তিনি ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুর পরগনার বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মুগ্রহণ করেন। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত। অতীশ দীপঙ্করের বাসস্থান এখনও ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ নামে পরিচিত। অতীশ দীপঙ্কর গৌড়ীয় রাজ পরিবারে রাজা কল্যাণশ্রী ও প্রভাবতীর মধ্যম সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটবেলায় তাঁর নাম ছিল আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ। তিন ভাইয়ের মধ্যে অতীশ ছিলেন দ্বিতীয়। তার অপর দুই ভাইয়ের নাম ছিল পদ্মগর্ভ ও শ্রীগর্ভ। অতীশ খুব অল্প বয়সে বিয়ে করেন। কথিত আছে তার পাঁচ স্ত্রীর গর্ভে মোট ৯টি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তবে পুন্যশ্রী নামে একটি পুত্রের নামই শুধু জানা যায়।
আদিনাথ প্রথমে নিজের মায়ের কাছে এবং পরে সে সময়ের প্রখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত অবধূত জেতারির কাছে তিনি পাঁচটি অপ্রধান বিজ্ঞানে বিদ্যালাভ করেন। অতীশ জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং বহু গুরুর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেছেন। তার গুরুদের মধ্যে ১২জনের নাম পাওয়া যায়- জ্ঞানশ্রী মিত্র, দ্বিতীয় কুশালি, জেতারি, কৃষ্ণপাদ/বাল্যাচার্য, দ্বিতীয় অবধূতিপা, ডোম্বিপা, বিদ্যাকোকিল, মহিজ্ঞানবোধি, নারোপা, পন্ডিত মহাজন, ভূত কোটিপা, মহাপন্ডিত দানশ্রী, প্রজ্ঞাভদ্র, বোধিভদ্র প্রমুখ। অবদূতীপাদ রাজগৃহের দক্ষিণে সাতটি পর্বত ঘেরা নির্জন পরিবেশে বসবাস করতেন। অতীশ সেখানে ১২-১৮ বছর বয়স পর্যন্ত বাস করেন এবং অবদূতীপাদের কাছ থেকে তন্ত্র শাস্ত্র শিক্ষালাভ করেন। তিনি ১৮ থেকে ২১ বছর বয়স পর্যন্ত চুরাশী সিদ্ধাচার্যের অন্যতম ও বিক্রমশীলা বিহারের উত্তর দ্বারের দ্বার পন্ডিত নারোপা/ নাঙপাদ এর কাছে তন্ত্র শাস্ত্র শিক্ষালাভের জন্য শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এখানে তিনি ত্রিপিটক ভৈবাষিক দর্শন ও তান্ত্রিক শাস্ত্রে অসাধারণ পান্ডিত্য অর্জন করেন।
ওদন্তপুরী বিহারের জ্ঞানী ভীক্ষু রাহুল গুপ্ত তাকে “গুহ্যজ্ঞান ব্রজ” পদবীতে ভূষিত করেন। তিনি ওদন্তপুরী বিহারের মহাসঙ্ঘিকাচার্য শীল রক্ষিত তাকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা দেন। এ সময় মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে তিনি একজন প্রখ্যাত নৈয়ায়িক ব্রাহ্মণকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করলে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পরে। তখন আচার্য শীলরক্ষিত তাকে ‘শ্রীজ্ঞান’ উপাধি প্রদান করেন এবং তাঁর নতুন হয় দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। একত্রিশ বছর বয়সে ধ্যান শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি মগধের জ্ঞানবৃদ্ধ আচার্য ধর্মরক্ষিতের কাছে যান। ধর্মরক্ষিত তার বোধিসত্বের ব্রতে সাফল্য দেখে তাকে ভিক্ষুধর্মের শ্রেষ্ঠ উপাধি দেন। এর পর ১০১১ সালে তিনি ১২৫জন অনুগামী ভিক্ষুসহ এক সওদাগরী জাহাজে মালয়দেশের সুবর্ণদ্বীপে যান এবং সেখানে প্রখ্যাত আচার্য ধর্মকীর্তির