হেঁয়াকো খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার অন্তর্গত। রামগড় থেকে ১৬ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলা সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে। করেরহাট-রামগড় সড়ক হেঁয়াকোতে এসে উত্তর দিকে বাঁক নিয়ে আবার পূর্ব দিকে গেছে। পাহাড়ি এলাকা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভৌগোলিক ও সামরিক দিক থেকে হেঁয়াকো ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কাছেই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। সেখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুরক্ষিত একটি ঘাঁটি। মোতায়েন ছিল বিপুলসংখ্যক সেনা ও তাদের সহযোগী।২৭ জুলাই এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা হেঁয়াকোর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওই ঘাঁটিতে অতর্কিতে আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সেনারা কল্পনাও করেনি মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে আক্রমণ করবে। কারণ, হেঁয়াকো বেশ দুর্গম ও মিজো-অধ্যুষিত এলাকা। মিজোরা তাদের সহযোগী। মুক্তিযোদ্ধা ছিল মাত্র এক প্লাটুন। অন্যদিকে ওই ঘাঁটিতে পাকিস্তানি সেনা ও সহযোগী (প্রশিক্ষিত মিজো) মিলে ছিল তিন গুণেরও বেশি। প্রায় ১২ মাইল দূর থেকে এসে মুক্তিযোদ্ধরা সেখানে অতর্কিতে আক্রমণ চালান।
তাঁরা আক্রমণ করামাত্র পাকিস্তানি সেনারাও তৎপর হয়ে ওঠে। তখন সেখানে ২০ মিনিট তুমুল যুদ্ধ হয়। আক্রমণে চারজন পাকিস্তানি সেনা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। সেখানে ছিল সেনাবাহিনীর কয়েকটি গাড়ি। মুক্তিযোদ্ধাদের ছোড়া মর্টারের গোলার আঘাতে বেশির ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত এবং একটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। সেদিন যুদ্ধে এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান দলনেতা হিসেবে যথেষ্ট সাহস ও দক্ষতা প্রদর্শন করেন। যুদ্ধ চলাবস্থায় পাকিস্তানি সেনা ও মিজোরা মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট দলটিকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। তখন তিনি সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন। তাঁর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ও বুদ্ধিমত্তায় সহযোদ্ধারা চরম বিপর্যয় থেকে রক্ষা পান। পাকিস্তানি ও মিজোদের মতলব বুঝতে পেরে এবং পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান সঙ্গে সঙ্গে সহযোদ্ধাদের নিয়ে দ্রুত পেছনে হটে যান। এর ফলে কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নিজেদের শিবিরে ফিরে যেতে সক্ষম হন।
এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল চট্টগ্রামের ষোলশহরে। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধ যুদ্ধকালে চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। এর মধ্যে কৃষি ভবনে হামলা, মহালছড়ির যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। প্রতিরোধযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। এরপর ভারতে যান। সেখানে সংগঠিত হওয়ার পর তিনি ১ নম্বর সেক্টরে প্রথমে শ্রীনগর এবং পরে মনুঘাট সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমানকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ১৩। এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৮১ সালে জিয়া (জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) হত্যা ঘটনায় কথিত অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত ও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলায় (জন্ম: কটিয়াদি উপজেলায়)। উত্তরাধিকারীদের বর্তমান ঠিকানা: বাড়ি ১০৯, দ্বিতীয় তলা, সড়ক ৪, ক্যান্টনমেন্ট মার্কেট এরিয়া, ঢাকা সেনানিবাস। তাঁর বাবার নাম (মাওলানা) সাইদুর রহমান, মা রেহান আরা খাতুন। স্ত্রী আনোয়ারা বেগম। তাঁদের এক মেয়ে, তিন ছেলে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস,
সেক্টর ১ এবং মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক।