হয়রত শাহ শামুসুদ্দীন বুখারী (রা), বাংলার বার ভুইয়ার অন্যতম বীর ঈসা খাঁ এবং রাজা নবরঙ্গ রায়ের স্মৃতি বিজড়িত অরণ্যে ঘেরা অপরূপ প্রাকৃতিক  লীলাভূমি এই কটিয়াদী অঞ্চল।  প্রাচীন আমল থেকেই কটিয়াদী এলাকার মানুষ কৃষি, শিল্প এবং ব্যবসা – বাণিজ্যের সাথে জড়িত।  ইতিহাসের সাক্ষ্য প্রমাণে দেখা যায়, প্রায় ৩ হাজার বছর আগে থেকেই কটিয়াদীতে মানুষের বসবাস শুরু হয়।  ১৮৬০ সনে কিশোরগঞ্জ মহকুমা প্রতিষ্টাকালে আজকের কটিয়াদী অঞ্চল ছিল নিকলী থানার অধীনে।

kotiyadi

১৮৭১ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত জেম্‌স জে, রেনেলের অবিভক্ত বাংলাদেশের ভোগোলিক মানচিত্র বর্তমানে কিশোরগঞ্জ জেলার যে কয়টি স্থান বা জনপদ আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়টি স্থানের একটি কটিয়াদী যা CUTTEYADEE হিসেবে দেখানো হয়েছে।   নাম আবিষ্কার একটি দর্শন।  এই দর্শন মানুষের চেতনায় কখন এসে ধরা দেয় তার তত্ত্ব আজ হয়তো জানার কোন উপায় নেই।  মানুষ যেদিন বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতো সেদিন মানুষ ছিল অনেকটাই ভাষাহীন।  সেদিন নাম বলে মানুষের কাছে কিছুই বোধগম্য ছিলনা। শুধুমাত্র পরিচয়ই ছিল চেনা জানার মাধ্যম।  কালক্রমে মানুষ যখন শব্দ ও ভাষার সঙ্গে পরিচিতি লাভ করল সেদিন থেকেই নামের সূত্রপাত।  আজ বিশ্বজুড়ে নামের বাহার দেখে মনে হয়না যে নাম ও মানুষের কত কঠিন আবিষ্কার।  কেননা নামাঙ্কিত হয়ে কেউতো পৃথিবীতে জন্নায় না।  কেউ কেউ নামকে আবিষ্কার করে।  আজ পৃথিবীর সমুদয় গাছপালা, নদীনালা, সাগর, পাহাড় – পর্বত, আকাশ বাতাস, জীবজন্তু যেমন নামকে কেন্দ্র করে পরিচিত হয়ে উঠেছে একদিন তো তেমন ছিল না।  একদিন তো সত্যিই নামহীন ছিল পৃথিবী।  নামহীন ছিল আমাদের কটিয়াদী।

কটিয়াদী নামকরণের ব্যাপারে বিভিন্ন জনশ্রুতি রয়েছে।  কেউ বলেন, প্রাচীনকালে আড়িয়ালখা নদীর তীরে আসন গড়েছিলেন কটি ফকির নামে কামেল দরবেশ।  কথিত আছে এই কটি ফকির আধ্যাত্বিক সাধনের মাধ্যমে মানুষের উপকার করতেন।  এই কটি ফকিরের নামানুসারেই কটিয়াদী নামের উৎপত্তি হয়।  আবার কেউ বলেন, কটিয়াদী ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ইংরেজ সাহেবদের অনেকগুলো নীলকুঠি ছিল।  নীলকুঠির নীলকর সাহেবদের প্রতিদিন প্রয়োজনীয় কেনা – কাটার জন্য আড়িয়ালখা নদের উত্তরপাড়ে গড়ে উঠে ছোট্ট একটি বাজার। এই নীল কুঠির কুঠি থেকে কুঠিয়াদী এবং পরবর্তীতে কটিয়াদী নামে পরিচিত। আবার কেউ কটিয়াদীর নামকরণের ব্যাপারে অন্য মত পোষণ করেছেন। “শতাব্দীর অন্তরালে’’ গ্রন্থে কবি আবদুল হান্নান উল্লেখ করেছেন –

আজ হতে আটশত ব্যসর পূর্বে এগার সিন্দুরের প্রাচীন ইতিহাসে সামন্ত কোচ রাজ্যদের মধ্যে বেবোধী নামে এক রাজার নাম রয়েছে।  তিনি অত্যন্ত সম্মানিত রাজা ছিলেন।  আমরা লক্ষ করছি যে, বেবোধী শব্দটির শেষ অংশটা ধী দ্বারা পূর্ণ।  আর এই ধী বা দি শব্দটির বহুল প্রচলন দেখা যায় বিভিন্ন নাম ও স্থানের পাশে।

যেমন- নরসিংদী, মাধবদী, পুরাদী, মনোহর্দী, হোসেনদী, তারাকান্দি, বিন্নাদী, গোলাপদী, নারান্দী, পাকুন্দী, রামদী সাগরদী এবং কটিয়াদী।  এমন অনেক নামের সংগে এই দী’র বহুল প্রচলন আছে তাহলে নিশ্চিত যে এ দী’টি অতি সম্মানসূচক বলে ধরে নিতে হবে।  কারণ এসব নাম সাধারনত অর্থবোধক হয়।  আমরা  যদি বেবোধী রাজার দী’র দিকে তাকাই তাহলে ঐ দী’টিকে সম্মানসূচক বলে ধরে নিতে পারি।  যেমন, আজকে বাবুজী, নেতাজী, শেখজী ইত্যাদির জী’ গুলি সম্মানসূচক।  সেকালেও সম্মানসূচক অর্থে এই দী র ব্যবহার ছিল।  কিংবা সুন্দরের প্রতীক ছিল।  তাই ধারণা করা হচ্ছে যে, বেবোধী রাজার উত্তরসূরীগণ ‘দী’ শব্দগুলোর স্থানে বসবাস করিলে তাদের নামানুসারেই নামকরণ হয়। তাই কটিয়াদী নামকরণের দিকেও এই যুক্তি প্রমাণ রয়েছে।  এমনও হতে পারে কটি ফকির বেবোধী রাজার আত্নীয় বা উত্তরসূরী হিসাবে তার নামের প্রথম শব্দ কটি এবং রাজার ‘ধী’ উপাধি সংযুক্ত করে কটিধী থেকে পরবর্তী সময়ে কটিয়াদী নামকরণ হয়েছে।

আমরাতো কোন দিন আকাশ থেকে পড়িনি।  আমাদের শেখর আছে, অতীত ঐতিহ্য আছে।  সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই এগারসিন্দুর একটি সুউচ্চ লাল মাটির ভূমি।  খ্রিস্টপূর্ব থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত এগার সিন্দুরই ছিল বিশাল ভাটি রাজ্যের একমাত্র প্রবেশ দ্বার।  খাইবার গিরিপাস যেমন ভারতের প্রবেশদ্বার এগার সিন্দুর ও এ অঞ্চলের প্রবেশ দ্বার। এই এগারসিন্দুর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছে বিজেতা, এসেছে ধর্ম প্রচারক, বেনিয়া, ভাগ্যান্বেষী অন্তহীন মানব জাতি। তারা কালক্রমে এখানে বসতি স্তাপন করে গড়ে তুলে একটি মিশ্র জাতি। সে জাতির বর্তমান প্রজন্নই আমরা।

১৯-০৫-১৮৯৭ সনে কটিয়াদী থানার জন্ম। বর্তমানে ১ টি পৌরসভা, ৯ টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত কটিয়াদী উপজেলার আয়তন ২২৩ বর্গ কিলোমিটার। বিভিন্ন দিক দিয়ে ঐতিহাসিক এই কটিয়াদী নামটি দেশ – বিদেশে ছড়িয়ে আছে।  বাংলাদেশে কখন ও কোন সময়ে ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু হয় তার ইতিহাস সন্ধান করা খুবই কঠিন।  তবে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দে কটিয়াদী অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচারের সাক্ষ্য বহণ করে।

বংগের শ্রী হট্ট (বর্তমান সিলেট) অঞ্চলের রাজা গৌর গোবিন্দ তার রাজ্যের মুসলমানদের উপর এতই অত্যাচার করতো যে-  তা বলার অপেক্ষা রাখে না।  এ রাজ্যে ইসলামের মহান তাপস, হযরত শায়খ বুরহান উদ্দীন (রহ) এর নবজন্মা ছেলের আকিকাকে কেন্দ্র করে তাঁর নব জন্মা ছেলে শিশুটিকে রাজা গৌর গোবিন্দ হত্যা করে।  হযরত শায়খ বুরহান উদ্দীন সোনারগাঁয়ের শাসনকর্তার শরণাপন্ন  হন।  এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৩৬০ জন আউলিয়ার আগমন ঘটে। আর এ ৩৬০ জন আউলিয়ার মহান শিরমনি ছিলেন হযরত শাহ্‌ জালাল (রহ)।  তিনি সিলেটকে জয় করেছিলেন আধ্যাত্নিক ও সামরিক কৌশলে।  এই মহান আউলিয়া হযরত শাহ্‌ জালাল (রহ) এর সফর সঙ্গী ছিলেন হযরত শাহ্‌ শামসুদ্দীন বুখারী (রা)।  তিনি প্রথমে হযরত শাহ্‌ জালাল (রহ)এর সফর সঙ্গী হিসেবে শ্রী হট্ট (বর্তমান সিলেট) এবং পরবর্তী ৩ জন শহচর শাহ্‌ নাসির, শাহ্‌ কবির, শাহ্‌ কলকর সাথে নিয়ে ১২২৫ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান কটিয়াদী উপজেলার কুড়িখাই গ্রামে আসেন।  হযরত শাহ্‌ শামসুদ্দীন বুখারী (রা) কুড়িখাই গ্রামে এসে আস্তানা স্থাপন করে ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করেন।  এটি একটি জনশ্রুতির মর্যাদা রাখে।  কুড়িখাই মোগল আমল থেকেই পরগনা।

ধারণা করা হয়, তিনিই প্রথম গ্রামটির নাম রাখেন কুড়িখাই।  তার আগমনের পর থেকেই কুড়িখাই গ্রামের নামের উৎপত্তি ।  কথিত আছে, তিনিই এই অঞ্চলের সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্মের প্রচারক।  হযরত শাহ্‌ শামসুদ্দীন বুখারী (রা) ছিলেন বার আউলিয়াদের একজন।  তাহার মাজার কুড়িখাই গ্রামে।  এই মহান সাধক আউলিয়ার নামে প্রতি বছর মাঘ মাসের শেষ মঙ্গলবার ওরস ও ধর্মীয় মেলা পালন করা হয়।  বহু ফকির, দরবেশ, আশেকান, জাকেরান ও সাধারণ মানুষ এই মহান সাধকের মাজার জিয়ারত এবং মেলায় সমবেত হন।

অনেক ইতিহাসবিদদের কাছ থেকে জানা যায়, বর্তমান কটিয়াদী উপজেলার বিভিন্ন স্তানে প্রাচীন আমলে উপজাতিদের বসবাস ছিল। উপজাতিদের মধ্যে গারো, হাজং, কুকি, বানাই, ডালো, ওড়াও, হাড়ী, হদী, কোচ, বর্মন, সাওতাল, বুনা, মারমা, রাখখাইন, তংচংগা, বন, রাজবংশী, খাশিয়া, মুন্ডা, মুড়ং, খিসা, মৌর্য, পাল, সেন, বনহারীসহ বিভিন্ন শ্রেণীর উপজাতিরা কটিয়াদী অঞ্চলে বসবাস করত।  ইতিহাস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, বিভিন্ন স্থানে উপজাতিদের বসবাসের ফলে তাদের নামানুসারেই আবার অনেক স্থানের নামকরণের সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য যে, অনেক আগেই উপজাতিরা তাদের সুবিধার জন্য নিকটতম ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে ভাওয়ালের গড়ে এবং ময়মনসিংহ এবং নেত্রকোণার বিভিন্ন  স্থানে চলে গেছে।

আদিতে নাকি ছিল জল আর জল; কিন্তু সেতো পুড়নো কথা। এই উপমহাদেশের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্ত ‘বেদ’ সেখানে বঙ্গের কোন উল্লেখ নেই।  সম্ভবত এ অঞ্চল তখনো উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট অর্জন করেনি। লোহিত সাগরের নাম আমরা শুনেছি।  ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তি মূলে যে পৌরনিক কাহিনী জড়িত, তা নিঃসন্দেহে বৈদিক যুগের প্রকৃতি পূজার উপাদান বহণ করেছে।  পিতৃ আদেশ পালন করতে পরশুরাম কুঠার আঘাতে তার মাতাকে হত্যা করেছেলেন।  হাত থেকে যখন স্থলনের কোন উপায় তাকে না রক্তাত্ত কুঠারটি তখন উপায়ন্তর না দেখে পরশুরাম অবগান করতে নামলেন মানস সরোবরে।  সেখান থেকে পাপ মুক্ত হন পরশুরাম। আর মাতৃ রক্তে সিক্ত কুঠার হাত থেকেই তখনই খসে পরে। সেখান থেকে জন্ম নেয় ব্রম্মপুত্র। আর এই ব্রহ্মপুত্র নদের তলদেশে লুকিয়ে ছিল হাজার হাজার বছর আমাদের স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলার এক বৃহৎ অংশ।  কালক্রমে ব্রহ্মপুত্র নদের তলদেশ থেকে জেগে উঠতে থাকে চর, গজাতে থাকে গাছপালা। পাখিদের কোলাহলে মুখরিত হতে থাকে বন বনাঞ্চল।  বিভিন্ন স্থান থেকে জীবিকার সন্ধানে আসতে তাকে বনচারী মানুষ।

প্রাচীন আমলে এই কটিয়াদী এলাকার একটি বৃহৎ অংশ জলভূমি ছিল।  মেজর জেমস্‌ রেনেল (১৭৬৬ -১৭৭৩)  খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত নদী জরিপ করেন।  তিনি মেঘনাকে সাগর সঙ্গম বলে উল্লেখ করেন।  ১৭৮৭ খ্রীস্টাব্দে ব্রম্মপুত্র নদের গতি পরিবর্তন হয়।

প্রিন্স রফিক খান সম্পাদিত কিশোরগঞ্জের ইতিহাস গ্রন্থে বলা হয়েছে, মঠখোলা, এগারসিন্দুর এলাকায় নদী ছিল ১২ মাইল প্রশস্ত। আর এই কটিয়াদী এলাকায় ব্রহ্মপুত্র ছিল সাড়ে ৫ মাইল প্রশস্ত।  মনোহরদী থানার চরমান্দালীয়া, চরগোহালবাড়ীয়া, পাইকানের চর, কটিয়াদী থানার কাজিরচর, বৈরাগীর চর, প্রেমার চর, চর আলগী, চর বেতাল, চর পুখিয়া, চর নোয়াকান্দি, চর ঝাকালিয়া, টুনিয়ারচর, পূর্ব চরপাড়াতলা, ফেকামারা, ভরাদিয়া এবং বাজিতপুর থানার উজানচর ইত্যাদি গ্রামগুলো ছিল জলভূমি।  আস্তে আস্তে নদীর খরস্রোত কমে যাওয়াই উল্লিখিত গ্রামগুলোতে চর ভেসে উঠলে মানুষ বসবাস করতে শুরু করে।  নদীর চরে মানুষ বসতি স্থাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাবে গ্রামগুলোর নামকরণের উৎপত্তি হয়।

কিশোরগঞ্জের ইতিহাস গ্রন্থে বলা হয়েছে, এগারসিন্দুর, মঠখোলা, বেলার থানার ওয়ারী বটেশ্বর এবং কটিয়াদী থানার লোহাজুরী অঞ্চলে প্রাচীন আমলে লৌহ শিল্পের প্রচলন ছিল। লৌহাজুরীতে প্রচুর পরিমাণ লৌহ মিশ্রিত মাটির স্তর ছিল বলেই লোহাজুরী নামের সৃষ্টি হয়েছে। প্রাচীন আমলে পোড়াদী থেকে আগরপুর পর্যন্ত নদী ছিল।  নদীর পাশে হুমারটেক নামে (বর্তমান লোহাজুরীর পূর্ব দিকে) একটি পাহাড় ছিল।  কালের বিবর্তনে হুমারটেক পাহাড়টি আজ সমভূমিতে পরিণত হয়েছে।  লোহাজুরীর পার্শ্ববর্তী গ্রামের নাম বাহের চর। বাহার আরবী শব্দ। বাহার শব্দের বাংলা দরিয়া।  নদীর দরিয়া হতে চর ভেসে উঠলে সেই চরের নাম হয় বাহের চর। কিংবদন্তী আছে লোহাজুরী একটি ঐতিহাসিক জনপদ। লোহাজুরীর পশ্চিম দিকে আড়িয়াল খাঁ নদীর পূর্বে যে চরটি ভেসে উঠে তাহাই পরবর্তী সময়ে পূর্বচর পাড়াতলা নামে নামকরণ হয়।  এই পূর্বচর পাড়াতলা গ্রামে ‘চটান’ নামে কয়েকশত একরের বিশাল খেলার মাঠ ছিল।  বৃটিশ আমলে এই ‘চটান’ মাঠটি বর্তমানে আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে যায়।

জালালপুর নামটি প্রাচীন আমলের।  ১০৫৩ খ্রীস্টাব্দে হযরত শাহ্‌ সুলতান হাফিজ ইরানী (রা) ১২০ জন সঙ্গী নিয়ে হরিষ চন্দ্র পালের রাজ্যে প্রবেশ করেন। (বর্তমানে বেলাব থানার শাহ্‌ ইরানী গ্রাম) । হযরত শাহ্‌ সুলতান হাফিজ ইরানী (রা) সঙ্গীদের মধ্যে একজনের নাম ছিল ‘জালাল উদ্দিন’ তিনি লোহাজুরী অঞ্চলের উত্তরদিকে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তার নামানুসারেই জালালপুর নামের সূচনা হয়।  ১২০০ শতাব্দীর সময়ে সুলতানী আমল শুরু হয়।  আর এই দেশে পুর শব্দটি সুলতানী আমলেই আসে।

অন্তহীন নন্দিত ঐতিজ্যের পাশাপাশি বৃটিশ শাসন আমলে ইংরেজ বেনিয়ারা প্রতিস্টিত করে জালালপুরে নিন্দিত নীল কুঠির।  ১৮৮৬ খ্রীস্টাব্দে বর্তমান কটিয়াদী উপজেলার অন্তর্গত জালালপুরে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় নীল চুল্লি ছিল। যেখানে আর্তমানবতার ভাষা স্থব্দ।  যেখানে অত্যাচার অবিচারের দাপট আকাশচুম্বি তারই তো পরিচয় বহন করে এই নীল কুঠির।  পরাধীনতার রুজ্জু যে কত নিষ্ঠুর এ নীল কুঠির তারই দুষ্ট দৃষ্টান্ত।  কেমন করে নিশংস ভাবে মানুষের পিঠের চামড়া তুলে নিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখত গাছের ডালে, সারাদিন মাঠে মাঠে নীল চাষ করে কেমন করে কান মলা দিয়ে শূন্যহাতে বিদায় করে দিত দরিদ্র মানুষকে তারইতো ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত এই নীল কুঠি। অর্থাৎ নীল চাষিদের ব্যাপক অত্যাচার চলত।  হযরত শাহ্‌ সুলতান হাফিজ ইরানী(রা) এর মাজার অঞ্চলে নীল বিদ্রোহের নেতৃত্বের মূল ঘাটি ছিল।  নীল কুঠির এলাকায় জলমহলকে কুঠির বিল নামে আজও ডাকা হয়।  (ভারতের কৃষক বিদ্রোহের গণতান্তিক সংগ্রাম, নীল বিদ্রোহ পর্ব – সুখ প্রকাশ পায়।)

প্রাচীন আমলে লোহাজুরী এবং জালালপুর অঞ্চলে কৃষি কাজের ব্যবস্থা থাকলেও চরপুখিয়া গ্রামে কৃষিজ ফসল উৎপন্ন হত না।  কিংবদন্তী আছে – চরপুখিয়া গ্রামের মাটিতে ফসল উৎপন্ন না হওয়ার কারণে এই এলাকাকে চরের পোড়া মাঠি বলে ডাকত। চরের পোড়ামাটি কথাটির বিবর্তন হয়ে চরপুখিয়া নামের সূচনা হয়।  তা প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে শুনা যায়।

ফেকামারা গ্রামটি জালালপুরের অনেক পরে উৎপত্তি হয়।  ১৪০০খ্রীস্টাব্দের সময়ে বর্তমান ফেকামারা ছিল জলভূমি।  ফেকামারা অঞ্চলকে নিয়ে লোকমুখে অনেক কথা শুনা যায়। ফেকার নামের এক বিদেশী বণিক নৌকা দিয়ে এগারসিন্দুর যাওয়ার পথে বর্তমান ফেকামারা নামক স্থানে আসিলে ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকাটি ডুবে যায়।  নৌকা ডুবে যাওয়ার ফলে ফেকারসহ অনেকেই মারা যায়। কিংবদন্তী আছে – যে এলাকাতে ফেকার মারা যায় পরবর্তী সময়ে তার নামানুসারেই ফেকামারা গ্রামের নামকরণ হয়েছে।

জালালপুর এবং লোহাজুরী দু’ টি ইউনিয়ন বৃটিশ আমলে এক ছিল।  তৎকালীন সময়ে ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধিকে প্রেসিডেন্ট বলা হতো। চরপুখিয়া গ্রামের আফতার উদ্দিন এবং জালালপুর গ্রামের মেন্দি মিয়া দীর্ঘদিন এই অঞ্চলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।  পরবর্তী সময়ে ইউনিয়ন ভাগ হলে জালালপুরের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মজিবুর রহমান ভূঞা। তিনি দীর্ঘ ৩৫ বৎসর জালালপুরের চেয়ারম্যান ছিলেন।  মজিবুর রহমান ভূঞা এবং তৎকালীন সময়ে কটিয়াদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ডাক্তার সামসুল আলম গোলাপ মিয়ার সহযোগীতাই কটিয়াদী থানার সামনে নদীর বাঁধের নির্মাণ হয়।  যার ফলে জালালপুর ,লোহাজুরী, মনোহরদী ও বেলাব থানার মানুষ অতি সহজে কটিয়াদী সদরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।

আজকের আধুনিক মসুয়া অঞ্চলে প্রাচীন আমলে বিভিন্ন বংশের লোকজনের বসবাস ছিল।  বৃটিশ আমলে মসুয়াতে জ্ঞানী – গুণিদের বসবাস ছিল। তান্তিক রাজা নবরঙ্গ রায়ের আমলে মসুয়াতে বেশীর ভাগ ব্রাহ্মন সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করত বলেই বামন মসুয়া নামের সূচনা হয়। তাছাড়া ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তরপাড়ে বৈরাগীদের বসবাস ছিল বলেই বৈরাগীর চর গ্রামের নামকরণ হয়।

বৈরাগীর চর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মো- আবদুস্‌ ছালাম।  তিনি একজন অলি ছিলেন।  কথিত আছে – প্রখ্যাত অলি আবদুস্ ছালাম সাহেবের বাড়ীর দক্ষিণ দিকে ব্রহ্মপুত্র নদী নৌকা ছাড়াই পানির উপর দিয়ে হেঁটে পার হয়ে যেতেন ওপাড়ে।  তিনি আধ্যাত্মিক সাধনের মাধ্যমে বহু মানুষের উপকার করেছেন।

বেতাল গ্রামের নামটি প্রাচীন আমলের।  ১৫০০ খ্রীস্টাব্দের সময় বর্তমান বেতালের দক্ষিণ দিকে নদীর একটি অংশে প্রচুর গভীরতা ছিল। এখানে পানি ঘোরপাক করত।  নৌকা এই স্থানে আসিলে ডুবে যেত।  প্রাচীন আমলে নদীর এই স্থানটিকে বেতাল বলা হত।  দখিণের অংশকে বলা হয় সর্বমঙ্গল জলমহাল আর উত্তরের অংশ বেতাল জল মহাল।  মহাপ্রভূ শ্রী চৈতন্য দেবের আগমনের সময় সর্বমঙ্গল জল মহাল নাম ধারন করে তাহা আজও রেকর্ডভূক্ত আছে।

মসুয়া ইউনিয়নের রামদী গ্রামটি প্রাচীন আমলের। বেবোধী রাজার উত্তরসূরীদের মধ্যে রামজুগী নামে একজন বর্তমান রামদী গ্রামে বসবাস করতেন।  রামজুগী তার নামের ‘রাম’ এবং বেবোধী রাজার সম্মান সূচন শব্দ ‘ধী’ ব্যবহার করে তাদের নামানুসারেই গ্রামটির নাম রাখেন ‘রামদী’।

কাজিরচর গ্রামের কৃতি সন্তান এডভোকেট এম এ বাতেন বলেন –

কটিয়াদী উপজেলার সর্বশেষ পশ্চিম প্রান্তসীমার গ্রামটিই ‘কাজিরচর’। বৃটিশ আমলে তৈরী উক্ত গ্রামের মৌজা ম্যাপ বা নকশায় গ্রামটির  নাম লেখা আছে কাজিয়ারচর। এই গ্রামটির দক্ষিণ পূর্বাংশের নাম ‘প্রেমাচর’। এই অংশটুকু প্রেমানন্দ নামে একজন বণিকের  মালিকানাধীন ছিল বলে তার নামানুসারেই পরবর্তীতে প্রেমাচর হয়েছে। অদ্যাবধি প্রেমাচর নামটি সর্বত্র প্রচলিত আছে।  মসুয়া ইউনিয়নের আরেকটি ঐতিহ্য হচ্ছে ফুটবল খেলা।  ৪০/৫০ এর দশকে মসুয়ার জমিদার বাড়ী খেলার মাঠে (বর্তমান মমিনের মাঠ) অনুষ্ঠিত হতো বিকে শীল্ডের ফুটবল টুর্ণামেন্ট।  পার্শ্ববর্তী থানার অনেক টিমের অংশগ্রহণে খেলার মাঠ হয়ে উঠতো আনন্দমুখর।

কটিয়াদী উপজেলার আচমিতা ইউনিয়নে রয়েছে বাংলার বারো ভূঞার অন্যতম বীর ঈসা খাঁ ও রাজা নবরঙ্গ রায়ের সৃতি বিজড়িত গোপীনাথ বাড়ি। এই গোপিনাথ বাড়ীর অনেক ঐতিহ্য রয়েছে। সম্রাট আকবরের শাসনামলে ১৫৮৫ সনে সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় সুরম্য মন্দির পঞ্চরত্ন সহ অট্টালিকা নির্মাণ করে গোপীনাথ জিওর বিগ্রহ স্থাপন করেন।  বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বাবু মনোরঞ্জন চৌধুরী ও ইতিহাসবীদদের কাছ থেকে জানা যায়, গোপীনাথ বাড়ীর নিকট বাউল সাগর নামে একটি ছোট্ট নদী ছিল।  সেই নদীর তীরে এক সাধুর বসবাস ছিল।  রাজা নবরঙ্গ রায় স্বপ্নে পেয়ে সাধুর শরণাপন্ন হয় এবং সাধুর উপদেশ অনুযায়ী সেই নদী হতে ভাসমান নিমগাছ সংগ্রহ করে তা দিয়ে গোপিনাথ, শুভ্রা ও বলরাম এই তিনটি মূর্তি স্থাপন করেন।  ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইশা খাঁ ভাটি এলাকার আধিপত্ত হন এবং তখনই রাজা নবরঙ্গ  রায়ের সাথে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে রাজার পরাজয় ও রাজপ্রাসাদ ধ্বংশ হয়ে যায়।  উল্লেখ্য – গোপিনাথ বাড়ীর নিকট চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজা নবরঙ্গ রায়ের রাজপ্রাসাদ।  ১৫৯৫ সালে এগার সিন্দুর দূর্গে ঈসা খাঁর মোগল সেনাপতি কর্তৃক অবরুদ্ধ মানসিংহ অবশেষে ঈসা খাঁর নিকট পরাজয় বরণ করেন। এই যুদ্ধ জয়ের বিজয় উল্লাস করে দ্বিপ্রহরে গোপিনাথ বাড়ীর ভোগ – আরতির সময়ে ঈসা খাঁ ভোগ আরতির সুগন্ধে কিছুক্ষণের জন্যে যাওয়া বিরতি করেন এবং গোপীনাথ বাড়ী পরিদর্শনে মুগ্ধ হয়ে রাজা নবরঙ্গ রায়ের সৃতি টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে কয়েকশত একর জায়গা জীগার প্রদান করেন।  তখন থেকেই এই এলাকার নাম হয় ভোগ বেতাল।

ঈসা খাঁর অনুকূলে গোপীনাথ বাড়ী প্রতিষ্ঠিত দেয়াল ঘর রূপে বাংলার বুকে আত্নপ্রকাশ করে।  আজও নিদর্শন স্বরূপ মন্দির গোথে ফার্সি হরফে লিখিত ফলক ইহার সাক্ষ্য বহন করে।  বর্তমানে রয়েছে প্রাচীন দালানের ধ্বংসাবশেষ।  বাংলা ১৩০৪ সনে ভূমিকম্পে পঞ্চরত্নসহ বিভিন্ন অট্টালিকা ধ্বংশ হয়ে পড়ে।  এখনও এই গোপিনাথ বাড়ীতে রয়েছে মূল মন্দির, নাট মন্দির, বিশ্রামাগার, ঝোলন মন্দির প্রভৃতি।  এগুলো সংস্কারের অভাবে দিন দিন ভেঙ্গে যাচ্ছে।  গোপিনাথ বাড়ীতে তৎকালীন সময়ে খনন করা দুইটি পুকুর ও একটি দিঘি রয়েছে।  গোপিনাথ বাড়ী বাংলার হিন্দুদের তীর্থস্থান।  জানা গেছে, এক কালে ভারতের পুরীর রথের পরেই ছিল গোপীনাথ বাড়ীর স্থান।  বর্তমানে মন্দির অঞ্চলের জায়গা – জমি ক্রমশই বেদখলে চলে যাচ্ছে।  গোপিনাথ বাড়ীতে এখন ২৫ একর ৮ শতাংশ ভূমি রয়েছে।  ৩ একর ৮৩ শতাংশ ভূমির বেদখলদারদের বিরুদ্ধে জেলা দেওয়ানী – আদালতে মোকদ্দমা চলছে।  এছাড়া অষ্টঘরিয়া মৌজার ৪৩৯ দাগের ৩৬ শতক ভূমি সি এস রেকর্ডে দেবোত্তর থাকলেও তা সরকারের খাস খতিয়ানে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।  প্রতিষ্ঠানটি টিকে আছে শ্রীশ্রী গোপিনাথ জিউর ট্টাস্ট কমিটি’র তত্ত্বাবধানে।

গোপিনাথ বাড়ীর প্রতিস্টাতা সামান্ত রাজা নবরঙ্গ রায়ের আমলে খনন করা কয়েকশত একরের সুবিশাল কোটামন দিঘির ক্রয়সূতে মালিক বিশিস্ট শিল্পপতি আশরাফ উদ্দিন আহমেদ (মেনু মিয়া) প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে এর শ্রীবৃদ্ধি করেছেন।  এই কোটামন দিঘি নিয়ে অনেক কিংবদন্তী রয়েছে।

রাজা নবরঙ্গ রায়ের স্ত্রীর নাম ছিল কোটামন রায়।  কোটামন রায়ের বড় দিঘিতে স্লান করার ইচ্ছে হলে তা রাজার কাছে ব্যক্ত করেন।  স্ত্রীর মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্য রাজা নবরঙ্গ রায় বিশাল দিঘি খনন করেন এবং স্ত্রীর নামানুসারেই দিঘিটির নাম রাখেন কোটামন দিঘি। এই কোটামন দিঘি নিয়ে এখনও লোখমুকে নানান কাহিনী শুনা যায়। দিঘির পানি থেকে থালা, বাসন, কলশী, জগ, গ্লাস, ইত্যাদি দিঘির পাড়ে উঠে আসতো।  কোন এক সময়ে একজন মহিলা ছোট একটি গ্লাস শাড়ীর আঁচলে লুকিয়ে রাখার ইচ্ছে করলে বাকীগুলো আর দিঘির পানিতে নেমে যেতে চাইনি।  গ্লাস ফেরত দেওয়ার পর সবগুলি দিঘির জলে চলে যায়।  এরপর থেকে এসব থালা, বাসন, জগ, কলশী, গ্লাস ইত্যাদি আর উঠে আসেনি। খাবারের সময় ভক্তরা এসব ব্যবহার করতো এবং খাবারের শেষে যথাস্থানে আবার রেখে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।  সামান্ত রাজা নবরঙ্গ রায়ের আমলেই চারিপাড়া, আচমিতা এবং বানিয়া গ্রামের সূচনা হয়।  কিংবদন্তী আছে প্রাচীন আমলে এগারসিন্দুর নদী বন্দরে বিদেশী বণিকরা ব্যবসা – বাণিজ্যের জন্যে এসেছিলেন। কয়েকজন বণিক তাদের সুবিধার্থে কিছুদিনের জন্য বর্তমান বানিয়াগ্রামে অবস্থান করেছিলেন। বণিকদের আগমনের পর বণিক থেকে বানিয়া গ্রামের নামকরণের কথা লোকমুখে শোনা যায়। আবার ঐতিহাসিকদের মতে, বানাই উপজাতিদের বসবাস ছিল এই অঞ্চলে।  বানাই উপজাতিদের বসবাসের কারণেই এই এলাকার নাম হয়েছে বানিয়া গ্রাম।

আচমিতা জর্জ ইন্সটিটিউশন এর সহকারী প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম মাষ্টার বিদ্যালয় সম্পর্কে জানান- উপজেলার প্রাচীনতম মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৯১২ সনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।  ইংল্যান্ডের রাজা ৫ম জর্জের রাজত্ব কালে বিদ্যালয়টি গড়ে উঠেছিল বলেই স্থানীয় লোকজন রাজার নামানুসারেই এর নামকরণ করেছিলেন আচমিতা জর্জ ইন্সটিটিউশন। সাবেক আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্রী বাবু মনোরঞ্জন ধর এই শিক্ষা অঙ্গনের কৃতি ছাত্র ছিলেন।

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে চারিপাড়া গ্রামটি সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায়ের আমলেই নামকরণ।  ছোট ছোট চারটি পাড়া নিয়ে এই গ্রামটি গঠিত হয়েছিল বলেই চারিপাড়া নামের সূচনা হয়। আচমিতা ইউনিয়নের আরেকটি গ্রামের নাম অস্টঘরিয়া। মাত্র আটটি ঘর নিয়ে সূচনা হয় বলে অষ্ট ঘরিয়া নামের উৎপত্তি হয়।  বর্তমানে ইউনিয়নের মধ্যে একটি বৃহৎ গ্রাম হিসেবে পরিচিত।

অনেক প্রাচীন আমলের গ্রাম ভিটাদিয়া। কথিত আছে যে, তৎকালীন জমিদারী রাজত্বে ভিটাদিয়া গ্রামের হিন্দু – মুসলমান সকল প্রজা সাধারণত খুবি শান্তিতে বসবাস করতেন। এই গ্রামের জমিদার ছিলেন খুবই শান্ত স্বভাবের। জানা যায় – ভিটাদিয়া গ্রামের জমিদার রমেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। তিনি শিক্ষানুরাগী এবং ধর্মানুরাগীও ছিলেন। উপজেলার বৃহত্তম মঠ (উপাসনালয়) তার বাড়ীতেই ছিল। যার ধ্বংসাবশেষ এখনো বর্তমান আছে।  মহাপ্রভূ শ্রী চৈতন্য দেব কিছু দিনের জন্য এই ভিটাদিয়া গ্রামে অবস্থান করেছিলেন। আচমিতা ইউনিয়নের গণের গাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এম-ওল এ) মৌঃ  ছাইদুর রহমান।  তারই সুযোগ্য ছেলে শহীদ কর্ণেল যুবায়ের আহম্মদ (মাহফুজ) ১৯৭১ সনে স্বাধীনতা যুদ্ধে কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন।  সাবেক স্পীকার এবং বর্তমান বিরোধী দলের উপনেতা এডভোকেট আবদুল হামিদ সাহেবের নানা শ্বশুর হলেন মৌঃ ছাইদুর রহমান।  আচমিতা ইউনিয়নের তেভাগা আন্দোলনের সাক্ষ্য বহণ করে।  এই অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলন অনেক শক্তিশালী ছিল।  বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে কটিয়াদী থানার অনেক বীরপুরুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন।  তাদের মধ্যে ছিলেন –

কায়েস্থ পল্লী গ্রামের সঞ্জীব রায়।  বনগ্রামের প্রবীর গোস্বামী। আচমিতার  পুর্ন চন্দ্র গোস্বামী, চাতল গ্রামের বাবু মনোরঞ্জন ধর, গণের গাঁয়ের মৌঃ ছাইদুর রহমান, কটিয়াদী পশ্চিম পাড়ার কমরেড দেবেন সাহা, বাইরপাথর গ্রামের আবদুল জব্বার, বানিয়া গ্রামের সাধু গোঁসাই প্রমূখ ব্যক্তিরা এই অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।  বানিয়া গ্রামের তেভাগা বাজার অতীতের স্মৃতিকে আঁকড়িয়ে আজও বিদ্যমান। নেতাজী সুভাস বসুর পদার্পনে ধন্য হয়েছে এ এলাকার মানুষ।

