রাষ্ট্রপতি আলহাজ মো. জিল্লুর রহমান, স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মো. আলাউদ্দিনের মতো ভিআইপি সমৃদ্ধ জেলা কিশোরগঞ্জের সাতটি পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিএনপির কাছে চার-তিন ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ল। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলার ছয়টি আসনের মধ্যে পাঁচটিতে আওয়ামী লীগ এবং অন্যটিতে মহাজোটের সমর্থনে জাতীয় পার্টি জয়লাভ করেছিল। দুই বছর যেতে না যেতেই আওয়ামী লীগের ‘ঘাঁটি’ কিশোরগঞ্জে পৌর নির্বাচনের এ ফলাফলকে দলের ‘বিপর্যয়’ বলেই দেখা হচ্ছে। অনেকের অভিমত, দলে অনৈক্য, বিভেদ ও প্রকাশ্য বিরোধিতায় পৌর নির্বাচনে প্রত্যাশিত ফল পায়নি আওয়ামী লীগ। ভৈরব জেলা ইস্যু, প্রত্যাশিত উন্নয়ন না হওয়া প্রভৃতি বিষয় নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। অন্যদিকে বিএনপি চার পৌরসভায় জয়ী হলেও দলে বিদ্রোহ ও কোন্দল ছিল প্রকট। না থাকলে সব পৌরসভায়ই তাঁরা আরো ভালো ফল পেত। আওয়ামী লীগের বেলায় একই কথা প্রযোজ্য। যে পৌরসভায় যে দলের নেতারা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন, সেখানে সেই দলই ভালো ফলাফল করেছে।

ভৈরবে ‘ধরাশায়ী’ আওয়ামী লীগ : ভৈরব উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আলহাজ মো. সায়দুল্লাহ মিয়া রাষ্ট্রপতি আলহাজ মো. জিল্লুর রহমানের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। মো. সায়দুল্লাহ মিয়া মেয়র প্রার্থী হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির ছেলে ভৈরব-কুলিয়ারচরের সংসদ সদস্য নাজমুল হাসান পাপন তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। ভৈরবের শিক্ষক, চিকিৎসকসহ প্রায় সব পেশাজীবী সংগঠনের লোকজন তাঁর জন্য মাঠে নামেন। ছিল মহাজোটের সমর্থন। সর্বশক্তি নিয়োগের পরও মো. সায়দুল্লাহ মিয়া ফলাফলে তৃতীয় হন। তিনবার নির্বাচন করে তিনবারই তিনি পরাজিত হলেন। মেয়র নির্বাচিত হন পৌর বিএনপির সদস্য হাজী মো. শাহীন। তাঁর কাছে মেয়র প্রার্থী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মো. রফিকুল ইসলামও ধরাশায়ী হন। দলের অনৈক্য ও কোন্দল আওয়ামী লীগের ভরাডুবির মূল কারণ বলে জানা গেছে। পাঁচ মেয়র প্রার্থীর মধ্যে তিনজনই ছিলেন আওয়ামী লীগের।

বাজিতপুরে ‘এমপির প্রার্থী’ বনাম ‘কেন্দ্রের প্রার্থী’ : বাজিতপুরে মেয়র নির্বাচিত হন পৌর বিএনপি সভাপতি এহেসান কুফিয়া। দ্বিতীয় হন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ছারওয়ার আলম। তিনি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আফজাল হোসেন সমর্থিত প্রার্থী। সংসদ সদস্যের ভাইসহ ঘনিষ্ঠ লোকজন ছারওয়ারের পক্ষে নির্বাচন করেন। অন্যদিকে রফিকুল ইসলাম গোলাপ ‘কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ মনোনীত’ মেয়র প্রার্থী হিসেবে দলের অধিকাংশ নেতার সমর্থন পান। আফজাল হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগের লোকজন দলের প্রার্থীর পরিবর্তে বিএনপির প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে। কেন্দ্রের প্রার্থীর বাইরে অবস্থান কেন? তাঁর উত্তর, ‘কেন্দ্রের মনোনয়ন সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না।’ আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শেখ নূরুন্নবী বাদল বলেন, ‘একক প্রার্থী দিতে ব্যর্থ হলেও শেখ হাসিনা মনোনীত প্রার্থীর পক্ষেই আমরা কাজ করেছি। বিএনপির প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার অভিযোগ ঠিক নয়।’ বিএনপির মেয়র প্রার্থী এহেসান এই পৌরসভায় বিজয় ছিনিয়ে নেন।

