মসলিন নিয়ে গল্প-গাঁথা, কিংবদন্তীর কেন শেষ নেই । মসলিন কত পাতলা হত, ম্যাচ বাক্সে পুরে ফেলা যেত আস্ত একটা শাড়ি! এসবের পাশাপাশি মসলিন যাঁরা তৈরি করতেন সেই তাঁতিদের প্রতি অত্যাচারের কাহিনী, আঙুল কেটে ফেলার কাহিনী এসব আমাদের সবারই কম বেশি শোনা। এগুলোর কতগুলো সত্যি, কতটুকু মিথ্যা তা অন্য প্রসঙ্গ, কিন্তু এই আলোচনা এটাই প্রমাণ করে মসলিন আমাদের ভারি আগ্রহের বিষয়।

মসলিন শব্দের উদ্ভব কিভাবে ?

হেনরি ইউল এর প্রকাশিত অভিধান হবসন জবসন থেকে আমরা পাই মসলিন শব্দের উদ্ভব মসূল থেকে। ইরাকের এককালের নামি ব্যবসা কেন্দ্র মসূলে তৈরি হত সূক্ষ্ম সব কাপড় । যতদূর জানা যায়, ইংরেজরা আমাদের এই সূক্ষ্ম কাপড়কে নামকরণ করে মসলিন হিসেবে ।

কিন্তু ঢাকা আর আশেপাশের এলাকাতে- মুঘল আমলে সপ্তদশ শতকে মসলিন শিল্প বিকাশ লাভ করেছিল চূড়ান্ত রকম। আজও আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই যুগের মসলিসকেই মনে করি।

ঢাকাই মসলিনের অনন্যতার কাহিনী ছড়িয়ে পরেছিল সর্বত্র। মসলিন রপ্তানি হতো ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে, এমনকি তা রপ্তানি হতো ইউরোপ-আফ্রিকাতেও।

আমরা যেমন আজকেও মসলিন নিয়ে গর্বিত, তেমনি মসলিন দেখে অভিভূত হয়েছিলেন ভিনদেশী ভূগোলবিদ আর পর্যটকরা। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত লোকজন ঢাকা-সোনারগাঁও এর এই উঁচুমানের মসলিন দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। নবম শতকে ভূগোলবিদ সোলায়মান একটি বই লিখেছিলেন- ‘সিলসিলাত উত তাওয়ারীখ’ । তাতে রুমী নামের এক দেশের কথা আছে যেখানে এত সূক্ষ কাপড় তৈরি হত যে চল্লিশ হাত লম্বা আর দুইহাত চওড়া কাপড়ের একটি পুরো টুকরো প্রবেশ করানো যেত একটি সাধারণ আংটির মধ্যে দিয়ে। ধারনা করা হয় রূমী হচ্ছে আজকের বাংলাদেশ। সবমিলিয়ে এ দেশের কাপড়ের ঐতিহ্য আজকের নয়-বহু শতকের পুরানো।

তবে প্রাচীন আমল থেকেই বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্পের সুখ্যাতি থাকলেও মূলত মুঘল আমলে ঢাকা যখন রাজধানী হয় তখন থেকেই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাপড়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে । সম্রাট, নবাবেরা মসলিন কাপড় কেনা আরম্ভ করেন চড়া দামে। সে যুগে মসলিন তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল ঢাকা, ধামরাই, সোনারগাঁ, টিটবাদি, জঙ্গলবাড়ি আর বাজিতপুর। জঙ্গলবাড়ি অধিকাংশের পেশা তখন মসলিন বোনা। উনিশ শতকের প‌্রথমভাগেও সেখানে একাজে নিয়োজিত ছিলেন প্রায় একশ তাঁতি পরিবার। জঙ্গলবাড়ি থেকে মাইল কুড়ি দূরে বাজিতপুর- ওখানে জন্মাতো উচুঁমানের কার্পাস, যা থেকে তৈরি হতো উঁচুমানের মসলিন। আজ থেকে দু’শ বছর আগেও বিদেশী বণিকেরা সোনারগাঁ থেকে মসলিন বিদেশে রপ্তানী করতো। ওখানকার প্রায় দেড়হাজার তাঁতি সে সময় মসলিন বুনে সরবরাহ করতো ইংরেজ কোম্পানিকে। জেমস টেলর সাহেব ১৮৫১ সালে যখন মসলিনের উপর একটি পান্ডুলিপি তৈরি করেন মসলিনের স্বর্ণযুগ তখন পড়তির দিকে; অথচ যা জানা যায় ঢাকাতে তখনও সাতশ’ ঘরের বেশি তাঁতি নিয়োজিত ছিল এই কাজে।