হযরত শাহ্‌ শামসুদ্দিন ভুখারী (রা) এর স্মৃতি বিজড়িত কুড়িখাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী বাবু শিবনাথ সাহা।  শিবনাথ সাহা কটিয়াদী অঞ্চলের একটি পরিচিত নাম।  ১২৫৫ সনে ১৭ই আষাঢ় জোয়ারিয়া (কুড়িখাই) গ্রামে শিবনাথ সাহা জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম কার্তিক চন্দ্র সাহা, দাদা যাতাবর সাহা।  শিবনাথ সাহারা ছিলেন দুই ভাই শম্ভুনাথ সাহা ও শিবনাথ সাহা। শিবনাথ সাহার বাবা ঠাকুর্দার আমলে অর্থনৈতিক অবস্তা তেমন ভাল ছিল না।  তার সময়ই অর্থনৈতিক প্রসার ঘটে এবং তিনি তালুকদার হন। তিনি বাজিতপুরের আলিয়াবাদে বিয়ে করেন। স্তীর নাম কালীসুন্দরী সাহা।  তার পারিবারিক উত্তরসূরীগণ (বর্তমানে কটিয়াদী বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বাবু দীলিপ কুমার সাহা, রতন কুমার সাহা, উত্তম কুমার সাহা, বিশ্বনাথ সাহা প্রমুখ) মনে করেন এক মহেন্দ্রখণে মনুষ্যরূপী দুই দেব – দেবী কালি ও শিবের মিলন ঘটে।  কিন্তু তাদের কোন পুত্র হয়নি। বাবু শিবনাথ সাহা কালী সুন্দরী সাহার ঘরে তিন কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ পুর  করেন।  তাদের নাম বিদ্যাসুন্দরী সাহা, জগৎতারা সাহা এবং জয় দূর্গা সাহা। বাবু শিবনাথ সাহা অনেক জনহিতকর কাজ করেন। এর মধ্যে উল্লখযোগ্য স্ত্রীর নামে বাজিতপুরে কালিতারা পাঠশালা, বনগ্রামে পিতার নামে কার্তিক চন্দ্র সাহা লাইব্রেরী, ধুলদিয়াই শিবনগর, কামালপুরে পূজামন্ডব এবং ইংরেজী ১৯১৮ সনে গোবিন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন করেন যা পরবর্তীতে সরারচর শিবনাথ সাহা উচ্চ বিদ্যালয় নাম ধারণ করে।  তিনি ১৯২০ সনের ২০ শে সেপ্টেম্বর একটি ট্টাস্ট গঠন করেন। এই শিক্ষানুরাগী শিবনাথ সাহা বাংলা ১৩৩১ সনের ১৭ই আষাঢ় নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। তার বাড়ীর পাশেই নদীর পাড়ে শিব সাহা শ্মাশানঘাট।  শ্মাশানের দীর্ঘ উঁচু শিব সাহা মঠ।  কুড়িখাই গ্রামে শিবনাথ সাহা বাজারটি তাহার নামেই রাখা হয়।  বাবু শিবনাথ সাহার বাড়ীর কারুকাজপূর্ণ দালানের ধ্বংসাবশেষ এখনো রয়েছে।

কটিয়াদী সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে চান্দপুর ইউনিয়ন।  চান্দুপুর গ্রামের কৃতি সন্তান গোলাম মোস্তফা সরকার বলেন –

চান্দুপুর শব্দটি মূলত চাঁদপুর এর বিবর্তিত রূপ।  চাঁদপুর ইংরেজীতে লিখার প্রয়োজনে চাঁদের চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহারের ফলে ইংরেজী বর্ণ N ব্যবহিত হয় অর্থাৎ CHANDPUR । ঐ ইংরেজী শব্দ ব্যবহিত হয়ে বর্তমানে চাঁদপুর থেকে চান্দপুর হিসেবে পরিচিত। মূল শব্দ চাঁদপুর এর নামকরণের ব্যাপারে বিভিন্ন জনশ্রুতি রয়েছে। কিংবদন্তি আছে চান্দু সওদাগর নামে এক ব্যক্তি প্রথমে বসতি স্থাপন করেন, পরে তাহার নামানুসারেই চান্দপুর নামকরণ হয়।

আবার কেউ বলেন – প্রখ্যাত সাধক আউলিয়াগণের  অন্যতম হযরত মিয়া চান্দশাহ্‌ (র)এর নামানুসারেই চান্দপুর এর নামের সূচনা হয়। হযরত মিয়া চান্দশাহ্‌ (রা) ছিলেন হযরত শাহ্‌ শামসুদ্দীন বুখারী (রা) এর আত্মীয়। তার মাজার চান্দপুর ইউনিয়নের সেকেরপাড়া গ্রামে। এই মাজারটি চুনের মাজার হিসেবে পরিচিত। সেকেরপাড়া গ্রামে প্রাচীন আমল থেকেই বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বসবাস ছিল। প্রখ্যাত সাধক আউলিয়া হযরত মিয়া চান্দশাহ্‌ (রা)এর আগমনের পর হয়তে মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করতে থাকে।  জানা যায়, মুসলমানদের বসবাসের ফলেই সেকেরপাড়া নামকরণ করা হয়।  কিশোরগঞ্জ গণপূর্ত অধিদপ্তরে চাকরি করেন মন্ডল ভোগ গ্রামের কৃতি সন্তান শহীদুল ইসলাম বলেন –

প্রাচীন আমলে রসরাজ মন্ডল নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি বসবাস করতেন।  তার নামের শেষ শব্দ মন্ডল থেকে মন্ডলভোগ গ্রামের নামের সূচনা হয়। মন্ডলভোগ গ্রামে রয়েছে “আব্দুর  রহমান” নেংটা দেউয়ানী সাহেবের মাজার।  এখানে প্রতি বৎসর চৈত্র মাসের ১লা রবিবার ওরস অনুস্টিত হয়।  হাজার হাজার ভক্তবৃন্দ ও সাধারণ মানুষ এখানে আসে এবং ওরস পালন করে। চান্দপুর ইউনিয়নের মধ্যপাড়া গ্রামে রয়েছে হযরত আনোয়ারুল হক সাহেবের মাজার। এখানে প্রতি ব্যসর অগণিত ভক্তবৃন্দের আয়োজনে শান্তি সমাবেশ পালন করা হয়।

প্রাচীন আমলে মানিক নামে এক সম্মানিত ব্যক্তি কৃষি কাজের জন্য একটি খাল খনন করেন। এই খালটিকে মানিকের খাল নামে ডাকত।  এজন্যই মানিকের খালের নামানুসারেই মানিক খালি গ্রামের নামকরণ হয়। মানিক খালীতে একটি রেল স্টেশন রয়েছে।  বৃটিশ সরকার এদেশের সম্পদ লুন্ঠনের জন্য ১৮৮৬ সালে মানিক খালীর উপর দিয়ে একটি রেল লাইন স্থাপন করেন।  কিন্তু বৃটিশ সরকার ভাবতে পারেনি যে, একদিন তাদের এদেশ ছাড়তে হবে।

বনগ্রাম প্রাচীন আমলের।  কারো মতে প্রাচীন আমলে বন জঙ্গল বৃত্তিক এলাকাকে আজকে বনগ্রাম বলা বলা হয়।  তবে উপজাতিদের নিয়ে গবেষণা করেন কবি বিন্নাবাইদী বলেন – প্রাচীন আমলে বনয়ারী উপজাতিদের বসবাস থেকেই বনগ্রাম নামের সূচনা হয়।  এখনো ভাওয়ালে সমুয়েল বনয়ারী এবং বতুয়েল বনয়ারী উপজাতিরা বসবাস করে। কথিত আছে প্রাচীন আমলে প্রচুর পরিমাণ কাঁঠাল গাছ এই এলাকাকে কাঠালতলী নামকরণ করা হয়। এক সময় পান্ডুগজ সিংহ নামে বনগ্রামের লৌহজারন কবিরাজী চিকিৎসায় সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল।  ভাওয়াল, ময়মনসিংহ এলাকার কোচ বর্মন উপজাতিদের নামের শেষে উপাধী স্বরূপ ‘নদ্‌না’ শব্দটি পাওয়া যায়।  তাই ধারণা করা যায় – প্রাচীন আমলে কোচ বর্মন উপজাতিরা এখানে বসবাস করত এবং তাদের উপাধী ‘নদ্‌না’ হতে বর্তমানে ‘নদনা’ গ্রামের নামকরণের সূচনা হতে পারে।

কটিয়াদীর একটি প্রাচীন গ্রাম শিমুহা নিহার দিয়া। এ গ্রামের নামটি সিংগুয়া নদীর সাতে সম্পৃক্ত। গ্রামটির মূল নাম শিমুয়া নিহার দিয়া।সিংগুয়া উচ্চারণটি বিতর্কিত হয়েই হয়েছে শিমুহা। নিহার শব্দটি আরবী নহর শব্দ থেকে উদ্ভুত যার অর্থ নদী বা খাল।  দিয়া শব্দটি দেয়া অর্থ মেঘ থেকে উদ্ভুত। সবগুলি শব্দই বৃষ্টি, পানি, খাল, নদী ইত্যাদির সহিত সম্পৃক্ত। এভাবেই সিংগুয়া নদীর তীরবর্তী এ জনপদ শিমুয়া নিহারদিয়া নামের নামকরণ হয়েছে।

বনগ্রামের পশ্চিম পাড়ায় রয়েছে শ্রীশ্রী শিব শীতলা মন্দির।  আদী ইতিহাস থেকে জানা যায় শ্রীশ্রী শিব শিতলা মন্দিরটি বর্তমানে জড়াজীর্ণ অবস্তাই রয়েছে।  বাংলা ১১৪২ সনে তৎকালীন কিশোরগঞ্জের হয়বতনগরের দেওয়ান সাহেব ‘মা শীতলা দেবীর’ মাহাত্ব দেখে উক্ত মন্দিরটি তৈরী করে দেন।

আজ থেকে প্রায় ২৭১ বছর পূর্বের কথা বনগ্রাম পশ্চিম পাড়া গ্রামের চক্রবর্তী এই মন্দিরের সামনে বসে সাধনা করতেন।  তখন কার সময় গুটি বসন্তের প্রাদুর্ভাবে হাজার হাজার মানুষ মারা যেতে ছিল।  মানব প্রেমিক সিদ্ধ সাধক হরি নারায়ণ চক্রবর্তীকে দেখা দেয় এবং গুটি বসন্ত প্রতিকারের জন্য মন্ত শিখিয়ে ঔষধ দেখিয়ে দেয়।  তারপর থেকে হরি নারায়ণ চক্রবর্তী বসন্ত কাতর হাজার হাজার মানুষকে বসন্ত রোগ থেকে মুক্তি দেয়। বর্তমানে মন্দিরটি যেখানে অবস্থিত আগে সেখানে ছিল বেত ঝোপ। উক্ত স্থানে বনে হরি নারায়ণ চক্রবর্তী সাধানা করতেন।  সাধনা করতে করতে হরি নারায়ণ চক্রবর্তী ঘুমিয়ে পড়েন।  ঘুমন্ত অবস্থায় হরি নারায়ণ চক্রবর্তী স্বপ্ন দেখলেন যে স্বয়ং মহাদেব ও শীতলা দেবী বেত ঝোপের মধ্যে আসন নিয়েছেন এবং হরি নারায়ণকে বললেন যে-

আমি তোর সাধনায় খুশি হয়েছি, তাই দুই- জনে এখানে আসন নিয়ে বসে আছি, তুই জায়গাটা পরিষ্কার করে আমাকে প্রতিদিন পূজো দে এবং প্রতি বছর ১৭ই চৈত্র আমার মূর্তি তৈরী করে বার্ষিক বড় পূজা উৎযাপন করবে।  ঘুম থেকে উঠে হরি নারায়ণ দেখলেন যে, সত্যিই মহাদেব আসন নিয়ে বসে আছে এবং মহাদেবের মাথায় সাদা রঙের একটি গাভী দুধ দিচ্ছে।  বাবা মহাদেব ও মা শীতলা দেবীর আগমনের কথা বসে থাকেনি, রটে যায় দেশ – বিদেশে।  দেশ – বিদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে বাবা মহাদেব ও মা শীতলা দেবীর মাহাত্ম দেখে যায় এবং দেব – দেবীকে প্রণাম জানায়।  তৎকালীন কিশোরগঞ্জের হয়বতনগরের জমিদার দেওয়ান সাহেবের বিবির গুটি বসন্ত হয়।  গুটি বসন্তের প্রভাবে বিবি আক্রান্ত হয়ে যায়।  তখন দেওয়ান সাহেব খুব চিন্তিত, এখন বিবিকে কি করা যায় ?

