নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। মুরালিধরনের তখন ক্যারিয়ারের সূচনালগ্ন। তেমন খ্যাতি পাননি, বড় কোনো অর্জনও নেই। হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে শ্রীলঙ্কার তখনকার অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা বললেন, ‘মুরালিই এখন বিশ্বের সেরা অফ স্পিনার!’ তাচ্ছিল্যে তখন হয়তো কেউ কেউ ঠোঁট বাঁকিয়েছিল। কেউ হয়তো রানাতুঙ্গার ক্রিকেট-জ্ঞান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতেও দ্বিধা করেনি। কিন্তু শ্রীলঙ্কার একমাত্র বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক নিজের বিশ্বাস থেকে সরে আসেননি। সেদিন যারা রানাতুঙ্গার কথায় হেসে উঠেছিলেন, আজ তাদের লজ্জায় মুখ লুকানোর দশা! বোলিংয়ের প্রায় সমস্ত অর্জন মুঠোবন্দি করে, অজস্র কীর্তির সাফল্য-সাগরে অবগাহন করে, ৮০০ উইকেটের চূড়ায় উঠে গতকাল তিনি বিদায় নিলেন ক্রিকেট-ইতিহাসের অবিসংবাদিত সেরা অফ স্পিনার হিসেবে।
রানাতুঙ্গা যখন মুরালি সম্পর্কে ওই মন্তব্য করেছিলেন তখনো শ্রীলঙ্কা বিশ্ব ক্রিকেটের দুর্বলতম দল। ১৯৯৫ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে প্রথম বিদেশের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জয় দিয়ে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের মধুর পালাবদলের সূচনা। শ্রীলঙ্কার সেই ঐতিহাসিক অর্জনের অন্যতম দুই রূপকার ছিলেন চামিন্ডা ভাস ও মুরালি। পরের বছর বিশ্বকাপ জিতল রানাতুঙ্গার দল। তারপর থেকেই তারা ক্রিকেটাঙ্গনের সমীহ জাগানো শক্তি। রানাতুঙ্গা-ডি সিলভা-জয়াসুরিয়ারা ছিলেন, তবে শ্রীলঙ্কার চমক জাগানো রূপান্তরে মুরালির ভূমিকাই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি! ব্যাটসম্যানরা রান করতে পারেন, কিন্তু ক্রিকেটে বিশেষ করে টেস্টে প্রতিপক্ষের ২০ উইকেট ফেলতে না পারলে জয় পাওয়া সম্ভব নয়। ক্যারিয়ার শুরুর কয়েক বছর পর থেকে সেই কাজটি নিয়মিতভাবে, নিষ্ঠার সঙ্গে করে গেছেন মুরালি। কত রেকর্ড যে গড়েছেন তার হিসাব করাই মুশকিল!
শুধু যে বল হাতে দলের জয়ে সবচেয়ে বড় অবদান রেখে সতীর্থদের মন জিতে নিয়েছেন, তা নয়। সমসাময়িক প্রতিপক্ষ বোলাররাও তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কখনো কখনো সেই প্রশংসা পরিণত হয়েছে শ্রদ্ধাঞ্জলিতে! গল টেস্ট শুরু হওয়ার আগে অনিল কুম্বলে যেমন বললেন, ‘যখন আপনি দেখবেন যে মুরালি আমার সমান টেস্ট খেলে আমার চেয়ে ১৭৩টা উইকেট বেশি নিয়েছে, তখনই বুঝতে পারবেন ওর অর্জনের ব্যাপ্তি কতটা বিশাল!’ শেন ওয়ার্ন তো বলেই দিয়েছেন, ৮০০ উইকেটের সুউচ্চ শৃঙ্গ ছোঁয়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
জন্ম তামিল পরিবারে। আর শ্রীলঙ্কায় তামিল মানেই নিপীড়ন, শোষণ-বঞ্চনার জীবন। অথচ সংখ্যালঘু পরিবারে জন্মেও তিনি আজ দেশের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট-নায়ক। আঙুল আর কবজির অনিন্দ্যসুন্দর কারুকাজ তো অবশ্যই, সঙ্গে ছিল অসম্ভব মানসিক দৃঢ়তাও। এই দুটোর মিলিত অবদানেই মুরালি সবাইকে ছাড়িয়ে, সবার ওপরে।
ক্যারিয়ারের শুরুতে বোলিং অ্যাকশন নিয়ে এমন প্রশ্ন উঠলে অন্য কেউ হয়তো ভেঙে পড়ত। কিন্তু ইস্পাতদৃঢ় মুরালি ভেঙে পড়েননি। রীতিমতো ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা দিয়ে, বৈধ অ্যাকশনের স্বীকৃতি নিয়েই ক্রিকেট মাঠে ফিরেছেন। তাও একবার নয়, একাধিকবার।
আর রেকর্ড? বলে শেষ করা যাবে না। সবচেয়ে বেশি বার ইনিংসে ৫ ও ম্যাচে ১০ উইকেট, সবচেয়ে বেশি বোল্ড, ক্যাচ, কট অ্যান্ড বোল্ড আর স্টাম্পিং থেকে উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব, টেস্টে সবচেয়ে বেশি বল করা, দু-দুু বার টানা চার টেস্টে ১০ বা তার চেয়ে বেশি উইকেট শিকার, ৩৫০ থেকে ৭০০ পর্যন্ত প্রতিটি ‘ল্যান্ডমার্ক’ সবচেয়ে কম টেস্টে স্পর্শ করা, টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র বোলার হিসেবে ৭৫০ ও ৮০০ উইকেট নেওয়া_অজস্র অর্জনে উদ্ভাসিত মুত্তিয়া মুরালিধরনের টেস্ট ক্যারিয়ার। ওয়ানডেতেও সবচেয়ে বেশি (৫১৫টি) উইকেটের মালিক তিনি।

পৃথিবীতে কোনো কিছুই অবিনশ্বর নয়। সব কিছুরই সমাপ্তি হবে এক দিন। মুরালির টেস্ট জীবনও শেষ হয়ে গেল কাল। কিন্তু তাঁর কীর্তি! সেটা বোধ হয় অক্ষয়, অমর এবং অনন্তকালের। অসম্ভব মনের জোর আর অবিশ্বাস্য টার্ন করানোর ক্ষমতার জন্য ক্রিকেটপ্রেমীরাও মিস করবেই মুরালিকে!

কালের কন্ঠ-