মসলিন তৈরি করার জন্য দরকার হতো বিশেষ ধরনের তুলা, ফুটি কার্পাস। এ বিশেষ ধরনের কার্পাসটি জন্মাতো মেঘনা নদীর তীরে ঢাকা জেলার কয়েকটি স্থানে। একদম ভাল মানের কার্পাস উৎপন্ন হত মেঘনার পশ্চিম তীরে। শ্রীরামপুর, কেদারাপুর, বিক্রমপুর, রাজনগর ইত্যাদি স্থানগুলো ফুটি কার্পাসের জন্য বিখ্যাত ছিল। আজকের যে কাপাসিয়া নামটি আমরা জানি তা এসেছে এই কারপাস হতে। মেঘনা এমনিতেই খুব বড় নদী, তার উপর সমুদ্রের কাছাকাছি আবার বর্ষাকালে নদীর দু’কূল ভেসে যেত। তার ফলে যে পলি জমতো তার কারনেই ফুটি কার্পাসের উৎপাদন খুব ভাল হতো এসব স্থানগুলোতে। কিন্তু একজন কার্পাস চাষী একবিঘা জমিতে ভালমানের মসলিন তৈরির জন্য মাত্র ছয় কেজির মতো তুলা পেত। তাই মসলিনের চাহিদা যখন খুব বেড়ে গেল, সেই সময় ভারতের গুজরাট হতেও তুলা আমদানি করা হতো- কিন্তু ওগুলো দিয়ে ভালমানের মসলিন তৈরি করা যেত না- যা হতো তা খুব সাধারন মানের হতো।

সাধারনত, মহিলারাই সুতা কাঁটা আর সূক্ষ্ম সুতা তোলার মত পরিশ্রম এবং ধৈর্যের কাজে নিয়োজিত ছিল। সুতা তোলার সময় কম তাপ এবং আর্দ্রতার দরকার হতো। তাই একেবারে ভোর বেলা আর বিকালের পরে এ কাজ করা হতো। মজার ব্যাপার হলো- আর্দ্রতার খোঁজে অনেক সময় এমনকি নদীতে নৌকার ওপর বসে সুতা কাটার কাজ চলত। একজন মহিলা এভাবে প্রতিদিন সুতা কেটেও মাসে মাত্র আধা তোলা সুতা তুলতে পারতেন। এই পরিশ্রমসাধ্য কাজের কারণে দক্ষ সুতা কাটুনির সংখ্যা অনেক কমে আসতে থাকে উনিশ শতকের শুরু থেকেই। জানা গিয়েছে- এই রকম সূক্ষ্ম সুতা কাটার কাজ অঞ্চল ছাড়া অন্য কোথাও এতোটা ভাল হতো না । এর কারণ ধরা হয় দু’টো- ঢাকার ফুটি কার্পাস আর শ্রমিকের দক্ষতা ও পরিশ্রম।

বিভিন্ন সুত্র হতে যা জানা যায়- ১৮৫১ সালে লন্ডনে এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে ঢাকা হতে কিছু মসলিন পাঠানো হয়। সেখানে এক পাউন্ড সুতা দেখানো হয়েছিলো যা প্রায় আড়াইশো মাইল ছিল !! আরও মসলিন সম্বন্ধে, “মর্নিং ক্রনিকল” পত্রিকায় লিখা হয়- হাবিবুল্লাহ তাঁতির বোনা দশ গজ লম্বা একখন্ড মসলিনের ওজন মাত্র তিন আউন্স !!