এই দিন রাতে দেওয়ান সাহেব স্বপ্ন দেখেন মা শীতলা দেবী তাকে বলছে –

‘দেওয়ান তুই আমার ভক্ত হরি নারায়ণের কাছে যা ।  হরি নারায়ণ তর বিবিকে ভাল করে দিবে।  তোর বিবি ভাল হয়ে যাওয়ার পর তুই আমার আসনে একটি সুন্দর মন্দির করে দিবি।  দেওয়ান সাহেব নিজে হরি নারায়ণের নিকট যায় এবং নিয়ে আসে তাঁর বিবিকে।  তিনদিন পর তাঁর বিবি সুস্ত হয়ে যায়।  দেবীর মহাত্ম দেখে দেওয়ান সাহেব সেখানে উক্ত মন্দিরটি স্থাপন করে দেন।  মন্দিরটির উচ্চতা ৪০ ফুট, প্রস্ত ১৫ ফুট। দেওয়ান সাহেব ৩৭ শতাংশ জমি উক্ত মন্দিরটির নামে লেখে নিয়ে যান। যুগের পর যুগ হাজার হাজার মুসলমান ও হিন্দু তাদের মনের প্রার্থণা প্রকাশ করে, বিভিন্ন মান্নত করে।  সুদীর্ঘ ২৭১ বছর পর বর্তমানে মন্দিরটির খুব জ্বরাজীর্ণ অবস্থা নিয়ে মন্দিরটি প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজ।

আমাদের এই জনপদে বাঘ নিয়ে অনেক কাহিনী শোনা যায়। কটিয়াদী উপজেলার বাঘজোড় কান্দী, বাঘবেড়, বাঘহাটা এবং বাঘরাইট গ্রামগুলিকে নিয়ে কিংবদন্তী আছে যে, বাঘজোড় কান্দি এলাখা ছিল বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ। এখানে এক জোড়া বাঘের বসবাস ছিল। বাঘের অত্যাচারে আশ – পাশের মানুষের মনে ছিল আতংক।  কোন একদিন মানুষের তাড়া খেয়ে বাঘ দুটি বাঘহাটা দিয়ে হেঁটে বাঘবেড় চলে আসলে এখানে মানুষ বাঘ দুটিকে মেরে ফেলার জন্য চতুর্দিক দিয়ে বেড় দিলেও বর্তমান বাঘরাইট চলে আসলে এখানে মারা পড়ে। কথিত আছে – জোড়া বাঘ থাকাতে বাঘজোড় কান্দী, বাঘ যে স্থান দিয়ে হেঁটে যায় তা বাঘহাটা, আবার বাঘ দুটিকে যে স্থান দিয়ে বেড় দেওয়া হয় সেটি বাঘবেড় এবং যে স্থানে বাঘ দুটিকে মেরে ফেলা হয় সেটি বাঘরাইট নামকরণ হয়।

ধুলদিয়া শিবনগর বড়বাড়ির একমাত্র তালুকদার এই বাড়ির আদি পুরুষ মোহন কিশোর সাহা ও নব কিশোর সাহা।  তাদের আমল থেকেই তালুকদারি শুরু।  আজ হতে প্রায় ২০০ বছর আগের কথা।  মোহন কিশোর সাহা নিঃসন্তান থাকায় তাহার সবকিছুই নব কিশোর সাহাকে উইল করে দিয়ে গেলে নব কিশোর সাহা তালুকদারি চালায়।  নবকিশোর সাহার ৩ ছেলে – কৈলাশ চন্দ্র সাহা, অধর চন্দ্র সাহা ও রিদয় চন্দ্র সাহা।  নব কিশোর সাহা ও মোহন কিশোর সাহা মারা গেলে কৈলাশ চন্দ্র সাহা তার ভ্রাতাগন মোহন কিশোর সাহা এবং নব কিশোর সাহার শ্মশানের উপর দু’টি মঠ তৈরী করেন।  যাহা প্রাচীন ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তীর সাক্ষ্য বহন করে আজও টিকে আছে।  কৈলাশ চন্দ্র সাহা তালুকদারির কর্তা ছিলেন। পরবর্তীতে কৈলাশ চন্দ্র সাহার পুত্র নরেন্দ্র চন্দ্র সাহা বৃটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত ধুলদিয়া ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।  সুদীর্ঘ ১৫০ বছর উর্ধ্বকাল যাবত এই বাড়িতে দূর্গা পুজা শুরু হয়ে আসছে। ১৯৭১ সালে পুজার মন্ডপ ছাড়া সমস্ত বাড়িঘর পাক বাহিনীরা পুড়িয়ে ফেলে। পুরাতন ঐতিহ্যের মধ্যে পুজার মন্ডপটি এখনও রয়েছে। এ তথ্য জানিয়েছেন কৈলাশ চন্দ্র সাহার উত্তরসূরী বিশিষ্ট আইনজীবি ও রাজনীতিবিদ বিরাজ কুমার সাহা।

রায় সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস থেকে ধুলদিয়া ইউনিয়নের রায়খলা গ্রামের নামকরণ হয়।  ১৬ কানি জমিকে এক দ্রোন বলা হয়।  বর্তমানে শতর দ্রোন গ্রামে প্রাচীন আমলে এক জমিদার ছিল। তার ১৭ দ্রোন সম্পত্তি ছিল। তাহাই পরবর্তী সময়ে শরদ্রোন হিসেবে গ্রামটির নামধারণ করে তা লোকমুখে শোনা যায়। খ্রীস্টপূর্ব ৩০০০ বৎসর পূর্বে এই অঞ্চল ছিল ভারতের কামরূপ রাজ্যের অধীনে। এ সময়ে কৌর সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল বলে করগাও এবং কৌরপাড়া গ্রামের উৎপত্তি হয়।  কেদারনাথ মজুমদার রচিত ময়মনসিংহের বিবরণ গ্রন্থের ৪৭ পৃস্টায় উল্লেখ আছে, লৌহ মিশ্রিত সামগ্রির জন্য করগাও বিখ্যাত ছিল।  কামারেরা উৎকৃষ্টমানের খরগ এই গ্রামে তৈরী করত বলে গোটা ময়মনসিংহের করগাওয়ের সুনাম রয়েছে।  খরগ তৈরী করার কারণেই গ্রামটির নাম ‘খরগ গাঁও’ থেকে খরগাও নামে নামকরণ হয়েছে।  এটি কটিয়াদী থানার শেষ প্রান্তে অবস্থিত একটি প্রাচীন গ্রাম।  মামুদজান ফকির নামে এক আধ্যাত্বিক সাধক ছিলেন। তিনি গান লিখতেন এবং গান গেয়ে মানুসকে শোনাতেন। মামুদজান ফকিরের বসবাস থেকেই মামুদপুর গ্রামের নামকরণ হয়। আবার খরগাও গ্রামের কৃতি সন্তান ফরিদ আহম্মেদ খান ফারুক বলেন – খান মামুদ নামে এক বিখ্যাত পালোয়ান ছিলেন।  তার নামানুসারেই মামুদপুর নাম হয়। কটিয়াদী অঞ্চলে এক সময় বুনা উপজাতীদের ও বসবাস ছিল।

২০০০ সনের ২৩ জুলাই কটিয়াদী উপজেলার আওয়ামীলীগের উদ্যোগে এক বিশাল জনসভা কটিয়াদী পাইলট বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভায় তৎকালীন মন্ত্রী জননেতা জিল্লুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।  জনসভায় কটিয়াদী উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক জননেতা আন্দুল ওহাব আইন উদ্দিন কটিয়াদী পরিষদকে পৌরসভা করার দাবি জানান জনাব জিল্লুর রহমান সাহেবের কাছে।  তখন এই জনসভায় তার বক্তব্যে পৌরসভার ঘোষণা দেন।  তারপর ২০০১ সনে ৩১শে মে কটিয়াদী পৌরসভা গঠিত হয় এবং ১৯৯৭ সালের নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব মোহাম্মদ আলী পৌর প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন।  ২০০২ সনের ১৩ ই মে নবগঠিত কটিয়াদী পৌরসভা প্রথম নির্বাচন  অনুষ্ঠিত হয়।  অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে কটিয়াদী পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন বিশিষ্ট সমাজ সেবক ও শিল্পপতি মোহাম্মদ – তোফাজ্জল হোসেন খান ‘দীলিপ’।  কটিয়াদী সদর ছিল একটি অবহেলিত জনপদ।  পৌরসভা নির্বাচনের পর বর্তমান সময়ে মানুষের জীবন যাথার মান উন্নয়নের জন্য এবং বহুদিনের ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে চুড়ে একটি নতুন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষে জনাব ‘দীলিপ’ অক্লান্ত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে পৌর এলাকার রাস্তাঘাট, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঐসব গুলোর উন্নয়ন মূলক কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা এবং মাদক দ্রব্য বিক্রিকারীদের ধরিয়ে দলে পুরুস্কারের ব্যবস্থা সহ পৌর এলাকায় নাগরিকদের জন্য একটি আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার সূচনা করেছেন।