কটিয়াদীতে প্রকাশ্য বিরোধিতা : কটিয়াদী পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তোফাজ্জল হোসেন খান দিলীপের জয়ের পেছনে কাজ করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য বিরোধিতা। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শওকত ওসমান শুক্কুর আলী প্রায় দুই হাজার ভোটের ব্যবধানে তাঁর কাছে পরাজিত হন। দলের নেতা-কর্মীরা মনে করেন, প্রার্থী মনোনয়ন যথাযথ হয়নি। এ ছাড়া গত উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে দুজন প্রার্থী নির্বাচন করলেও লায়ন মো. আলী আকবর চেয়ারম্যান হন। কিন্তু দুই বছরেও দলের পুরনো বিরোধ মেটেনি। উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা লায়ন মো. আলী আকবর বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করে প্রকাশ্যে বিএনপির পক্ষে নির্বাচন করেছেন। প্রশাসনও বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে প্রভাবিত ছিল। ফলে এমন বিপর্যয় ঘটে।

হোসেনপুরে মনোনয়নে ‘ভুল’ : হোসেনপুর পৌরসভায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আবদুল কাইয়ুম খোকনের বড় ভাই আবদুল কাদির স্বপন উপজেলা চেয়ারম্যান। এলাকাবাসী জানায়, পৌরবাসী একই পরিবারের দুজনকে গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদে দেখতে চায়নি। তা ছাড়া স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশ খোকনের পক্ষে কাজ করেনি। খোকন জেলা শহরে রাজনীতি করেন। অন্যদিকে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মাহবুবুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় গণসংযোগ করে আসছেন। জনগণের পাশে থেকেছেন। তাই নির্বাচনে জনগণ তাঁর প্রতি আস্থার প্রকাশ ঘটিয়েছে। হোসেনপুর আওয়ামী লীগ সভাপতি আইয়ুব আলী অবশ্য দলীয় কোন্দলের কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে ভুল হওয়ায় আওয়ামী লীগ জিততে পারেনি।’

কুলিয়ারচরে ‘নিরঙ্কুশ’ বিজয় : কুলিয়ারচর পৌরসভায় একক প্রার্থী দেয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। মেয়র নির্বাচিত হন সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আবুল হাসান কাজল। অন্যদিকে সাবেক মেয়র ও উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নূরুল মিল্লাত প্রায় তিন হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। রাষ্ট্রপতির ঘনিষ্ঠ জন কুলিয়ারচর গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিআইপি মো. মুছা মিয়ার ভাই কাজল। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেন লিটনও তাঁর ভাই।

করিমগঞ্জে জয় ‘ভাগ্যগুণে’ : করিমগঞ্জে আওয়ামী লীগের তিনজন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাঁরা হলেন দলের একাংশের সমর্থিত উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক হাজী আবদুল কাইয়ুম, অপর অংশের সমর্থিত প্রার্থী কামরুল ইসলাম চৌধুরী মামুন ও প্রবীণ নেতা রুস্তম আলী। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন দুলাল শিকদার। আওয়ামী লীগের তিন প্রার্থী থাকলেও তরুণ প্রার্থী আবদুল কাইয়ুম জিতে যান। দ্বিতীয় হন কামরুল ইসলাম চৌধুরী মামুন। জানা গেছে, আঞ্চলিকতার কারণে দলীয় প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে বিএনপির অনেক ভোটার হাজী কাইয়ুমকে সমর্থন দেন। বিএনপির মধ্যেও স্পষ্ট বিভক্তি ছিল। বিএনপির প্রার্থী তাঁর এলাকা ছাড়া অন্য কোনো কেন্দ্রে উল্লেখ করার মতো ভোট না পাওয়ায় কাইয়ুম জয়ী হন। তবে সব প্রার্থীই নিজ নিজ এলাকায় ভালো ভোট পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মতে, ‘ভাগ্যগুণে’ এ পৌরসভাটি ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে।

কিশোরগঞ্জে ঐক্য ও আস্থা : কিশোরগঞ্জ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মাজহারুল ইসলাম ভঁূইয়া কাঞ্চন পাঁচ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে মেয়র নির্বাচিত হন। প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন প্রার্থী থাকলেও অন্যরা পরে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় একক প্রার্থী হিসেবে তিনি সুযোগ কাজে লাগান। দ্বিতীয় হন বিএনপির একাংশ সমর্থিত মাজহারুল ইসলাম। বিএনপির প্রার্থিতা করেন দুজন আবু তাহের মিয়া ও মাজহারুল ইসলাম। নির্বাচনের আগে দুই প্রার্থীকে কেন্দ্র করে নেতা-কর্মীরা দুই ভাগ হয়ে পড়েন। নির্বাচনের এক দিন আগে মাজহারুল ইসলামের পক্ষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. এম ওসমান ফারুক প্রচারণা চালাতে কিশোরগঞ্জে আসেন। তার পরও ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ায় পরাজিত হয় বিএনপি। সদর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ সাদী জানান, বিএনপির কোন্দলে আওয়ামী লীগের জয় সহজ হয়েছে।

-kaler kontho