বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন জন তাদের মতামত ও যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। এ নিবন্ধে বিজ্ঞজনদের উপস্থাপিত মতগুলো নিয়েই আলোচনার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ভৌগলিক মানচিত্রে কিশোরগঞ্জের নাম নেই। উল্লেখ্য যে, এ পর্যন্ত যারা কিশোরগঞ্জের নামকরণ বিষয়ে আলোচনা করেছেন তারা সবাই বলতে চেয়েছেন ‘কিশোরগঞ্জ’ নামকরণ হয়েছে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে কিশোরগঞ্জ মহকুমা প্রতিষ্ঠার সময়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কিশোরগঞ্জ নামকরণ হয়ছে এর আরো পূর্বে। কারণ ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে কিশোরগঞ্জ মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়। অথচ এর পূর্বেই এই অঞ্চলে কিশোরগঞ্জ, নিকলী ও বাজিতপুর নামে তিনটি থানা প্রতিষ্ঠিত ছিল।

জানা যায়, ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহের তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট বিশাল ময়মনসিংহ জেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে জেলার পূর্ব ও পশ্চিমে দুটি মহকুমা প্রতিষ্ঠার জন্য গভর্নমেন্টের আন্ডার সেক্রেটারির নিকট প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। ওই প্রস্তাবে শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, হাজিপুর, পিংনা এই চারটি থানা নিয়ে জামালপুর মহকুমা এবং নিকলী, বাজিতপুর, ফতেপুর ও মাদারগঞ্জ এই চারটি থানা নিয়ে হোসেনপুরের দগদগা অথবা নিকলীতে মহকুমা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাব করা হয়। ফলে ধারণা করা যায় কিশোরগঞ্জ নামে থানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দের পর। অর্থাৎ ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কোনো এক সময় কিশোরগঞ্জ থানা প্রতিষ্ঠার সময় কিশোরগঞ্জ নামকরণ করা হয়েছিল। বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি সংগ্রাহক ও গবেষক মোহাম্মদ সাইদুর ও মোহম্মদ আলী খান সম্পাদিত ‘কিশোরগঞ্জের ইতিহাস’ গ্রন্থে নাম করণ বিষয়ে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘রেনেলের মানচিত্রে (১৭৮১) কিংবা ময়মনসিংহ জেলা প্রতিষ্ঠাকালে (১৭৮৭) কালেক্টরেটের রিপোর্টে কিশোরগঞ্জ নামের কোন উল্লেখ পাওয়া যায়নি। এমনকি ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে যখন বৃহত্তর ময়মনসিংহে জামালপুর মহকুমার সৃষ্টি হয় তখনো কিশোরগঞ্জ সম্পর্কে কোন আলোচনা পাওয়া যায় না’।

গ্রন্থের অন্য এক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে কিশোরগঞ্জ মহকুমা হওয়ার সময় থানা ছিল ৩টি, তা হল নিকলী, বাজিতপুর ও কিশোরগঞ্জ’। উল্লেখিত আলোচনা থেকে স্পষ্ট অনুমান করা যায় যে, কিশোরগঞ্জ নামকরণটি মহকুমা প্রতিষ্ঠার সময় হয়নি, হয়েছে থানা প্রতিষ্ঠার সময়। কলকাতা থেকে প্রকাশিত জ্ঞানের সন্ধানে নামক একটি বইয়ে ( ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে) কিশোরগঞ্জ নামের উৎপত্তি এবং নামকরণ বিষয়ে প্রথম আলোচনা হয়। এতে নন্দ কিশোরের নামে কিশোরগঞ্জের নামকরণ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এরপর কিশোরগঞ্জ ’৭৭ প্রদর্শনী স্মরণিকায় বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি সংগ্রাহক, গবেষক ও সাংবাদিক মোহাম্মদ সাইদুরের লেখায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ‘কিশোরগঞ্জের ইতিহাস’ গ্রন্থে মোহাম্মদ সাইদুর ও মোহাম্মদ আলী খান কিশোরগঞ্জের নামাকরণ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করেন। তাঁদের বর্ণনা এরূপ, ‘…নামকরণের উৎস সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে বিজ্ঞজনদের ধারণা ও জনশ্রুতি থেকে অনুমান করা যায় যে, বর্তমান ধ্বংশপ্রাপ্ত বত্রিশ প্রামাণিক পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণদাস প্রামাণিকের ষষ্ঠ ছেলে এবং প্রামাণিকদের কীর্তি একুশ রত্নের স্রষ্টা নন্দকিশোর এর ‘কিশোর’ ও তাঁরই প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় হাট বা গঞ্জের ‘গঞ্জ’ যোগ হয়ে কিশোরগঞ্জ নামকরণ হয়েছে’।

