একতারাঃ বাঙালির লোকজ বাদ্যযন্ত্র। এক তার বিশিষ্ট বলে একে একতারা বলা হয়। এটি বাংলা লোকগীতির সাথে বহুল ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র। বাউল ভাবতেই একতারা মানপটে ভেসে ওঠে। একটি তার দ্বারা নির্মিত বলেই এটি একতারা নামে পরিচিত। বাড়তি লাউয়ের (লাউয়ের বস) খোলের নিচ দিকে থাকে চামড়ার আচ্ছাদন এবং লাউয়ের খোলের উপরিভাগে উলম্ব আকৃতির দুই বাহুবিশিষ্ট কোণ সদৃশ দুইটি বাঁশের পাত সংযুক্ত থাকে এবং লাউয়ের খোলের ঠিক ভিতরের দিক হতে দ্বিভুজের সাথে একটি তার সংযোজিত হয়। এটিকে লাউও বলা হয়ে থাকে।
ডুগডুগি আনদ্ধ বাদ্যযন্ত্র। লোকবাদ্য। গ্রামীণ সংস্কৃতিতে এর আবেদন রয়েছে। নির্মাণ উপাদান সহজলভ্য। একখণ্ড কাঠের মাঝখানে চাপা এবং দুই প্রান্ত একটু স্ফীত ফাঁপা থাকে। নিচের অংশ সরু দুইটি ছোটো আকারের পাটি বিপরীত মুখে একত্র করলে যেমন দেখায়, কাঠের টুকরার অবয়ব সেরকম। দুই প্রান্ত চামড়া দিয়ে ছাওয়া হয় এবং খোলের মাঝখানে এক খণ্ড সুতা বেঁধে তাতে এক টুকরা সিসা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এক হাতে খোলের মাঝখানে ধরে নাড়া দিলেই সুতায় ঝোলানো সিসার গুলি চামড়ার ঢাকা অংশে আঘাত করে। ফলে এক ধরনের শব্দ সৃষ্টি হয়। এই ধ্বনির সুললিত্ব-তাল-মদক-লয় ঠিক রাখার জন্য বাদকের হাত নাড়ানোর কৌশল জানা থাকতে হয়। ডমরু বাদ্যযন্ত্রটি যারা বানর বা সাপের খেলা দেখায়, তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ডমরু ডুগডুগি নামেও পরিচিত।
ঢাকঢোলঃ ঢোল চর্মাচ্ছাদিত এক প্রকার আনদ্ধ বাদ্যযন্ত্র। এটি বাংলাদেশের অন্যতম লোকবাদ্যযন্ত্র।। বিভিন্ন লোকসঙ্গীতের আসরে ঢোল এক প্রধান বাদ্যযন্ত্র। টাকডুম টাকডুম আওয়াজ শুনলেই বুঝা যায় কোথাও ঢোল বাজছে। ঢোল আর ঢাক অভিন্ন নয়।ঢোল ঢাকের চেয়ে ছোট। কিন্তু উভয় বাদ্যযন্ত্রেরই দুই প্রান্ত চামড়া দিয়ে ঢাকা থাকে। ঢাক বাজানো হয় দু’টি কাঠি দিয়ে একই প্রান্তে। বাংলা ঢোল নামে আরেকটি বাদ্যযন্ত্র আছে। বাংলা ঢোলের আকার সাধারণ ঢোলের চেয়ে বড়। বাংলা ঢোলের আওয়াজ সাধারণ ঢোলের চেয়ে গম্ভীর। এছাড়া ঢোলের চেয়ে ছোট আরেকটি বাদ্যযন্ত্র আছে, যার নাম ঢোলক। ঢোলক দেখতে একটি ছোট পিপার মতো। ঢোলকের দু’দিকের ব্যাস সমান, ঢেকে রাখা চামড়া তুলনামূলকভাবে পাতলা। ঢোলক বাজাতে কোনো কাঠি লাগে না, হাত দিয়েই বাজানো হয়। ঢোলক বেশি ব্যবহৃত হয় নাটক ও যাত্রাপালায়। গজল ও কাওয়ালী গানে ঢোলক এক অপরিহার্য বাদ্যযন্ত্র। ঢোল যে বাজায় তাকে বলে ঢুলি বা ঢোলি। ঢুলিরা সাধারণত ঢোলের দু’দিকে মোটা রশি বা গামছা বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে ঢোল বাজান। ঢোল বাজাতে ডান হাতে একটি কাঠি ব্যবহার করা হয়। বাম হাতের তালু দিয়ে অন্যপ্রান্ত বাজানো হয়। ঢুলিরা ঢোলের ডান দিক কাঠির বাড়িতে এবং একই সঙ্গে হাতের চাঁটিতে বাম দিকে ঢোল বাজিয়ে থাকে। বাংলাদেশের বিনয় বাঁশি ভারত উপমহাদেশের একজন সেরা ঢোলবাদক।
