বাঙালীর সাংস্কৃতিক ইতিহাস হাজার বছরের। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাকে শাসন করেছেন দেশী-বিদেশী অনেক শাসক। তখন নিজেদের প্রয়োজনেই তাঁরা গড়েছেন অনেক নির্দশন। সময়ের ধারায় যা আজ প্রত্নসম্পদে পরিণত হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, কারুকাজ খচিত দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকাসহ আরও কত কি। শত শত বছর আগে গড়ে ওঠা এমনই অনেক নিদর্শন এখনও কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে বাংলায়। তবে সংস্কারের অভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে অনেক প্রত্নসম্পদ। তার মধ্যে কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রামের কুতুব শাহ মসজিদ অন্যতম। শীঘ্র এর সংস্কার করা না হলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে প্রায় সাড়ে চার শ’ বছরের পুরনো এই মসজিদটি। দেশের প্রত্নসম্পদের তালিকা থেকে হারিয়ে যাবে আরও একটি নিদর্শন।

বাংলার স্থাপত্যের এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন অষ্টগ্রামের পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট কুতুব শাহ মসজিদ। উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে একটি বৃহৎ দীঘির পাড়ে এখনও দণ্ডায়মান এ মসজিদটি। কিশোরগঞ্জের এ অঞ্চলেরই এক কামেল দরবেশ কুতুব শাহর নামানুসারে হয়েছে এই মসজিদটির নামকরণ। মসজিদের পশ্চিম পাশেই রয়েছে কুতুব শাহর সমাধি।

অধ্যাপক হাবিবা খাতুন ও শাহনাজ হুসনে জাহানের লেখা ‘ঈসা খাঁ : সমকালীন ইতিহাস’ বই থেকে জানা যায়_সাধারণত এ ধরনের মসজিদ তিন গম্বুজবিশিষ্ট হয়। যেখানে মধ্যবর্তী গম্বুজের উভয় পাশে একটি করে তুলনামূলক ৰুদ্রাকৃতির গম্বুজ থাকে। কিন্তু এ মসজিদের স্থাপত্য নিদর্শনে ভিন্ন ধরণের বিন্যাস পরিলৰিত হয়েছে। বৃহদাকৃতির একটি কেন্দ্রীয় গম্বুজের চার কোণে চারটি ৰুদ্র গম্বুজ স্থাপিত হয়েছে। ফলে গম্বুজের উল্লিখিত বিন্যাস মসজিদের অভ্যন্তরভাগকে অসম তিনটি অংশে বিভক্ত করেছে। এর মধ্যবর্তী অংশটির পরিমাপ ১৬ ফুট ১৬ ফুট এবং এর দুই পাশে রয়েছে ২ ফুট মার্জিন এলাকা। আর পার্শবর্তী অংশদ্বয়ের পরিমাপ ৮ ফুট ১৬ ফুট। মসজিদের কেন্দ্রীয় গম্বুজটির মধ্যবর্তী অংশে এবং পার্শবর্তী অংশদ্বয়ের উপরিভাগ আবার দুই অংশে বিভক্ত করে প্রতিটি অংশের ওপর একটি করে ক্ষুদ্র গম্বুজ স্থাপন করা হয়েছে। গম্বুজসমূহ করবেল কৃত পেন্ডেন্টিভ দ্বারা সৃষ্ট। সুলতানী আমলের মসজিদের কার্নিশে এবং বাংলার দোচালা ঘরের কার্নিশে যে স্বাভাবিক বক্ররেখা পরিলৰিত হয়, এই মসজিদের ৰেত্রে তা ছিল আরও মাত্রাতিরিক্ত।

মসজিদটি বহির্ভাগে উত্তর-দৰিণে ৪৫ ফুট লম্বা, আর পূর্ব-পশ্চিমে ২৫ ফুট চওড়া। অভ্যন্তরে প্রায় ৩৬ ফুট লম্বা, আর ১৬ ফুট চওড়া। অর্থাৎ, এর চারদিকের দেয়ালই প্রায় ৫ ফুট করে পুরু। মসজিদটির চার কোণে রয়েছে চারটি অষ্টকোণাকৃতির বুরুজ। এগুলো বলয়াকার স্ফীত রেখা দ্বারা অলঙ্কৃত। এর পূর্ব দেয়ালে তিনটি এবং উত্তর ও দৰিণের দেয়ালে দু’টি করে কৌনাকৃতির খিলানকৃত প্রবেশপথ রয়েছে। পূর্ব দেয়ালের কেন্দ্রীয় প্রবেশপথটির উপরিভাগে সাড়ে ২৬ ফুট লম্বা ও এক ফুটের অধিক পরিমাণ চওড়া একটি অলঙ্কারহীন ফাঁপা স্থান পরিলৰিত হয়েছে, যেখানে সম্ভবত কোন লিপি যুক্ত ফলক ছিল, যা আজ আর নেই। কি ছিল, কবে থেকে নেই, এমনটিও জানাতে পারলেন না মসজিদের ইমাম সাহেবসহ স্থানীয়রা। প্রতিটি খিলানের স্প্যান্ড্রিলে গোলাকার ফুলবিশিষ্ট টেরাকোটার অলঙ্কার রয়েছে, যা এ অঞ্চলের কারিগরদের অত্যনত্ম প্রিয় মোটিফ। মসজিদের অভ্যনত্মরে পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মেহরাব রয়েছে। এগুলো সর্পিল নকশাবিশিষ্ট টেরাকোটার অলঙ্করণ দ্বারা মনোরমভাবে সুসজ্জিত। এখানে ব্যবহৃত অর্ধচন্দ্রাকৃতির একটি টেরাকোটার নকশা এ মসজিদের একটি উলেস্নখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এ ধরনের নকশা বাংলার কোন মসজিদে সম্ভবত প্রথম। তবে এসব নকশার অধিকাংশই আজ আর নেই। সবই খসে পড়েছে। মসজিদের অনেক অংশের দেয়ালের ইটও খসে পড়েছে। স্থানীয়দের দাবি শুধু অষ্টগ্রামেরই নয়, বাংলাদেশের ঐতিহ্য এই মসজিদটিকে দ্রুত সংস্কার করে রক্ষা করা হোক।