পৌর এলাকার একটি প্রাচীন গ্রাম বোয়ালিয়া। হযরত শেখ সুলাইমান (রা) ১০২৫খ্রীস্টাব্দের সময়ে বর্তমান বোয়ালিয়া এলাকায় আসেন। তিনি হযরত শাহ্‌ সুলতান হাফিজ ইরানী (রা) এর সফর সঙ্গী ছিলেন।  শেখ সুলাইমান (রা) বোয়ালিয়া আসার পর তার একটি ছেলে সন্তান জন্মগ্রহণ করে।  তার নাম রাখেন বু – আলী।  এই বু – আলী থেকেই পরবর্তী সময়ে বোয়ালিয়া গ্রামের নামকরণ হয়।

কটিয়াদী পৌর এলাকার কামারকোণা, চড়িয়াকোণা, ভরাদিয়া এবং দড়িচড়িয়াকোণা গ্রামগুলি ছিল প্রাচীন আমলে জলভূমি।  এই সকল স্থানে চর ভেসে উঠলে মানুষের বসতি শুরু হয়। নদীর দড়িয়ার চর ভেসে উঠলে পরবর্তী সময়ে দড়িচড়িয়াকোণা নাম ধারণ করে। কামারকোণা এবং চড়িয়াকোণা অঞ্চলে বৃটিশ আমলে কুমার সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস ছিল। কুমারদের তৈরী মাটির জিনিসপএ এগুলোর চাহিদা ছিল ব্যাপক। বর্তমানে কালের পরিক্রমায় এগুলো হারিয়ে গেছে।

ঐতিহাসিক এগারসিন্দুর কে নিয়ে লেখা “নষ্ট দ্বীপের আলো” গ্রন্থে উল্লেখ আছে বিদেশী বণিকদের মনোরঞ্জনের জন্য এগারসিন্দুর বিশাল পতিতালয় গড়ে উঠেছিল। এই পতিতালয়ে অনেক নারীরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।  তখন নৌকা দিয়ে কয়েকজন পতিতা নারী কটিয়াদী বাজারে এসে আস্থানা স্থাপন করে।  বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পরে কটিয়াদী অঞ্চলের সচেতন মানুষ এলাকার পরিবেশ ভালো রাখার লক্ষে পতিতালয়টি উচ্ছেদ করে।

কটিয়াদী এলাকার অন্য একটি ঐতিহ্য হচ্ছে ঢাকের হাট বা ঢাকের মেলা।  সু প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলে অনেক রাজা জমিদারগণের বসবাস ছিল। রাজা জমিদারগণ শারদীয় দূর্গা পূজার অপরিহার্য অংশ ঢাক বাদ্যের জন্য কটিয়াদী বাজারে একটি ঢাকের হাট বসায়। সে থেকে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এখনও দূর্গা পূজা আরম্বের দুই দিন পূর্ব থেকেই কটিয়াদী পুরান বাজারে বসে ঢাকের হাট।  দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাক সহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বাদ্যকরগণ আসে এই বাজারে।  বাজনা বাজিয়ে বায়নাকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লোকজন দক্ষ বাদ্যকরদের বায়না করে নিয়ে যায় বিভিন্ন পূজা মন্ডপে। যে মন্ডপে ভালো ঢাকি এবং অন্যান্য ভাল বাদ্যকর থাকে সেখানে সমজদারদের আগমন ঘটে প্রচুর। শ্রেষ্ঠ ঢাকিগণ গলায় মেডেল এবং পুরস্কারের টাকা ঝুলিয়ে নৃত্যের ভঙ্গিতে ঢাকের বোল তুলে সমস্ত পূজা মন্ডপকে এক স্বর্গীয় আবেশে ভরিয়ে দেয়।

কটিয়াদী বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জনাব শফিকুল ইসলাম শফিক জানান –

১৯৬১ সনে কটিয়াদী বাজার বণিক সমিতি স্থাপিত হয়। বাজারের প্রবীণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা যায় প্রয়াত বাবু রাম দয়াল ঘোষ, মরহুম আফসার উদ্দিন ভূঞা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিগনের সমন্বয়ে কটিয়াদী বাজার বণিক সমিতি স্থাপিত হয় এবং অদ্যবধি এই সংগঠন ব্যবসায়ীদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। কটিয়াদী সদর হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সময়ে জায়গা ক্রয় করার সময় কটিয়াদী বাজার বণিক সমিতি অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।  প্রায় ১০০ বৎসর পূর্বে সুদূর নেপাল থেকে একজন নাগা সন্নাসী লক্ষ্মী নারায়ণ জিওর মন্দির বিগ্রহ নিয়ে এসে এখানে স্থাপন করেন।  লক্ষ্মী নারায়ণ জিওর প্রাঙ্গনে প্রতি বৎসর ফাল্গুন মাসের প্রথম শুক্রবার থেকে ছয়দিন ব্যাপী ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও মেলা বসে।

কটিয়াদী পৌর এলাকার পশ্চিম পাড়ায় রয়েছে শ্রী শ্রী মহামায়া দেবালয়।  মহামায়া দেবালয়ের বটগাছ সম্পর্কে কটিয়াদী পশ্চিম পাড়ার কৃতি সন্তান বাবু শীতল কুমার সাহার সাথে কথা বললে জানা যায় – স্বর্গীয় সন্তোষ কুমার সাহার দাদা স্বর্গীয় বৈদ্যনাথ সাহার আমলে শ্রী শ্রী মহামায়া দেবালয়ের সাথে পুকুর খনন কালে একটি বটগাছের চারা পাওয়া যায়। এই বট গাছের চারাটি স্বর্গীয় বৈদ্যনাথ সাহা এখানে রোপন করে। যার আনুমানিক বয়স ২০০ বৎসর। বট গাছের গোড়ায় সর্ব প্রথম পাকা করেন স্বর্গীয় রামদয়াল ঘোষ। পরবর্তী সময়ে কটিয়াদী পশ্চিম পাড়ার বিশিষ্ট শিল্পপতি বাবু দীলিপ কুমার ঘোষ প্রয়োজনীয় সংস্কার করে এর শ্রী বৃদ্ধি করেন।  এখানে ১লা বৈশাখে মহামায়া পূজা, বলিদান ও মেলা এবং আমাবস্যা – পূর্ণিমার বাতি প্রজ্বলন ও পূজার অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।

কটিয়াদী সদর ছিল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের দিক দিয়ে পার্শ্ববর্তী থানাগুলোর চেয়ে অনেক উন্নত।  সাধারণত – পূজা – পার্বন বা ঈদ উৎসবে প্রতি গ্রামে গ্রামে যাত্রা পালা নাটকের ধুম লেগেই থাকত।  জারী গান, পুথিপাঠ, লাঠিখেলা, কিস্‌সার আসর ও ছিল কটিয়াদী অঞ্চলের মানুষের বিনোদনের সঙ্গী।  ৬০ এর দশকে কটিয়াদী বাজারে প্রয়াত বাবু রামদয়াল ঘোষ মহাশয়ের পাট গুদামে মঞ্চস্থ হয় দেবতার গ্রাস, বিষের বাশী, মুক্তির যঞ, টিপু সুলতান, শঙ্খচুড়া ইত্যাদি সফল মঞ্চ নাটক।  ১৯৬১ সনে কটিয়াদী বাজারে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ‘কটিয়াদী আর্ট কাউন্সিল’। এ আর্ট কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রতি বছর রবীন্দ্র – নজরুল জয়ন্তী ছাড়া ও অন্যান্য অনুষ্ঠান হত কটিয়াদী সদরে।

৬০ এর দশকেই কটিয়াদী পশ্চিম পাড়ায় গঠিত হয় চানতারা ক্লাব।  চানতারা ক্লাবের সকল সদস্যরা ছিল মহিলা। দুর্ভিক্ষের সময় একবার উক্ত ক্লাবের সদস্যগণ রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করে তা গরীবদের মাঝে বিতরণ করেন।  ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের সময়ে মসলিন বস্তের ব্যাপক চাহিদা ছিল। মসলিন বস্তের সবচেয়ে বড় হাট ছিল এগার সিন্দুর নদী বন্দরে। কথিত আছে – কটিয়াদী সদরে প্রাচীন আমলে মসলিন শাড়ী তৈরী হত।  এগারসিন্দুরের মহাজনরা মসলিন শাড়ী ক্রয় করে তারা বিদেশী বণিকদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করত।

ব্রিটিশ আমলে ময়মনসিংহের মধ্যে কটিয়াদী ছিল পাট ব্যবসার জন্য বিখ্যাত।  লন্ডনের ড্যান্ডি কোম্পানির পাট ক্রয় কেন্দ্রের অফিস ছিল অষ্টগ্রামে।  কটিয়াদী অঞ্চলের ব্যবসায়ীগণ হাজার হাজার মন পাট লন্ডনের ড্যান্ডি কোম্পানির নিকট বিক্রয় করত।