ঢোল একটি প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র। মধ্যযুগের বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যেও ঢোলের উল্লেখ পাওয়া যায়। পয়লা বৈশাখের লাঠিখেলা, হোলি খেলা, নৌকাবাইচ, কুস্তি, কবিগানের আসর, জারিগান, সারিগান, টপ্পাগান, আলকাপ গান, গম্ভীরা, ছোকরা নাচ, গাজনের গান, বাউলগান, মহররমের শোভাযাত্রা, যাত্রাগান, বিয়ের বরযাত্রা ইত্যাদিতে ঢোল বাজে। হিন্দুদের বিভিন্ন পূজা ঢোল ছাড়া চলেই না। বিশেষ করে দুর্গাপূজা ও কালীপূজায় ঢোল বাজানো হয়। এ দেশের হিন্দু, মুসলমান, আদিবাসী নির্বিশেষে বিভিন্ন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে ঢোল ব্যবহার করে। কয়েক বছর আগেও সরকারি কোনো আদেশ বা পরোয়ানা ঢোল বা ঢেড়া পিটিয়ে বিভিন্ন হাটে-বাজারে ঘোষণা করা হতো। ঢোলের আওয়াজ বহু দূর থেকে শ্রুত হয়।
তবলাঃ পুরাকালে তবলাকে তলমৃদঙ্গ বলা হতো। সুরের তাল-লয় ঠিক রাখাই তবলা ও বাঁয়ার উদ্দেশ্য। বলা হয় ১৩০০ খ্রীষ্টাব্দে সম্রাট আলাউদ্দীনের সময় পারস্যেদশীয় কবি ও সঙ্গীতবিদ আমীর খসরু তবলা আবিষ্কার করেন। কোন একদিন মৃদঙ্গ জাতীয় দুইদিক চামড়ায় ছাওয়া যন্ত্র ভেঙে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়, কিন্ত তার পরেও তা থেকে সুন্দর অওয়াজ বের হয়। শুনে মুগ্ধ খসরু বলেন “তব ভি বোলা”। ধারণা করা হয় “তব ভি বোলা” থেকেই তবলা শব্দটির উৎপত্তি। তবে এ নিয়ে মতভেদও আছে। তবলার চরম উৎকর্ষ সাধিত হয় ওস্তাদ সুধা খাঁর হাতে।
তবলা আনদ্ধ জাতীয় ঘাতবাদ্যযন্ত্র। দুই অংশে বিভক্ত। ডান হাতে বাজাবার অংশটিকে ডাইনা (ডাহিনা, ডাঁয়া)আর বাম হাতে বাজাবার অংশকে বাঁয়া / ডুগি বলে। ডাইনা অংশটি কাঠের তৈরী। উচ্চতা সাধারণত ৯-১২ ইঞ্চি। বায়া অংশটি মাটি কিংবা পিতলের। দুই অংশের উপর চামরার ছাউনি এবং কম্পন প্রলম্বিত করার জন্য গাব বা খিরণ দেয়া থাকে। চামড়া দিয়ে ঢাকা আস্তরণের প্রান্ত ঠুঁকে স্বরের উচ্চতা ও লঘুতা ঠিক রাখা হয়। তবলার বিশেষত্ব এর জটিল অঙ্গুলিক্ষেপনজাত উন্নত বোল। আঙুল দিয়ে বাজানো হয় বলে একে তঙ্কারযন্ত্রও বলা হয়।
তবলা বাদক শিল্পীকে বলা হয় তবলিয়া। তবলচি শব্দটি আগে একই অর্থে প্রচলিত ছিল, কিন্তু বাইজীগান বা খেমটানাচের সঙ্গতকারীদের জন্য বেশী ব্যবহৃত হওয়ায় অনেকে একে অশ্রদ্ধাজনক বলে মনে করেন, তাই তবলচির বদলে তবলিয়া শব্দটির চল হয়।
গানের মত তবলার কম্পোজশান আছে, সেগুলোকে কায়দা বা রেলা বলে। এর বোলগুলো রেলা, কায়দা, গৎ, আঁড়ি, কুআঁড়ি ও গৎপূরণ নামে পরিচিত। কায়দা একটু ধীরে বাজে, রেলা খুব দ্রুত বাজে। এখানে শুনছেন একটা ফরুক্কাবাদ ঘরনার কায়দা। ঘরানা হল স্টাইল। এই স্টাইলের প্রবর্তক ওস্তাদ কেরামত উল্যাহ খাঁ। যেমনঃ ধা ধিন ধিন না, ধা ধিন ধিন না, না তিন তিন না, তেটে ধিন ধিন না।।
