় প্রানায়ন: বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে মাথাটা একটু পেছনে টেনে, থুতনিটা যতটা পারেন উচিয়ে রাখুন। সুবিধা হলে মাথার নিচে বালিশ দিয়ে নিন; যতক্ষন ভালো লাগে আসনটি করুন। সাভাবিক অবস্থায় আমাদের গলাটা সবসময় সামনের দিকে একটু ভাজ হয়ে থাকায়, স্বাস নালিটা আধ খোলা পানির ট্যাপের মতো হয়ে থাকে। ফলে ফুসফুসে বাতাসও কম ঢোকে। কিন্তু গলাটা এভাবে সোজা করলে, স্বাস নালি দিয়ে বাতাস কোন বাধা ছাড়াই সটান বুকে ঢুকতে পারে। অল্প সময় এভাবে থাকলেই দেখবেন আপনার পাল্স বেড়ে যাবে; আর তখনই বুঝবেন ইয়োগাটি আপনার কাজে লাগছে। এছাড়া এতে মাথায় রক্ত সরবরাহ বেড়ে স্নায়ুতন্ত্রও সতেজ হয়। ফুসফুসে পর্যাপ্ত বাতাস সরবরাহ না হবার জন্যই আমরা অনেক শারিরিক জটিলতায় আক্রান্ত হই। তাই ঘুমাবার আগে বা ঘুম ভেঙে অথবা রাতে এভাবেই ঘুমাবার অভ্যেস করুন; ফুসফুস-হার্ট থাকবে সুস্থ-সবল আর শরির থাকবে রোগ মুক্ত।

৬) কোল বালিশ-পায়ের বালিশ: কোল বালিশে হাটু রেখে কাত হয়ে অনেক্ষন শুয়ে থাকা যায়। নইলে চিত অথবা উপুর, এই ২ ভঙ্গিতে শুয়েই রাত পার করতে হয়। উপুর হয়ে শোয়া হার্ট এবং লাঙ্সের জন্য ভালো নয়। আর দির্ঘ রাতটা আমরা ঘুমিয়ে কাটাই বলে, বিভিন্ন ভঙ্গিতে শোয়া ভালো। তাই কোল বালিশ নিয়ে শোয়া স্বাস্থকর। কোল বালিশটাই অথবা পায়ের নিচে দেবার জন্য আরেকটা বালিশ লাগবে। চিত হয়ে শুয়ে এটা পায়ের নিচে রেখে পাটাকে একটু উচু করে রাখতে হবে । যতক্ষন আরাম বোধ হয়, ততক্ষন রাখলেই হবে। এতে পায়ের দিকের রক্ত শরিরের মধ্যভাগে এগিয়ে আসে; যা হার্টের পাম্পিঙের জন্য খুব সহায়ক। যাদের শরিরে রক্তসল্পতা বা লো প্রেশার আছে আর যারা অনেক সময় দাড়িয়ে থাকেন তাদের জন্য এটা দারুন হিলিং। এটাকে নিছক বালিশ প্রিয়তা মনে করে ভুল করবেন না। কারন আসলে ক্ষতিকর আরাম প্রিয়তা হলো নরম তোষক, জাজিম বা ম্যাট্রেস।

৭) গোসল থেরাপি: শুধু পানি ঢেলে গা পরিষ্কার করার জন্য নয়, গোসলকে থেরাপি হিসেবে নিন। গোসলের সময় যতক্ষন ভালো লাগে পেটে ঠান্ডা পানি ঢালুন। পয়েন্টিং শাওয়ার হলে নাভিতে এবং চারপাশে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পানির আঘাত দিন। পেটের পিড়ায় আর হজম শক্তি বৃদ্ধিতে এর কার্যকারিতা অব্যর্থ। এছাড়া ঘাড়ে, থুতনি উচু করে গলায়, মাথার তালুতেও দিন। সেলুনে ঘার-মাথা ম্যাসাজ করলে যেমন লাগে, ঠিক সেরকম লাগবে। যদি শরিরের অন্য কোথায়ও কোন অস্বস্তি বা ব্যাথা থাকে তাহলে সেখানেও এভাবে শাওয়ার প্রেশার দিন। এটাও দারুন এক হিলিং থেরাপি; কিন্তু এ জন্য সময় করে ম্যাসাজ পার্লারে যেতে হবে না।

৮) চোখে-মুখে পানির ঝাপটা: চোখের সমস্যা আছে অথবা যারা বেশি পড়েন, টিভি দেখেন বা কম্পিউটার চালান, তাদের জন্য এটা খুবই দরকারি থেরাপি।যে কোন কারনেই টয়লেটে গেলে, চোখে-মুখে একটু পানির ঝাপটা দিন। এমন ভাবে দিন, যাতে ঠান্ডা পানিটা চোখের ভেতরে ভালো ভাবে লাগে। টয়লেটে না চাপলেও কিছুক্ষন পর পর মনে করে একটু দিন; ব্যাস যতই প্রেশার পরুক চোখের কোন সমস্যা হবে না। আবার স্বাভাবিক তাপেও ঘেমে আমাদের অস্বস্তি বেড়ে যায়; তাই ঘাড় আর গলাটাও ঠান্ডা পানি দিয়ে একটু ধুয়ে নিলে ভালো লাগবে। এই সামান্য থেরাপেটিক স্বাচ্ছন্দ টুকুই আপনার চোখ-ঘাড়-মাথার সাধারন জটিলতাগুলো দুর করবে।

১ আর ৫ এর প্রানায়ন ২টো দারুন এ্যান্টি এজিং। নিয়মিত করলে, আকালে চুল দাড়ি পাকা বন্ধ হয়ে যায়। তবে কোন ধরনের এক্সারসাইজই একটানা করলে, সেটার কার্যকারিতা আর থাকে না। এক্সারসাইজ ততক্ষন কাজে লাগে, যতক্ষন তাতে বৈচিত্র থাকে। এমন কি ওষুধ-পথ্যের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। আর এই ইয়োগা গুলো করলে আবশ্যই আপনার শরিরে ইতিবাচক কোন না কোন পরিবর্তন টের পাবেন। তাই যতদিন এ গুলোর কার্যকারিতা ফিল করেন, ততদিন করুন। তার পরে ব্রেক দিন; কিছু দিন পরে আবার করুন। এভাবে বৈচিত্র বজায় রেখে করলে এসব প্র্যাক্টিস আমাদের সুস্থ-সতেজ রাখবে আজীবন।