কিশোরগঞ্জের নামকরণ বিষয়ে বিশিষ্ঠ লেখক ও ইতিহাসবিদ মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন শাহজাহান ভিন্নমত পোষন করে এ ব্যাপারে তিনটি কারণ উল্লেখ করে নিম্নরূপ মত দিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে তিনটি কারণে উল্লিখিত বক্তব্যটি গ্রহণ করা কষ্টসাধ্য। প্রথমত: যখন কিশোরগঞ্জ নামের থানার প্রতিষ্ঠা হয় তখনও হয়বতনগর ও জঙ্গলবাড়ির দেওয়ানগণ খুবই প্রতিপত্তির সাথে তাদের জদিারী পরিচালনা করে আসছিলেন। দ্বিতীয়ত: যে স্থানটিতে কিশোরগঞ্জ শহরটি অবস্থিত এই শহরের বেশিরভাগ ভূমি তখন পর্যন্ত হয়বতনগরের দেওয়ানদের জমিদারি স্টেটের অধীন ছিল। তৃতীয়ত: যে স্থানটিকে কেন্দ্র করে কিশোরগঞ্জ শহর প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে সেই স্থানটিতে কৃষ্ণদাস প্রামাণিকের অধস্তনদের এমন কোন অবদান ছিল না যে অবদানের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার হয়বতনগর দেওয়ানদেরকে উপেক্ষা করে নন্দ কিশোর প্রামাণিকের নামে এই স্থানটির নামকরণ করতে হবে। এছাড়া যদি নন্দকিশোর প্রামাণিকের নামে স্থানটির নামকরণ হতো তাহলে স্থানটির নাম হতো নন্দপুর। কোন ব্যক্তি নামের সাথে যুক্ত করে নামকরণের বেলায় শেষ নামকে গ্রহণ করা হয় না; বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয় প্রথম নাম। যেমন হয়বত দাদ খানের নামে হয়বতনগর, সুজাত আলীর নামে সুজাতপুর, জমিদার রামচন্দ্রের নামে রামপুর ইত্যাদি। অতএব এই ক্ষেত্রে কোনো অনুমান নির্ভর বক্তব্য ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য হয় না’। কিশোরগঞ্জের ইতিহাস গ্রন্থে মুক্তাগাছার জমিদারের নামের সাথে ‘ কিশোর’ যুক্ত করে ওই জমিদারের নামে কিশোরগঞ্জের নামকরণের কথাও বলা হয়।

যদিও স্বীকার করা হয়েছে এটাও সত্য নয়। কারণ এ এলাকাটি তখন মুক্তাগাছা জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত ছিলনা। কিশোরগঞ্জ নামকরণ বিষয়ে আরো একটি মত ঢাকাস্থ কিশোরগঞ্জ সমিতির ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের স্মরণিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাতে পাকুন্দিয়া উপজেলার প্রবীন ব্যক্তিত্ব রসরাজ সাহা চৌধুরি দাবি করেছেন যে, ‘ কিশোরগঞ্জ মহকুমা প্রতিষ্ঠকালে কিশোরী মোহন নাথ নামে একজন সমাজ দরদী সাব-রেজিষ্টার মহকুমা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তরিকভাবে শ্রম, সময় ও মেধা দিয়ে মহকুমা প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে নিয়োজিত ইংরেজ কর্মচারি-কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করেন। তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে ইংরেজ কর্মচারিগণ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ স্বরূপ কিশোরী মোহন নামের কিশোরীর দীর্ঘ-ইকার বাদ দিয়ে ‘গঞ্জ’ শব্দ যোগ করে কিশোরগঞ্জের নাম করণ করেন’।