মুরলীঃ যে বাঁশির ওপর গাঁট বন্ধ থাকে, মুখরন্ধ্র যা আঁড়ভাবে ধরে ঠোঁট খানিকটা বাঁকিয়ে ফুঁ দিয়ে বাজাতে হয়, তার নাম আঁড়বাঁশি। একে অনেক জায়গায় মুরলীও বলা হয়। আঁড়বাঁশিতে ফুঁ দেওয়ার ছিদ্রটি বাঁশির শেষ প্রান্তে না করে প্রায় দুই ইঞ্চি ভেতরে বাঁশির গায়ে করা হয়। বাজানোর সময় এই ছিদ্রটি দুই ঠোঁটের কাছে নিয়ে ফুঁ দিতে হয়। এই বাঁশিতে স্বরস্থানে ছয়টি ছিদ্র থাকে। এটা খাড়া করে ধরা হয় না। অনেকটা মাটির সঙ্গে সমান্তরাল করে মুখ ও দেহের ডানদিকে প্রসারিত করে পাশাপাশি ধরে বাজানো হয়।
মন্দিরাঃ ধাতু নির্মিত ঘণ জাতীয় এক ধরণের ঘাত বাদ্যযন্ত্র যা করতালের চেয়ে আকারে ছোট। যা মূলতঃ তাল যন্ত্র হিসাবেই ব্যবহৃত হয়। এগুলো মূলত তামা বা কাঁসা দিয়ে তৈরী। দুই হাতে দুটো ধরে গান বা বাজনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাজানো হয়।ঘন বাদ্যযন্ত্র। কাঁসার তৈরি। মন্দিরা বলতে এক জোড়া ক্ষুদ্রকায় পিতলের বাটি জাতীয় তালবাদ্যকেই বাজানো হয়। বাটিগুলোর নিচে ছোট ছিদ্র করে দড়ির হাতল দিয়ে আটকানো। বাজানোর সময় দুই হাতের আঙুলের মধ্যে রজ্জুর তৈরি হাতলগুচ্ছ আটকিয়ে বাটিগুলোকে আঘাত করা হয়। বাটির দেয়াল খানিকটা পুরু হওয়ায় মন্দিরায় বেশ উঁচু পর্দার শব্দ হয়। ঢোলক, মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ ও তবলা বাঁয়ার সঙ্গে তাল দেওয়ার জন্য মন্দিরা ব্যবহার করা হয়। তাল, লয় ও ছন্দ নির্ধারণে মন্দিরা সহায়ক বাদ্য। এটাকে খঞ্জনিও বলা হয়। আবার অনেক জায়গায় একে জুড়িও বলা হয়। মন্জিরাকে ভরতনাট্যমে তালাম বলে।
সরোদঃ উপমহাদেশের একটি অন্যতম জনপ্রিয় ক্লাসিকাল বাদ্যযন্ত্র। যন্ত্রটি চার থেকে সাড়ে চার ফুট লম্বা। পটারী অংশ ধাতব পাতে মোড়ানো থাকে। নিম্নাংশ গোলাকার। খোদাই করে ফাঁপা করা। এর উপর থাকে চামড়ার ছাউনি। তার উপর সওয়ারী বসিয়ে দন্ডের উপরিভাগে তার গহনের সাথে প্রধান তারগুলি সংযুক্ত করা হয়। পটারী ধারের সাথে খোল পর্যন্ত কোনাকুনি টানা থাকে লোহার তৈরী তরফের তার। প্রধান তারগুলো লোহা ও পিতলের তৈরী। সরোদের সুমিষ্ট ও গম্ভীর ধ্বনি উচ্চাঙ্গ সংগীতের জন্য উপযুক্ত। বাংলাদেশে যে ক’জন অসাধারণ সরোদ শিল্পী জন্মেছেন তার মধ্যে রয়েছেন প্রায়ত আলি আকবর খান ও জীবিত খ্যাতিমানদের অন্যতম হচ্ছেন উপমহাদেশের বরেণ্য সুর সাধক ওস্তাদ আয়েত আলী খার পৌত্র শাহাদাত হোসেন খান।