কাছে ১২ বছর বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। সেখানে তিনি বহু পন্ডিতব্যক্তিকে যুক্তি-তর্কে পরাজিত করে ক্রমেই একজন অপ্রতিদ্বন্দী পন্ডিত হয়ে উঠেন। ফেরার পরে কিছু দিন শ্রীলংকায় অবস্থান করে ১০২৫ খ্রিস্টাব্দে ৪৪ বছর বয়সে তিনি আবার ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। এ সময় বজ্রাসন মহাবোধি বিহারে (বর্তমান বৌদ্ধগয়া) আয়োজিত সংবর্ধনায় তার অসামান্য পান্ডিত্যের জন্য ‘ধর্মপাল’ উপাধি দেওয়া হয়।
ভারতবর্ষে ফেরার পর ১৫ বছর ধরে তিনি ওদন্তপুরী ও সোমপুরী বিহারে অধ্যাপক ও পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গদেশের রাজা প্রথম মহীপালের অনুরোধে বিক্রমশীলা মহাবিহারের প্রধান অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। তিব্বতের রাজা হ্লা-লামা তাঁকে স্বর্ণ উপহার দিয়ে সেখানে ধর্ম প্রচারের আহ্বান জানান, কিন্তু দীপঙ্কর তা প্রত্যাখ্যান করেন। তবে তিব্বতের পরবর্তী রাজা চ্যান-চাব জ্ঞানপ্রভ তাঁকে পুনরায় আমন্ত্রণ করলে তিনি ১০৪১ সালে বিক্রমশীলা বিহার থেকে যাত্রা শুরু করে দুর্গম হিমালয় পর্বতমালা পাড়ি দিয়ে তিব্বতে যান। পথে নেপালের রাজা অনন্তকীর্তি তাঁকে সম্বর্ধনা দেন। নেপালের রাজপুত্র পথপ্রভা তাঁর কাছ থেকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করেন।
তিব্বতে পৌঁছে দীপঙ্কর রাজকীয় মর্যাদা লাভ করেন। এখনও সেখানকার মঠের প্রাচীরে এই সংবর্ধনার দৃশ্য আঁকা আছে। তিনি সেখানে মহাযান বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। তিনি বৌদ্ধশাস্ত্র, চিকিৎসা ও কারিগরিবিদ্যা সম্পর্কে তিব্বতি ভাষায় দুইশ’রও বেশি বই রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা করে তিব্বতবাসীদের মাঝে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। তিব্বতবাসীরা গৌতম বুদ্ধের পরেই তাঁকে স্থান দেয় এবং তাঁকে ‘জোবো ছেনপো’ বা মহাপ্রভুরূপে মান্য করে। তারা তাঁকে “অতীশ” উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি তিব্বতে বহু প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথি আবিষ্কার করেন এবং নিজ হাতে সেগুলির প্রতিলিপি করে বাংলায় পাঠান।
অতীতের তিব্বতের যেকোন আলোচনাতেই অতীশ দীপঙ্কর ঘুরে ফিরে আসেন। তিনি তিব্বতের ধর্ম, ইতিহাস, রাজকাহিনী, জীবনীগ্রন্থ, ও স্তোত্রনামা লেখেন। তাঁর মূল সংস্কৃত রচনাগুলি বর্তমানে বিলুপ্ত। তিনি তাঞ্জুর’ নামের বিশাল তিব্বতি শাস্ত্রগ্রন্থ সংকলন করেছিলেন। এই মহাগ্রন্থে দীপঙ্করের ৭৯টি গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ আছে। ১৩ বছর তিব্বতে বাস করার পর ১০৫৪ সালে বাহাত্তর বছর বয়সে তিব্বতের লাসা নগরীর অদূরে ঞেথাং বিহারে অতীশ দীপঙ্কর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৭৮ সালের ২৮শে জুন তাঁর পবিত্র দেহভস্ম চীন থেকে ঢাকার ধর্মরাজিক বৌদ্ধবিহারে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সাথে অনীত হয় এবং সেখানে এটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
সুত্রঃ চন্দ্রগর্ভ থেকে শ্রীজ্ঞান”
– ত্রৈমাসিক ঢাকা, ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, পৃষ্ঠা ১২ ও উইকিপিডিয়া