নিম্নরূপ: এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, যে স্থানটিতে কিশোরগঞ্জের কোর্ট-কাচারি স্থাপিত হয়েছিল সে এলাকাটি বর্তমানে কোর্ট শোলাকিয়া নামে পরিচিত হলেও স্থানটি সপ্তদশ শতাব্দীর প্রারম্ভ থেকে ‘ঈসাগঞ্জ’ নামে পরিচিত ছিল। স্থানটির আশপাশে গড়ে উঠেছিল বস্ত্র শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং এ থেকে উৎপন্ন অন্যান্য সামগ্রীর প্রতিষ্ঠানসহ আরো বেশ কিছু শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও ওই সময় থেকে এ স্থানে গরু, মহিষ, ছাগল ও ঘোড়ার এক বিশাল হাট ছিল। এখনো ঈসাগঞ্জ গরুর হাট নামে পৌরসভার পক্ষ থেকে বাজারটি পরিচালিত হয়ে আসছে। যে স্থানকে কেন্দ্র করে নগরসভ্যতার বিকাশ ঘটে সেই স্থানটিতেই সরকারি দপ্তরগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই কিশোরগঞ্জের কোর্ট কাচারী স্থাপিত হয়েছিল ঈসাগঞ্জে।

তারপরও কিন্তু কিশোরগঞ্জ নামে থানা অথবা মহকুমা প্রতিষ্ঠার সময় হয়বতনগর কিংবা ঈসাগঞ্জ নামটিকে গ্রহণ না করে কিশোরগঞ্জ নামে শহরটির নামকরণ করা হয়েছিল। বিভিন্ন তথ্য বিবরণ থেকে জানা যায় বৃটিশ সরকার যখন ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে কিশোরগঞ্জ মহকুমা প্রতিষ্ঠা করেন তখন নিম্নলিখিত পরগণাগুলো কিশোরগঞ্জ মহকুমার অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন। পরগণাগুলো হ’ল-হোসেনশাহী, জোয়ার হোসেনপুর, নাসিরউজ্জিয়াল, হাজরাদী, কুড়িখাই, জোয়ানশাহী এবং বরদা খাত। বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন শাহজাহান কিশোরগঞ্জ নামকরণ বিষয়ে আরো বলেন, ‘ষোড়শ শতকে এই পরগণাগুলো ছিল ভাটি রাজ্যের অধিপতি ঈসা খান মসনদ-ই-আলার নিয়ন্ত্রণে। ঈসা খানের মৃত্যুর পর ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার স্বাধীনতা বিনষ্ট হলে রাজস্ব প্রদানের শর্তে ঈসা খানের অধস্তনগণ দিল্লীর সম্রাটের কাছ থেকে জমিদারী প্রাপ্ত হন। এরপরেও জঙ্গলবাড়ি এবং হয়বতনগরের জমিদারদের প্রভাব প্রতিপত্তির কথা ইংরেজ সরকারের অজানা ছিল না। থানা প্রতিষ্ঠার সময় হয়বতনগর দেওয়ানবাড়ির জমিদার এবং জঙ্গলবাড়ির জমিদারদের সাথে থানা প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত ইংরেজ কর্মকর্তাদের অবশ্যই আলাপ আলোচনা হয়েছিল’।