সারিন্দাঃ ততযন্ত্র। বাংলাদেশের গ্রামীণ লোকসমাজে সারিন্দা জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র। লম্বায় প্রায় দুই ফুট। আস্ত এক কাষ্ঠখণ্ডকে কেটে এবং নিম্নভাগে খোদাই করে বাদ্যটির ধ্বনিকুম্ভ তৈরি হয়। কিন্তু দোতারা প্রভৃতি বাদ্যের সম্পূর্ণ খোলা অংশে চামড়ার ছাউনি লাগানো হয় না; বরং এর সরু অংশই ক্ষুদ্রাকারে চামড়ার ছাউনি যুক্ত করা হয়। ছাউনির ওপর সওয়ারি সংস্থাপন করা হয়। এর মাথাটি বেশ কারুকার্যখচিত। জীবজন্তু বা পাখির আকৃতি খোদাই করা। সাধারণত তিনটি তার থাকে এতে। মাথার কারুকার্যখচিত অংশে তিনটি কাঠের বয়লা বা কান লাগানো থাকে। বয়লা থেকে তিনটি তার সওয়ারির ওপর দিয়ে সারিন্দার শেষ প্রান্তে আবদ্ধ অংশটায় আটকানো থাকে। এর তারগুলো চামড়ার। কান ঘুরিয়ে প্রয়োজন মতো তার বা তাঁতকে চড়ানো বা নামানো যায়। এতে কোনো পর্দা থাকে না। সারিন্দা ছড়ের সাহায্যে বাজাতে হয়। ছড়টি দেখতে অনেকটা ধনুকের মতো। ছড়ে ঘোড়ার লেজের চুল ব্যবহার করা হয়। পটরির ওপর বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে তার টিপে ডান হাতে ছড় টেনে সারিন্দা বাজানোর নিয়ম। ঢাকা এবং ঢাকার নরসিংদী অঞ্চলের সারিন্দা উল্লেখযোগ্য।
দোতারাঃ একটি বহুল ব্যবহৃত লোকপ্রিয় তত শ্রেণীর বাদ্যযন্ত্র। সরদের ন্যায় দেখতে এ যন্ত্রটির নাম দোতারা হলেও এতে দুই, চার বা পাঁচটি তারও ব্যবহার করা হয়। পটারী বা দন্ডের মত অংশটি কাঠের। তার উপর ধাতব পাত মোড়ানো থাকে। নিচের গোল অংশে চামরার ছাউনি থাকে। এর উপর সওয়ারী বসিয়ে তার উপর দিয়ে টান করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কান এর সাথে তার পেচিয়ে দয়া হয়। লোক সংগীত বলতেই দোতারার অনুষঙ্গ আবশ্যিক হয়ে ওঠে।
সেতারঃ উত্তর ভারতীয় সংগীতে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ততবাদ্যযন্ত্র। দুটি চিকারীর তার(সা গা তে সুর বাঁধা থাকে)সহ প্রধান তার সংখ্যা সাত। তিন থেকে চার ফুট লম্বা ফাপা কাষ্টদন্ডকে তবলীযুক্ত লাউ এর সংগে যুক্ত করে সিতারের অবয়ব গঠন করা হয়। যন্ত্রের নিম্নাংশে সাতটি তার সওয়ারীর উপর দিয়ে যন্ত্রের উর্ধাংশের সাতটি চাবির সাথে যুক্ত করা হয়। দন্দে বসানো ১৯টি সারিকার সাহায্যে স্বরের অবস্থান স্থির করা হয়। সিতারে ১১, ১৩ অথবা ১৫টি তরফের তার থাকে। বাম হাতের আঙ্গুল দিয়ে সারিকার সাথে তার চেপে ধরে ডান হাতের তর্জনীতে মিজরাব লাগিয়ে আঘাত করে সিতার(Sitar) বাজানো হয়।সেতারের উৎপত্তি নিয়ে নানা মত রয়েছে। তবে মোটামোটি গ্রহণযোগ্য ইতিহাস হলো যে, মোগল সম্রাজ্যের শেষদিকে উপমহাদেশে সেতারের প্রচলন হয়। মোগল সম্রাটদের রাজ দরবারে পারসিয়ান ল্যূট (বীণা জাতীয় বাদ্য) বাজানো হতো। সঙ্গীত সুদশর্ণা গ্রন্থে বলা আছে যে,অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফকির আমীর খসরু (ইনি ১৩০০ শতকের সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজীর সভাসদ সঙ্গীতজ্ঞ নন) সেতারের আবিষ্কার করেন। এই ফকির আমীর খসরু তানসেনের বংশধর। এটাই সবর্জন স্বীকৃত যে পারস্যের সেহতার হতেই সেতারের সৃষ্টি করা হয়েছে। এরপর হতেই সেতারের উন্নয়ন ও পরিবর্তন হয়ে আসছে। ফকির আমীর খসরুর পৌত্র মসিদ খানের হাতেও সেতারের উন্নয়ন ও পরিবর্তন ঘটেছে। মূলত বাজানোর ঢঙের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই সেতারের উন্নয়ন ও পরিবর্তন ঘটেছে। তাঁর ছেলে বাহাদুর খানও তা বজায় রাখেন। তানসেনের আরেক বংশধর রাজা খান ১৮০০ – ১৮৫০ সাল সময়কালে লক্ষ্মৌতে বাস করছিলেন। তিনি সেতারকে দ্রুতগতির গৎ বাজানোর উপযোগী করেছিলেন।