মসলিন তৈরির কাজটি ছিল ভীষন জটিল, কঠিন, সময়সাধ্য- তারচেয়েও বড় কথা হলো সেটা তৈরির জন্য দরকার হতো অসামান্য নৈপুণ্য আর আসুরিক ধৈর্য। মোটামুটি যে ক’ধাপ পেরিয়ে তৈরি হতো মসলিন সেগুলো হলো; সুতা নাটানো, টানা হোতান, সান বাঁধা, নারদ বাঁধা, বু-বাধাঁ, আর সবশেষে কাপড় বোনা । এসব শেষে একজন তাঁতি আর তার দু’জন সহকারীর লাগতো কমপক্ষে দু’তিন মাস।

মসলিন তৈরি শেষে ওগুলো ধোয়া হতো। সম্রাট আকবর এর আমালে সোনারগাঁ’র কাছে এগোরো সিন্ধুর পানি কাপড় ধোয়ার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। আসলে এটা যে শুধু পানির গুনে হতো তা নয়, এর সাথে ছিল ভাল ক্ষার বা সাবান আর ধোপার দক্ষতা। মসলিন ধোবার জন্য রীতিমতো একটা শ্রেনীর মানুষই তৈরি হয়েছিল। আঠারো শতকের গোড়ায় একখন্ড মসলিন ধোয়ার খরচ পড়তো দশ টাকা। আবার ধোয়ার সময় কাপড়ে কোন দাগ লাগলে বিভিন্ন ফলের রস দিয়ে সেটা তুলে দেয়া হত। কাপড় ধোবার সময় কোন সুতা সরে গেলে সেটা ঠিক করতো দক্ষ রিফুকাররা, তাদেরকে বলা হতো নারোদিয়া। এরপর শঙ্খ বা ছোট মুগুর দিয়ে পিটিয়ে মোলায়েম করা হতো। মোলায়েম করার সময় ছিটানো হতো চাল ধোয়া পানি। একাজে নিয়োজিতোদের বলা হতো কুন্ডুগার। তারপর সাবধানে ইস্ত্রি করা হতো মসলিন। কোন কোন মসলিনে ছুঁচের বা চিকনের কাজও করা হতো।

মসলিনের পার্থক্য করা হতো সূক্ষ্মতা, বুননশৈলী আর নকশার পার্থক্যে।এরই প্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রকার মসলিনের আলাদা আলাদা নাম হয়ে যায়।

মলবুস খাস
‘মলবুস খাস’ মানেই হলো খাস বস্ত্র বা আসল কাপড়। এজাতীয় মসলিন সবচেয়ে সেরা আর এগুলো তৈরি হতো সম্রাটদের জন্য। আঠারো শতকের শেষদিকে মলবুস খাসের মতো আরেক প্রকারের উঁচু মানের মসলিন তৈরি হতো, যার নাম ‘মলমল খাস’। এগুলো লম্বায় ১০ গজ, প্রস্থে ১ গজ, আর ওজন হতো ৬-৭ তোলা। ছোট্ট একটা আংটির মধ্যে দিয়ে এ কাপড় নাড়াচাড়া করা যেতো। এগুলো সাধারণত রপ্তানি করা হতো।

সরকার-ই-আলা
এ মসলিনও মলবুস খাসের মতোই উঁচুমানের ছিলো। বাংলার নবাব বা সুবাদারদের জন্য তৈরি হতো এই মসলিন। সরকার-ই-আলা নামের জায়গা থেকে পাওয়া খাজনা দিয়ে এর দাম শোধ করা হতো বলে এর এরকম নামকরণ। লম্বায় হতো ১০ গজ, চওড়ায় ১ গজ আর ওজন হতো প্রায় ১০ তোলা।

ঝুনা
‘ঝুনা’ শব্দটি, জেমস টেইলরের মতে, এসেছে হিন্দী ঝিনা থেকে, যার অর্থ হলো সূক্ষ্ম। ঝুনা মসলিনও সূক্ষ্ম সুতা দিয়ে তৈরি হতো, তবে সুতার পরিমাণ থাকতো কম। তাই এজাতীয় মসলিন হালকা জালের মতো হতো দেখতে। একেক টুকরা ঝুনা মসলিন লম্বায় ২০ গজ, প্রস্থে ১ গজ হতো। ওজন হতো মাত্র ২০ তোলা। এই মসলিন বিদেশে রপ্তানি করা হতো না, পাঠানো হতো মোঘল রাজ দরবারে। সেখানে দরবারের বা হারেমের মহিলারা গরমকালে এ মসলিনের তৈরি জামা গায়ে দিতেন।