যতদূর সম্ভব হয়বতনগরের দেওয়ানগণ এই অভিমতই ব্যক্ত করেছিলেন যে, কোনো ব্যক্তি নামের সাথে সংগতি রেখে প্রস্তাবিত থানার নামকরণ না করা হোক। কারণ দেওয়ান হয়বত দাদ খান যখন হয়বতনগর হাভেলীতে বসতি স্থাপন করেন তখন তাদেরই প্রয়োজনে গড়ে ওঠে হয়বতনগরের আশেপাশের জনপদগুলো। এই জনপদের একটিও কোনো ব্যক্তি নামের সাথে সংগতি রেখে নামকরণ করা হয়নি। যদিও প্রতিটি জনপদের নাম তারাই রেখেছিলেন বলে অনুমান করা যায়। বিষয়টি উল্লেখযোগ্য যে, কিশোরগঞ্জ শহরের মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে প্রবাহিত প্রাচীন নদী সুনন্দা, যা বর্তমানে নরসুন্দা নামে খ্যাত। ষোড়শ শতকের দিকেও এই সুনন্দা নদীর আশেপাশের শাখা নদীসমূহ অসংখ্য ধারায় প্রবাহিত হতো।

আজ এ নদীগুলোর চিহ্ন দেখা যায় সর্বত্র। এই শহরের আশেপাশের ওই নদীগুলো ছাড়াও অসংখ্য বিলের অবস্থানের বিষয়টি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। মাত্র দু’একটি স্থান ছাড়া কিশোরগঞ্জ শহরের সকল স্থানই নদী এবং বিল থেকে জেগে ওঠা চরের অন্তর্ভূক্ত’। যেমন কাতিয়ারচর, বুরুঙ্গারচর, চরশোলাকিয়া, চর মারিয়া এই স্থানগুলো কিশোরগঞ্জ শহরের আশেপাশের অঞ্চল। সম্ভবত এই জনপদগুলো গড়ে উঠেছে সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে। এমতাবস্থায় স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, দেওয়ান হয়বত দাদ খান যখন এই স্থানে বসতি স্থাপন করেন তখন এই স্থানের আশেপাশে কোনো জনবসতি ছিল না। যদি কোনো জনবসতি থাকত তাহলে ওই সকল স্থানের কোনো নামের সন্ধান অবশ্যই পাওয়া যেত ’।

‘ঊনিবিংশ শতাব্দীর দিকে বর্তমান কিশোরগঞ্জ শহরের আরো একটি স্থানের নামের কথা জানা যায়, তা হচ্ছে ‘মেলাবাজার’। বর্তমান বত্রিশ এলাকার প্রামাণিকের বসতবাড়ির সম্মুখের পুকুর পাড়ের সংলগ্ন এলাকাটি মেলাবাজার নামে খ্যাত। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দের পর হয়বতনগর এবং জঙ্গলবাড়ির দেওয়ানদের নিয়ন্ত্রণাধীন পরগণাগুলোকে নবাব সরকারের পক্ষ থেকে নতুন করে বন্দোবস্ত করার কারণে বেশ কিছু সংখ্যক নতুন জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল। তাদের মধ্যে বত্রিশের প্রামাণিকরা অন্যতম। শ্রী কেদারনাথ মজুমদার প্রামাণিকের আবাসস্থল এলাকাটিকে ‘কাটাখালি’ বলে উল্লেখ করেছেন’। ‘বিষয়টি আলোচনার যোগ্য যে, কোনো একটি প্রভাবশালী পরিবার যখন কোথাও বসতি স্থাপন করতেন তখন ওই প্রভাবশালী পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা অথবা পূর্বপুরুষের নামে স্থানটির নামকরণ হতো। যেমন হয়বত দাদ খানের নামে হয়বতনগর, নান্নু খানের নামে নানশ্রী, করিম খানের নামে করিমগঞ্জ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