সন্তুরঃ হার্প জাতীয় বাদ্যযন্ত্র। গঠনাকৃতি অনেকটা সুরমন্ডলের মত। এর তারের সংখ্যা ২৪ থেকে ৩০ বা তারও বেশী হতে পারে। একে শততন্ত্রী বীণাও বলা হয়। যেমনঃ এক তার হলে একতারা, দুই তারে দোতারা- এভাবে শত তারে শততন্ত্রী। পারস্যেও এই ধরণের বাদ্যযন্ত্র রয়েছে যার পার্সিয়ান নাম সন্তুর(سنتور)। এই নাম থেকেই শততন্ত্রী বীণা সন্তুর নামেই পরিচিত। এই যন্ত্রটি কাঠের তৈরি এবং ট্রাপিজয়েড আকৃতির হর আর সুরের দ্যোতনা সৃষ্টির জন্য তারের বিভিন্ন সন্নিবেশ এবং যান্ত্রিক প্রকৌশল রয়েছে। কাশ্মিরের লোকগীতিতে সন্তুর স্থান দখল করে আছে। কাশ্মিরী সন্তুর পার্সিয়ান সন্তুরের চেয়ে অনেকটা আয়তাকার। পার্সিয়ান সন্তুরে যেখানে ৭২টি তার সেখানে কাশ্মীরী সন্তুরে আরও বেশি তার যুক্ত করা যায়। দুটো জোড়া তার এক সুরে বাধা হয়। রাগ রাগীনির সাথে সামজ্ঞস্য রেখে সুর বাধা হয়। তারগুলো একটা কাঠের বোর্ডের কীলকে আবদ্ধ থাকে। সুর তিন সপ্তকে মিলাতে হয়। দুটো কাঠি দিয়ে সন্তুর বাজানো হয়।
বাংলাদেশে এই যন্ত্রের খুব একটা ব্যবহার দৃষ্টিগোচর হয়নি। তবে বিটিভির বিভিন্ন প্রামান্য অনুষ্ঠানের নেপথ্য বর্ণনার সাথে এই বাদ্যের ব্যবহার শ্রুত হয়েছে। ভারতের কয়েকজন নিবেদিত প্রাণ কলাকার এই বাদ্যযন্ত্রকে বিশ্বের কাতারে নিয়ে গেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন- পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা, ভজন সপরি, রাহুল শর্মা, কিরণপাল সিং দেওরা প্রমুখ।
সুরবাহারঃ সুরবাহার হচ্ছে সেতারের মতো দেখতে একটি তারযন্ত্র। এটা বেইজ সেতার হিসাবেও পরিচিত। উত্তর ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে এর ব্যবহার হয়। সেতারের মতো দেখতে হলেও এর স্বর বেশ নিম্ন। সুরবাহার লম্বায় ৫১ ইঞ্চি, শুকনো লাউয়ের তুম্বাটি সুর কম্পনের জন্য ব্যবহৃত হয়। লম্বা ডান্ডিটি সাধারণত সেগুণ কাঠের হয়ে থাকে। সুরবাহার তৈরী হয়েছিল ১৮২৫ সালে । মনে করা হয় যে ওস্তাদ সাহেবদাদ খানই এ যন্ত্রটি তৈরী করেন। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা যায় যে লক্ষ্মৌর সেতার বাদক ওস্তাদ গোলাম মোহাম্মদ সুরবাহার সৃষ্টি করেন।