আব-ই-রওয়ান
আব-ই-রওয়ান ফারসি শব্দ, অর্থ প্রবাহিত পানি। এই মসলিনের সূক্ষ্মতা বোঝাতে প্রবাহিত পানির মতো টলটলে উপমা থেকে এর নামই হয়ে যায়। লম্বায় হতো ২০ গজ, চওড়ায় ১ গজ, আর ওজন হতো ২০ তোলা। আব-ই-রওয়ান সম্পর্কে প্রচলিত গল্পগুলোর সত্যতা নিরূপন করা না গেলেও উদাহরণ হিসেবে বেশ চমৎকার।

যেমন: একবার সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবারে তাঁর মেয়ে উপস্থিত হলে তিনি মেয়ের প্রতি রাগান্বিত হয়ে বললেন তোমার কি কাপড়ের অভাব নাকি? তখন মেয়ে আশ্চর্য হয়ে জানায় সে আব-ই-রওয়ানের তৈরি সাতটি জামা গায়ে দিয়ে আছে। অন্য আরেকটি গল্পে জানা যায়, নবাব আলীবর্দী খান বাংলার সুবাদার থাকাকালীন তাঁর জন্য তৈরি এক টুকরো আব-ই-রওয়ান ঘাসের উপর শুকোতে দিলে একটি গরু এতোটা পাতলা কাপড় ভেদ করে ঘাস আর কাপড়ের পার্থক্য করতে না পেরে কাপড়টা খেয়ে ফেলে। এর খেসারৎস্বরূপ আলীবর্দী খান ঐ চাষীকে ঢাকা থেকে বের করে দেন।

খাসসা
ফারসি শব্দ খাসসা। এই মসলিন ছিলো মিহি আর সূক্ষ্ম, অবশ্য বুনন ছিলো ঘন। ১৭ শতকে সোনারগাঁ বিখ্যাত ছিলো খাসসার জন্য। ১৮-১৯ শতকে আবার জঙ্গলবাড়ি বিখ্যাত ছিলো এ মসলিনের জন্য। তখন একে ‘জঙ্গল খাসসা’ বলা হতো। অবশ্য ইংরেজরা একে ডাকতো ‘কুষা’ বলে।

শবনম
‘শবনম’ কথাটার অর্থ হলো ভোরের শিশির। ভোরে যদি শবনম মসলিন শিশির ভেজা ঘাসে শুকোতে দেয়া হলে শবনম দেখাই যেতোনা, এতোটাই মিহী আর সূক্ষ্ম ছিলো এই মসলিন। ২০ গজ লম্বা আর ১ গজ প্রস্থের শবনমের ওজন হতো ২০ থেকে ২২ তোলা। তাছাড়া ডোরিয়া,নয়ন সুখ,বদন খাস,সর-বন্ধ,রঙ্,আলিবালি, তরাদ্দাম,তনজেব,সরবুটি,চারকোনার কথাও জানা যায়।

কোন কোন সময় রঙও করা হতো। ঢাকার চিকনের কাজেও যথেষ্ট সুনাম ছিল, এখনও আছে । এরপর কাপড়গুলোকে ভালমতো প‌্যাক করা হতো, একাজ যারা করতো তাদের বলা হতো বস্তাবন্দ। ইংরেজদের কারখানা ছিল তেজগাঁও-এ (অন্য আরেকদিন সুযোগ পেলে তেজগাঁও এর নামকরন হয়েছিলো কিভাবে তা আলোচনা করবো)। কেনা মসলিন ওখানে এনে ধোয়া থেকে শুরু করে প‌্যাক করার কাজ শেষ করে পাঠিয়ে দেয়া হতো কলকাতায়-সেখান হতে ইউরোপে।

মসলিন ছিল নানা রকমের। এর পার্থক্য নির্ণীত হত সুতার সূক্ষ্মতা, বুনন আর নকশা বিচারে। সবচেয়ে সূক্ষ্ম সুতার তৈরি, সবচেয়ে কম ওজনের মসলিনের কদর ছিল সবার চেয়ে বেশি, দামটাও ছিল সবচেয়ে চড়া। “মলবুস খাস” ছিল সবচেয়ে নামী, সেরা মসলিন। সম্রাটের জন্য তৈরি হত এই মসলিন।

