‘গভীর রাতে প্রায়ই সেতুর কাছ থেকে বড় ধরনের শব্দ পাওয়া যায়। বোঝা যায়, উপর থাইক্কা ভারী কিছু ফেলা হইছে। কয়েক দিন পর কাছাকাছি কোনো জায়গায় লাশ ভাইসা উঠে। চোখের সামনে অনেক লাশ ভাইসাও যায়।’ কথাগুলো বলছিলেন মেঘনা নদীতে নিয়মিত মাছ শিকার করা ভৈরবের জেলে অশোক বর্মণ। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সড়ক সেতুসংলগ্ন এলাকায় তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি একা নন, এই সেতুসংলগ্ন কিশোরগঞ্জের ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ও নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার জলসীমার এক কিলোমিটারের মধ্যে মাছ শিকার করেন বেশ কয়েকজন জেলে। রাতে মাছ ধরার সময় তাঁরা সেতুর কাছ থেকে প্রায়ই বড় ধরনের শব্দ পান বলে জানিয়েছেন। গত ১০ মাসে এই জলসীমা থেকে ১০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। অনেক লাশ ভেসে গেছে।

উদ্ধার হওয়া লাশের অধিকাংশেরই হাত-পা ও চোখ বাঁধা অবস্থায় ছিল। এলাকাবাসীর ধারণা, দেশের বিভিন্ন স্থানে গুম হওয়া মানুষের মৃতদেহ গভীর রাতে মাইক্রোবাসে করে এনে সেতুর ওপর থেকে নদীতে ফেলা হচ্ছে। একই ধারণা পুলিশ প্রশাসনেরও। জানতে চাইলে ভৈরব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহজাহান কবির বলেন, মাইক্রোবাস থেকে বস্তায় ভরে লাশ নদীতে ফেলা হচ্ছে—ফোনে অনেকেই এমন তথ্য জানান। পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের আটক করা সম্ভব হয় না। তা ছাড়া, মেঘনা নদী খরস্রোতা ও গভীর। এ কারণে কী ফেলা হয়েছে, তা অনুসন্ধান করা কঠিন। তবে এ ধরনের খবর পাওয়ার কিছুদিন পরই সেতুর কাছাকাছি কোথাও না কোথাও লাশ ভেসে ওঠে।

ভৈরব থানা সূত্রে জানা গেছে, এই থানার পুলিশ গত সাত মাসে চারটি লাশ উদ্ধার করেছে। এসব লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে খুনের আলামত পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ১১ এপ্রিল একটি লাশ উদ্ধার করা হয়। বস্তার মধ্যে পাথরসহ লাশটি বেঁধে নদীতে ফেলা হয়েছিল। এ ছাড়া উদ্ধার হওয়া অন্য লাশের কপালে গুলি ও আঘাতের চিহ্ন ছিল। আশুগঞ্জ থানা সূত্রে জানা গেছে, একই সময়ের ব্যবধানে তাদের জলসীমা থেকে চারটি লাশ উদ্ধার করা হয়। বিষয়টিকে রহস্যজনক উল্লেখ করে আশুগঞ্জ থানার ওসি আবদুল কাদির বলেন, পচন ধরার কারণে লাশগুলো সম্পর্কে অনেক কিছু বোঝা যায় না। তবে লাশগুলো যে অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে, তাতে ধারণা করা যায় যে হত্যার পর এগুলো নদীতে ফেলা হয়েছে। ভৈরব থানার এক কিলোমিটার ব্যবধানে রায়পুরা থানাধীন জলসীমার শুরু। তাদের জলসীমা থেকে গত বছরের ১৩ আগস্ট এক দিনে দুটি লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই দুটি মৃতদেহে গুলির চিহ্ন ছিল। রায়পুরা থানার সাবেক ওসি আবদুল বাতেন বলেন, ‘আমাদের জলসীমায় পাওয়া লাশের পরিচয় পাওয়া যায়নি। আমাদের ধারণা, হত্যার পর লাশগুলো নদীতে ফেলা হয়েছে।’  ভৈরব থানার ওসি শাহজাহান কবির বলেন, মেঘনায় ভেসে ওঠা লাশ নিয়ে পুলিশ উদ্বিগ্ন। খুন হওয়া লাশ কেন সেতুসংলগ্ন নদীতে পাওয়া যাচ্ছে, এটি ভাবনার বিষয়। তিনি বলেন, সেতুটির নিরাপত্তায় আলাদা পুলিশ রয়েছে। এখন সেতুতে পাহারা আরও জোরদার করা হয়েছে।

জলসীমা নিয়ে পাঁচ থানার ঠেলাঠেলি: সেতুর তিন কিলোমিটারের মধ্যে পাঁচ থানার জলসীমা। কিশোরগঞ্জের ভৈরব, বাজিতপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ, সরাইল ও নরসিংদীর রায়পুরা থানা। লাশ ভেসে উঠলে বা অন্য কোনো অপরাধ ঘটলে পুলিশ এর দায় কৌশলে এড়িয়ে যায় অন্য থানার ওপর চাপিয়ে দিয়ে। এ কারণে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। তাই অপরাধ সংঘটনের স্থান হিসেবে অপরাধীরা পাঁচ থানার সঙ্গে সংযুক্ত এলাকাগুলোকে বেছে নিচ্ছে।  গত বছরের ১৩ জুলাই ভেসে আসা দুটি লাশের দায়িত্ব নেওয়া নিয়ে তিন থানার পুলিশের ঠেলাঠেলি সবার নজর কাড়ে। দুই দিন ভেসে থাকার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে লাশটি উদ্ধারসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এই ঠেলাঠেলি নিয়ে গত বছরের ১৫ জুলাই প্রথম আলোয় ‘ভাসে লাশ, ডোবে মানবতা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

লিখেছেনঃ সুমন মোল্লা, ভৈরব