শঙ্খঃ প্রাচীন শুষির শ্রেণীর বাদ্যযন্ত্র শঙ্খ। লোকবাদ্য এবং সেই সঙ্গে শঙ্খের অলঙ্কার নিয়ে লোকশিল্প হিসেবে বাংলা এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে শঙ্খের গভীর সম্পর্ক ছিল, যার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রাচীন গ্রন্থ, শিল্প, সাহিত্য, ভাস্কর্য ও চিত্র থেকে। মৃত শঙ্খের খোলসই শঙ্খবাদ্য। শঙ্খের নাভির কাছে ছিদ্র করে ফুঁ দিয়ে বাজাতে হয়। এক ধরনের সামুদ্রিক ঝিনুকের খোলস থেকে এ বাদ্যযন্ত্রটির উৎপত্তি। এ ঝিনুকের মুখটি বাঁকা ছিদ্রবিশিষ্ট। ভেতরের ছিদ্রপথও বাঁকা। মুখ দিয়ে ফুঁ দিলেই মিষ্টি-মধুর শব্দ হয়। ঠোঁট দিয়ে জোরে চেপে ফুঁ দিতে হয়। সাধারণত এই ঝিনুকের রং সাদা এবং কিছুটা বাদামি। অনেকে একে কম্বু ও শাঁখ বলে। তিন দিনব্যাপী এই মেলা দেখতে আসে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। অনেকেই সন্তানদের মেলায় নিয়ে আসে গ্রামীণ এই বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। উদ্বোধনী ও সমাপনী দিনে সঙ্গিতানুষ্ঠান ছিল প্রাণকাড়া। তবে অনেকের মতে এটাকে মেলা না বলে প্রদর্শনী বললে হয়তো আরো ভালো হতো।
তানপুরাঃ তানপুরা হচ্ছে এক ধরনের তার যন্ত্র । এই বাদ্যযন্ত্রটি পৃথিবীর বেশ কিছু অঞ্চলে দেখা যায়। এগুলো হচ্ছে বসনিয়া হার্জেগোভিনা, ক্রোয়েশিয়া এবং সার্বিয়া, বুলগেরিয়া এবং ভারত । ভারত ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলে এটি ল্যূট জাতীয় প্লাক যন্ত্র হিসেবে দেখা যায়। কিন্তু ভারতে এটা দেখতে অনেকটা সেতারের মতো আকৃতির । দক্ষিণ ভারতে তাম্বুরা এবং অন্যান্য অঞ্চল ও বাংলাদেশে এটা তানপুরা হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলে তানপুরা মূলতঃ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সঙ্গতকারী যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় ।সেতারের মতো দেখতে লাউয়ের তুম্বার উপরে একটি ডান্ডি যুক্ত করে তাতে চারটি তার লাগিয়ে তানপুরা তৈরী করা হয়।
এস্রাজঃ ইস্রাজ হচ্ছে একটি তার যন্ত্র। এই যন্ত্রটি মূলতঃ ভারতীয় উপমহাদেশেই ব্যবহৃত হয়। এর উৎপত্তিও খুব বেশী দিন আগে নয়। আনুমানিক ২-৩ শত বৎসর আগে, হাজার বছর ধরে প্রচলিত সারেঙ্গীর সরলরূপ হিসাবে যন্ত্রটি আবিষ্কৃত হয়।বলা হয় এস্রাজ সিতার ও সারেঙ্গীর সমন্বিত রূপ। এস্রাজের ব্যবহার দেখা যায় মূলতঃ পূর্ব ও মধ্য ভারতে এবং বাংলাদেশে । এটি তারের ওপর ছড় টেনে বাজাতে হয়। মূলতঃ সঙ্গতকারী যন্ত্র হিসেবেই এস্রাজ ব্যবহৃত হলেও এটিতে পূর্ণ গানের সুর তোলা সম্ভব। রবীন্দ্র সঙ্গীতের সঙ্গে এস্রাজের সঙ্গত শ্রুতিমধুরতা সৃষ্টি করে।
এস্রাজ এবং দিলরুবা উভয়েরই কাঠামো ও গঠন শৈলী প্রায় অভিন্ন। মাঝারী আকৃতির সেতারের মতে ডান্ডির উপর ২০টি ধাতব ঘাট বেঁধে দেয়া হয়। এগুলোর উপর ১২ থেকে ১৫টি সহমর্মী সুরের বা তরঙ্গের তার বাঁধা হয়। দিলরুবায় অবশ্য এরচেয়ে বেশী সংখ্যক তার ব্যবহৃত হয় (১৯), এ কারণে দিলরুবার পাটাতনটি একটু চওড়া হয়ে থাকে। দু’টো যন্ত্রেই প্রধান তার চারটি। এগুলো বেহালার মতো ছড়ের সাহায্যে বাজানো