আঠারো শতকের শেষদিকে মলবুস খাস সম্রাটের দরবারে পাঠানো বন্ধ হলে তৈরি হয় “মলমল খাস”। দশগজ লম্বা আর একগজ চওড়া মলমল খাসের ওজন হত মাত্র ছয় তোলার মতো, যা অনায়াসে ছোট্ট একটা আংটির ভিতর দিয়ে গলে যেত! মলবুস খাসের সমগোত্রীয় আরেকটি মসলিন “সরকার-ই আলা”।

দশগজ লম্বা আর একগজ চওড়া ‘সরকার-ই আলা’-র ওজন হত দশ তোলার মতো। ঝুনা মসলিনে সুতার পরিমান থাকতো কম- দেখতে হত অনেকটা জালের মত। ঝুনা হিন্দী শব্দ যার অর্থ ‘সূক্ষ্ম’। নকশা করা মসলিনকে বলা হতো জামদানি, কিন্তু আজকের জামদানির সাথে আদি জামদানির আকাশ-পাতাল তফাৎ।

মসলিন তৈরির প্রক্রিয়াটা এত জটিল আর সময় সাপেক্ষ ছিল যে সম্রাটদের জন্য উন্নত মসলিন তৈরি করেই দিন কাটতো তাঁতিদের- বাড়তি মসলিন তৈরি করার সময় মিলতো তাই কম।
যতদূর জানা যায়, ঢাকা শহরে ‘মলবুস খাস’ তৈরির কারখানা ছিল বর্তমানের নাজিমুদ্দিন রোডে। ১৭৭২ সালের এক হিসাব থেকে দেখা যায় যে ওই বছর সম্রাটকে পাঠানো হয় একলক্ষ টাকার ‘মলবুস খাস’ আর বাংলার নবাবকে পাঠানো হয় তিনলক্ষ টাকার ‘সরকার-ই-আলি’। ওলোন্দাজ ব্যবসায়ীরা ইউরোপে রপ্তানীর জন্য ১৭৮৭ সালে একলক্ষ টাকার মসলিন রপ্তানী করে। ইংরেজ কোম্পানী ওই বছর সংগ্রহ করে তিন লাখ টাকার মসলিন।

১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর ইংরেজরা যখন বাংলার বর্তা হয়ে ওঠে তখন তারা বছরে আট লাখ টাকার মসলিন রপ্তানী করতো। সেই সময়ে ফরাসিরা কিনেছিলো প্রায় তিন লাখ টাকার মসলিন। এরা ছাড়াও ইরানি, তুরানি, আর্মেনীয়দের পাশাপাশি দেশী ব্যবসায়ীরাও এ নিয়ে ব্যবসা করতেন। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, সে আমলে ঢাকা আর বাংলাদেশ থেকে রপ্তানীর জন্য কেনা হয়েছিল প্রায় ঊনত্রিশ কোটি টাকার মসলিন।

পরবর্তীতে মসলিন রপ্তানীর ব্যবসা প্রায় পুরোটাই করায়ত্ত করে নেয় ইংরেজ কোম্পানি। তাদের রপ্তানী হত মূলত ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে। পলাশীর যুদ্ধের আগ পর্যন্ত দালালরা বিভিন্ন জায়গা থেকে দামি মসলিন সংগ্রহ করে কোম্পানিতে সরবরাহ করতো। পলাশীর যুদ্ধের পর মসলিন সংগ্রহের জন্য গোমস্তা নিয়োগ করা হয়, যারা ছিল কোম্পানির বেতনভুক্ত কর্মচারী। এই গোমস্তারা মসলিন সংগ্রহের জন্য হয়ে উঠে নিষ্ঠুর, চালাতে থাকে অমানুষিক অত্যাচার। মসলিন তাঁতীরা দিশেহারা হয়ে উঠে এই গোমাস্তাদের অত্যাচারে। এখানে লক্ষণীয় যে, দেশীয় গোমাস্তারাই হয়ে উঠেছিলো দেশের মানুষের শত্রু।