ষোড়শ শতাব্দীর কবি নিত্যানন্দের “প্রেম বিলাস’’ কাব্যে উল্লেখ আছে চাঁদ সওদাগরের কথা। চাঁদ সওদাগরের জাহাজের নাম ছিল “মধুকর’’। মধুকরের ছিল ১২০০ দাঁড়। এগারসিন্দুর নদী বন্দর থেকে মধুকর জাহাজ অষ্টগ্রাম যাওয়ার সময় বর্তমান ভরাদিয়া গ্রামে (১৪০০ শতাব্দীর সময়ে ভরাদিয়া ছিল নদী) পানির গভীরতা কম থাকাই জাহাজাটি আটকে পড়ে।  মধুকর জাহাজের ৩ হাজার লোক তখন ভাষ্য ছিল মধুকর ‘ভরদিছে’।  ধারণা করা হচ্ছে, ভরদিছে কথাটির বিবর্তন হয়ে ভরাদিয়া গ্রামের নামকরণ হয়েছে।

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে কটিয়াদী অঞ্চলে এক সময় উপজাতিরা বসবাস করত।  বিভিন্ন গোথের উপজাতিদের বসবাস থেকে গোএ অনুসারে বিভিন্ন জায়গার নামকরণ করা হয়। তাই ধারণা করা হচ্ছে, ‘হাড়ি’ বা হাড়িও উপজাতিদের বসবাস থেকে হালুয়াপাড়া গ্রামের নামকরণ হয়েছে।

সুপ্রাচীনকাল থেকেই আরব মরক্কো ও ইউরোপীয় বণিকেরা ও এগারসিন্দুর সহ এই অঞ্চলে বাণ্যি করতে আসতো। তখন মসলিন নামে বহু মূল্যবান একটি আকর্ষণীয় এদত অঞ্চলে তৈরী হতো। যার কদর ছিল সারা বিশ্বে। একাদশ – দ্বাদশ শতাব্দীতে মুসলমানদের আগমনে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে এ অঞ্চলের সমাজ জীবনে। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ঈশা খাঁ ও মানসিংহের যুদ্ধের পরে। পরাজিত ও বিজিত সৈন্যদের অনেকেই আর স্বদেশে আর ফিরে যেতে পারেনি। এগারসিন্দুরসহ আশে পাশের সমগ্র এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে তারা। সৈনিক,নাবিক, বণিক, দেওয়ান, সৈয়দ, পাঠান, খান,ঠাকুর, মুনসী, মীর, বৈরাগী,ভূঞা, খন্দকার, মিয়া, বিশ্বাস, মাঝি – মাল্লা, দাঁড়ি, আকন্দ যে যেদিকে সুবিধা পেল সেদিকেই বসতি স্থাপন করতে শুরু করলো। আসলেন বাইরে থেকে মুসলিম সুফি সাধকরাও । তাদের প্রচেষ্টাই এদেশে ইসলামের মহান বাণী প্রচার হতে থাকে দেশের আনাচে – কানাচে। এ অঞ্চলের নির্যাতিত মানুষের জীবনে আসে মুক্তির নিশ্বাস। যুগ যুগান্তরের অন্ধকার বুহ্য থেকে মুক্তি পায় কটিয়াদী এলাকার মানুষ।

কটিয়াদী নামক স্থানটি অনেক দুর দূরান্তে ও পরিচিত। এর পিছনে অবদান রয়েছে কটিয়াদীতে অনেক কৃতি সন্তান জন্মগ্রহণ করেছেন। কটিয়াদী অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করে যারা দেশ বিদেশের মাটিতে সুনাম অর্জন করেছেন – তাদের মধ্যে কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো –


সত্যজিত রায় সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে মসুয়ার স্থান উল্লেখযোগ্য। সত্যজিত রায়ের ঐতিহাসিক পৈতিক ভিটা মসুয়াতে অবস্থিত। সত্যজিত রায়ের ডাক নাম ছিল মানিক। একদা যে বাড়ীকে বলা হত “পূর্ব বাংলার জোড়া সাকো’’। এক সময় এই বাড়ীতে বহু জ্ঞানীগুণীদের মিলন মেলা ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর দ্বিতীয় বাঙ্গালী যিনি এই নোবেল পুরস্কারের সমতুল্য অস্কার পুরস্কার পেলেন। ১৯৯২ সালে একাডেমী অব মোশান পিকচার্স কর্তৃক লাইফটাইম এচিভমেন্টের জন্য সত্যজিত রায়কে এ বিশেস পুরস্কারটি দেওয়া হয়।

উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী (১৮৬৩ – ১৯১৫) সত্যজিত রায়ের দাদা। গ্রাম – মসুয়া। ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শিশু সাহিত্যিক। তিনি উপমহাদেশের মধ্যে প্রথম হাফটোন ব্লক প্রস্তুত করে মুদ্রণ শিল্পে যুগান্তর সৃষ্ঠি করেন। তিনি অনেকগুলো বই প্রকাশ করেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য টুনটুনির বই, ছেলেদের রামায়ন, ছেলেদের মহাভারত, সেকাল ও একালের গল্প, বেচারাম ও কেদারাম ইত্যাদি।

সুকুমার রায় (১৮৮৭ – ১৯২৩) সত্যজিত রায়ের পিতা। জন্মস্থান – মসুয়া। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শিশু সাহিত্যিক। তার উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ হল ভাষা ও কথা, ছড়ার কথা, পাগলা দাসু, আবোল তাবোল, হ – য – ব – র – ল ইত্যাদি। সুকুমার রায় দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন শিশু সাহিত্যিক পথিকা ‘সন্দেশ’।

সুখলতা রায় (১৯৮৬ – ১৯৬৯) জন্মস্থান মসুয়া। প্রখ্যাত গল্প লেখিকা ও উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর কন্যা।

সারদা রঞ্জন রায় – গ্রাম মসুয়া। তৎকালীন ক্রিকেট খেলোয়ার ও বাংলার ক্রিকেট জগতের অদ্বিতীয় সাংগঠনিক নায়ক।

নরেন্দ্রনাথ মজুমদার – জন্মস্থান বনগ্রাম। বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও গল্পকার। তিনি পৌরনিক রাজা “হরিষ চন্দ্র পালের” কাহিনী নিয়ে লিখেছিলেন “শৈব্যা”। প্রকাশিত বই “ব্রত কথা” উল্লেখযোগ্য।

রামেশ্বর নন্দী – গচিহাটা গ্রামের নন্দী পরিবারের উজ্জল দৃষ্টান্ত রামেশ্বর নন্দী। তিনি ষোরশ শতাব্দীর অন্যতম কবি। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে মহাভারত অন্যতম।

রামকুমার নন্দী – ১৮৩১ সালে গচিহাটা নন্দী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার মৃত্যু তারিখ জানা যায় নি। তিনি অনেকগুলো গ্রন্থের প্রকাশক, কবি, নাট্যকার ও সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন।

বিষুরাম নন্দী – জন্মস্থান গচিহাটা। ১৮ শতকের অন্যতম কবি ছিলেন। প্রকাশিত গ্রন্ত ‘ভারত সাবিএ’ উল্লেখযোগ্য। বিষুরাম নন্দী, রামকুমার নন্দী, এবং রামেশ্বর নন্দী তারা একই পরিবারের লোক ছিলেন।

নিরোধ কিশোর রায় চৌধুরী – জন্মস্থান বনগ্রাম।  বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, সাংবাদিক ও লেখক।  তৎকালীন সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইংরেজী পত্রিকা “মডার্ন রিভিউ” এর সহকারী সম্পাদক।

হেমেন্দ্র নাথ মজুমদার – জন্মস্থান গচিহাটা গ্রামে। প্রখ্যাত চিএশিল্পী। পাতিয়ালার রাজকীয় শিল্পী রূপে সম্মানিত।  “শিল্পী” নামক ইংরেজী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

মনোরঞ্জন ধর – জন্ম মুমুরদিয়া ইউনিয়নের ভাগরেব গ্রামে।  বিশিষ্ট সংস্কৃতিসেবী, পত্রিকা সম্পাদক, আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অর্থমন্তী ও পরে বাংলাদেশ সরকারের আইনমন্তী এবং জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।  তিনি ছাত্র অবস্থা থেকেই রাজনীতি করতেন।  বাবু মনোরঞ্জন ধরের কথা উল্লেখ করতে গেলে বলতে হয় যে, ব্রিটিশরা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ১৯৩৫ – ১৯৩৭ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত একটানা তিন বছরে ভৈরব রেলওয়ে সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ করেন।  এতে তখন ভারতীয় মুদ্রায় ব্যয় হয় ৬৪ লক্ষ টাকা। বাংলার প্রধান মত্রী শেরে বাংলা এ – কে ফজলুল হক ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ষষ্ঠ জর্জের নামে এ সেতুটি উদ্বোধন করেন সেতুটি উদ্বোধনের পর মনোরঞ্জন ধর ছাত্র নেতা হিসেবে একে ফজলুল হকের সাথে সাক্ষাত করে কটিয়াদী এলাকার বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন।

হুমায়ুন কবির – জন্মস্থান বনগ্রাম ইউনিয়নের নাগেরগাও গ্রামে। বর্তমান সময়ের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী। বিশ্বের প্রথম রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টারের আবিষ্কারক। তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বনগ্রাম থেকেই অর্জন করেন।

কবি আবিদ আনোয়ার (মূলনাম – আব্দুর রহিম) = জন্মস্থান মসুয়ার চর আলগী গ্রামে। বর্তমান প্রজন্মের কবিদের মধ্যে একটু আলাদা বৈশিষ্ঠের অধিকারী। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “প্রতিবিম্বের মমি”। তার লেখা বাংলা কবিতার আধুনিকায়ন গ্রন্থটি ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার জন্য ১৯৭৯ সালে রাষ্ঠপতি পদক ছাড়াও যুক্তরাষ্ঠের জাতীয় সাংবাদিকতা বিশেষজ্ঞ সমিতির সম্মানসূচক সদস্যপদ লাভ, সাহিত্য কর্ম পদক – WRITER’S স্মারক পদক ও সংবর্ধনা এবং স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী পদক (সৈয়দ নজরুল ইসলাম পদক) লাভ করেন।


কটিয়াদীর ইতিহাস 
লিখেছেনঃ সারোয়ার হোসেন শাহীন