হয়। নিচের অংশ সেতারের লাউয়ের তুম্বার পরিবর্তে কাঠের ছোট তুম্বাকৃতির খোলের উপর তবলার উপরিভাগের মতো ছাগলের চামড়ার ছাউনি দিয়ে টান টান করে বাঁধা হয়। উল্লেখযোগ্য যে সারেঙ্গীতে ব্যবহৃত হতো প্রাণীজ তার, অন্যপক্ষে এস্রাজ ও দিলরুবায় ধাতব তার ব্যবহার হয়। বাদক জোড় আসনে বসে বাজিয়ে থাকেন। বাম কাধেঁ যন্ত্রের গ্রীবাটির ভর রেখে ভূমিতে এস্রাজ স্থাপন করা হয়। এরপর ডান হাতে ছড় টানা হয় এবং বাম হাতে তারের বিভিন্ন স্থানে স্পর্শ করা হয়।
শানাইঃ শানাই ছাড়া বাঙ্গালীর বিয়ের অনুষ্ঠানের কথা ভাবা যায়না। দুই রিড যুক্ত বংশী শ্রেণীর লোকফুৎকার বাদ্য শানাই কাঠের তৈরী এবং দেখতে অনেকটা ধুতুরা ফুলের মতো। ওপরের দিক চিকন নিচে দিক ক্রমশ চওড়া। লম্বায় দেড় ফুটের মতো। লোকবাদ্য সানাই বর্তমানে রাগসঙ্গীতযন্ত্র হিসাবে অত্যন্ত জনপ্রিয়। অন্যতম শ্রেষ্ট পাশ্চত্য বাদ্যযন্ত্র। ১৬০০ থেকে ১৭৫০ সালের মধ্যে ইটালীর সুনিপুন যন্ত্রবিদগন এই যন্ত্রকে বর্তমান রূপে আনয়ন করেন। এর তার থাকে ৪টি। দুটি তারের, একটি লোহার ও একটি নিকোলের। ডান হাতে ছড়(ধনুক তন্তু) চালিয়ে বাঁ-হাতে ফিঙ্গার বোর্ড বা পটারীতে আঙ্গুল টিপে বেহালা(Violin) বাজাতে হয়। বিদেশ হলেও বর্তমানে এটি প্রায় দেশ বাদ্যযন্ত্রে পরিনত হয়ে গেছে। যন্ত্র সংগীতে বেহালা একটি জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র। যার সুরের মূর্চ্ছনায় মন হারিয়ে যেতে চায়। যার করুণ সুর সহজেই সবার আবেগকে জাগিয়ে তোলে মায়াবি দোলায়। সিনেমা, নাটক, গান সহ সুরের সকল জগতে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো সহজ সরলভাবে ফুটিয়ে তুলতে বেহালার জুরি মেলা ভার। বেহালার সুর শুনে তাই কখনো মন অজান্তেই কেঁদে উঠে কিংবা দুঃখবোধ জাগ্রত হয়ে উঠে।
বেহালাঃ বেহালার ইংরেজী নাম ভায়োলিন। যার সুর শুনে আমরা মুগ্ধ হই, যার সুর শুনে ব্যথায় মন ভরে উঠে সেই যন্ত্রের সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান শিল্পীমনের সকলের জানা উচিত। তবে, আগে পরিস্কার করে নেই যন্ত্র সংগীত চার ধরণের হয়। যার মধ্যে তার দিয়ে তৈরি কিছু বাদ্যযন্ত্র দেখা যায় তাকে সংগীতের ভাষায় বলে তত্ যন্ত্র যেমন বেহালা, গীটার। বেহালার উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত লক্ষ্য করা যায়। কেউ কেউ বেহালাকে ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র, কেউ কেউ আরব যন্ত্র, কেউবা ইউরোপীয় বাদ্যযন্ত্র বলে থাকেন। ভারতীয় মতে, বেহালার উদ্ভব হয়েছে রাবনের আমল থেকে। কারণ প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে লঙ্কাধিপতি রাবন দুই তার বিশিষ্ট একটি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতেন যা ছিল ঠিক বেহালার মতো। বেহলার সুর বাহুতে লীণ হয়ে যায় বলে ভারতীয়দের মতে বেহালা হচ্ছে বাহুলীণ। আবার অন্য এক মতে দেখা যায় আরবরা যখন স্পেন দখল করে তখন ইউরোপ ও মুসলিম সংস্কৃতির যে ধারা প্রবাহিত হয় সেখানে তিন তার বিশিষ্ট একটি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হতো যা ছিল বেহালার মতো। তাই আরবরা কিংবা মুসলিমরা মনে করে এটি একটি আরবীয় যন্ত্র।