কিন্তু মসলিনের সাথে জড়িত আমাদের দেশের প্রতিটি কৃষক, শ্রমিক, তাঁতীকে নানাভাবে ঠকানো হত, নির্যাতন করা হত। গরীব চাষিকে টাকা ধার দিয়ে তার কাছ হতে খুব কম দামে কার্পাস নিয়ে যেত একশ্রেনীর দেশী মানুষ। দেশী মানুষরা যারা দালাল-পাইকার হিসেবে কাজ করতো তারাও তাঁতীদেরকে ঠকাতো নানা ভাবে। গোমস্তারাতো রীতিমত অত্যাচার করতো তাঁতীদেরকে। হিসেবে দেখা যায়, আনুমানিক ১৭৪০ সালের দিকে এক টাকায় পাওয়া যেত প্রায় একমণ চাল। আর একজন তাঁতী মসলিনের কাজ করে পেত মাসে দুই টাকা, অর্থাৎ দুই মণ চালের দাম! যাতে তার পরিবারের খাবারই ঠিকমত চলতো না, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যতো অনেক দূরের কথা।

কি ভীষন ট্রাজেডি, যারা তৈরি করতেন বাংলার গর্ব-যাদের তৈরি কাপড় গায়ে উঠতো সম্রাটের, রপ্তানী হত বিদেশে, তাঁর গায়েই থাকতো না কাপড়, পেটে পড়ত না ঠিক মত খাবার। আর সবচেয়ে দুঃখজনক বোধহয় এটাই যে-এই অবিচারের পিছে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিলো এ দেশেরই দালার, পাইকার আর গোমস্তারাই।

প্রচলিত আছে যে- ইংরেজরা নাকি মসলিন তাঁতীদের আঙুল কেটে ফেলতো। আবার এও শোনা যায় যে- তাঁতীরা নিজেরাই নাকি নিজেদের আঙুল কেটে ফেলতো, যাতে করে এই অমানুষিক পরিশ্রম আর কম পারিশ্রমিকের কাজে তাদের বাধ্য না করা হয়। তবে আঙুল কেটে ফেলা ঘটনার কোন ঐতিহাসিক সত্যতা প্রমানিত না হলেও কার্পাস কৃষক আর তাঁতীদের উপর কোম্পানী, ব্যবসায়ী, গোমস্তা আর পাইকাররা যে অমানুষিক অত্যাচার চালাত সেটি জাজ্বল্যমান সত্যি। আমাদের গর্বের এই মসলিনের সঙ্গে কালিমার মত লেপ্টে আছে এই রূঢ় সত্যটাও।

চার-পাঁচশো বছর আগে যে মসলিন হয়ে উঠেছিল পৃথিবী বিখ্যাত, মাত্র দেড়শো বছরের মধ্যেই তা হারিয়ে গেল কেন?

১৮৪৪ সালে ঢাকার কমিশনার আই. ডানবার কোম্পানীর সদর দপ্তরে মসলিন শিল্প বন্ধ হবার কারণ উল্লেখ করে একটি রিপোর্ট পাঠান। ডানবার সাহেবের মতে মূল কারণগুলো ছিলঃ

১) ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে সস্তায় সুতা আর কাপড় উৎপন্ন হতে থাকে। ফলে দামি মসলিনের চাহিদা কমে যায়।

২) বিলেতের সস্তা সুতা ঢাকায়, ভারতে আসতে থাকে, সে থেকে তৈরি হতে থাকে কাপড়, হারিয়ে যেতে থাকে মসলিন।

৩) বিলাতে ঢাকাই মসলিনের ওপরে উচ্চহারে কর আরোপ করা হয়, ফলে মসলিনের দাম ওখানে বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। স্বভাবতাই বিক্রি কমে যায় মসলিনের।

মসলিনের পড়তির সময়টায় পতন ঘটতে থাকে আমাদের নবাব-সম্রাটদেরও। তাঁরা আর বেশি টাকা দিয়ে মসলিন কিনছেন না- চাহিদা কম ছিল অভ্যন্তরীন বাজারেও। তাছাড়া মুঘল সম্রাট, নবাব, ব্যবসায়ী-কেউই এ শিল্প রক্ষা কিংবা প্রসারে কোন সময়ই তেমন কোন উদ্যোগ নেননি, সব সময় চেষ্টা করেছেন কিভাবে কৃষক-তাঁতীদের যতটা সম্ভব শোষণ করে নিজেরা লাভবান হওয়া যায়- এই সব মিলিয়ে এভাবেই ধিরে ধিরে আমাদের আরও অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের মত হারিয়ে যায় মসলিনের স্বর্ণযুগও।