তবে যে যাই মতামত প্রকাশ করুক বর্তমান বেহালার সর্বসম্মত বৈজ্ঞানিক রূপ ধারণে সর্বপ্রথম যিনি বেহালার গঠনশৈলী ও সুরারোপে আকর্ষনীয় ভাব তৈরি করেছেন তিনি হলেন ফ্রান্সের ক্রিমোনা শহরের আন্দ্রে আমেতি। তিনি তৎকালীণ অভিজাত মেডিচি রাজ পরিবারের সহযোগিতায় বেহালার সুরকে আকর্ষণীয় করে গঠন প্রণালীর উন্নতি সাধন করেন। এক্ষেত্রে আন্দ্রে আমেতিকে আধুনিক বেহালার জনক বললে ভুল বলা হবে না। এরপর গবেষণার মাধ্যমে গাণিতিক অনুপাতের সঠিক প্রয়োগে বেহালার বেশ কিছু আঙ্গিকগত উন্নতি করেন আন্দ্রে আমেতির পুত্র অ্যান্টোনিও আমেতি ও তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার গিরোলামো। এরপর গবেষণায় লিপ্ত থাকেন অ্যান্টোনিও পুত্র প্রথম হিয়েরোনিমাস আমেতি, তাঁর দৌহিত্র নিকোলা আমেতি। আনুমানিক ১৭০০ সালের দিকে বেহালার প্রথম বৈপ বিক উন্নতি সাধন করেন আন্দ্রে আমেতির প্রপৌত্র নিকোলা আমেতির ছাত্র অ্যান্টোনিও স্ট্র্যাডিয়াভ্যারিয়স। এর সাথে সাথে বেহালা বাজাবার যে ছড়ি রয়েছে যাকে ইংরেজীতে ভায়োলিন বলে তার উন্নতির কাজ চলতে থাকে। জানা যায় ১৭৮০ সালে প্যারিসের ফ্রাঁসোয়া তুর্তে বেহালার ছড়ির ব্যাপক সংস্কার করেন। যেখানে আমরা বর্তমান বেহালার চিত্র দেখতে পাই।
বাঁশি এক ধরনের সুষির অর্থাৎ ফুৎকার (ফুঁ) দিয়ে বাজানো যায় এমন বাদ্যযন্ত্র । বাঁশ (বংশ) দিয়ে তৈরি হত সেই কারণে এর নাম বাঁশি । বাংলায় বাঁশিকে মুরালি, মোহন বাঁশি, বংশী অথবা বাঁশরিও বলা হয় । বাঁশির পাশ্চাত্য সংস্করনের নাম ফ্লুট(flute)। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাঁশি তৈরিতে তরলা বাঁশ ব্যবহার করা হয় । কেউ কেউ সখের বশে ষ্টিলের, তামার, পিতলের, রূপার এমনকি সোনার পাইপ দিয়েও বাঁশি তৈরী করিয়ে থাকেন । এই প্রাচীন এবং মনহরানো বাদ্যযন্ত্রের গায়ে সাতটি(মাঝে মাঝে আটটিও করতে দেখা যায়) ছিদ্র থাকে । যে নল বা পাইপটি দিয়ে বাঁশি তৈরী করা হয় তার একপাশ সম্পূর্ণ আটকে বায়ুরোধী করে দেওয়া হয় । বাঁশের তৈরী বাঁশিতে গিট বা গিরা একপাশকে বায়ুরোধী করার কাজে ব্যবহার করা হয় । বন্ধ এবং খোলা প্রান্তের মাঝামাঝিতে ছিদ্রগুলো করা হয় । যে ছিদ্রটি বন্ধ প্রান্তের ঠিক কাছাকাছি থাকে সেটা দিয়ে নিয়মানুযায়ী ফু দিতে হয় এবং বাকি ছ’টি ছিদ্র ডান হাতের মধ্যবর্তী তিনটি এবং বাম হাতের মধ্যবর্তী তিনটি আঙ্গুল দিয়ে কখনো আটকে কখনো ছেড়ে দিয়ে সুর তুলতে হয় । বাঁশি বাজানোর কৌশল রপ্ত করতে হলে গুরুর স্মরণাপন্ন হবার বিকল্প হয়না ।