বত্রিশ প্রামাণিক জমিদার কৃষ্ণদাস নান্দাইল উপজেলার বারপাড়া থেকে এই স্থানে প্রথম বসতি স্থাপন করেন তখন এই স্থানের আশপাশ অঞ্চলটি ছিল মসলিন বস্ত্র উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য এলাকা। কৃষ্ণদাস ছিলেন একটি ফরাশি বণিকের বাণিজ্যকুঠির সরকার। পরবর্তীতে ফরাশী বণিক চলে গেলে কৃষ্ণদাস নামমাত্র মূল্যে বাণিজ্যকুঠি ক্রয় করেন। তিনি মসলিন বস্ত্র ব্যবসায় প্রভূত উন্নতি করেন। কাটাখালী নামক স্থানে তিনি বাসস্থান নির্মাণ করেন যা বর্তমানে বত্রিশ মেলাবাজার নামে পরিচিত। বর্তমানে এই স্থানেই টেকনিক্যাল স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে’। সম্ভবত হয়বত নগরের পাশাপাশি ওই সময় কাটাখালীর নামটি ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেছিল। ফলে কাটাখালী নামটি তারা পরিবর্তন করেননি। এছাড়াও ওই সময়কালে আরো যে কয়টি স্থানের নামের কথা জানা যায় তন্মধ্যে কুঠিগির্দী, নওগাঁও (নগুয়া), কাতিয়ারচর, মোল্লাপাড়া, বাগে দিয়ার (বগাদিয়া) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। উল্লেখিত স্থানগুলোর অবস্থান হয়বত নগরের চারদিকে। তন্মধ্যে কাতিয়ারচর ও মোল্লাপাড়া বর্তমানে পৌর এলাকার বাইরে। আর এই জনপদ গুলো গড়ে উঠেছিল হয়বত নগর দেওয়ান বাড়িকে কেন্দ্র করে’। ‘উল্লেখিত স্থানের নামগুলোর মধ্যে কুঠিগির্দীর ‘গির্দী’ শব্দটি ফারসী ‘গীর্দ’ শব্দ থেকে চয়ন করা হয়েছে যার অর্থ অঞ্চল বা এলাকা।

নওগাঁও এর ‘নও’ শব্দটি ফারসী শব্দ অর্থ নতুন গাঁও, যা পরবর্তী সময় ‘নগুয়া’ নামে বিবর্তন ঘটেছে। বাগেদিয়ার, ‘বাগ’ ফারসী শব্দ অর্থ বাগান ‘দিয়ার’ আরবী শব্দ অর্থ এলাকা বা মহাল অর্থাৎ বাগান হিসেবে ব্যবহৃত স্থানকে ‘বাগে দিয়ার’ বলে অভিহিত করা হয়। সম্ভবত এই স্থানটিতে হয়বতনগর দেওয়ানবাড়ির অথবা প্রামাণিকদের বাগান ছিল। অনুসন্ধানে জানা যায় যে, বগাদিয়ার আশেপাশে বেশ কয়েকটি মালিবাড়ি ছিল; যে মালিরা বাগান পরিচর্যা করত। তাদেরকে লাখেরাজ সম্পত্তি পর্যন্ত দেয়া হয়েছিল। তাই স্থানটির নাম বাগেদিয়ার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ‘কাতিয়ারচর’ আরবি ‘কিতা’ শব্দ থেকে কাত শব্দের উৎপত্তি, অর্থ জমির অংশ, এখানে কাতিয়ারচর অর্থ চরের অংশ। তবে এলাকার জনগণ ‘কাতিয়া’ বলতে চাটাই অর্থও বোঝাতে চেষ্টা করেন; যা আদৌ সঠিক নয়। বিশিষ্ট ছড়াকার ও গবেষক জাহাঙ্গীর আলম জাহান-এর মতে, নীল ব্যবসায়ী মিষ্টার গিরিডি নামক এক ইংরেজ নীলকর উল্লেখিত স্থানে একটি কুঠি স্থাপন করেছিলেন।

যে কারণে স্থানটির নাম একসময় ‘গিরিডির কুঠি’ এবং পরে ‘কুঠি গিরিডি’>কুটিগির্দি হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। আরো একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, বর্তমান পুরানথানা এলাকায় যখন একটি বাজার বাসানো হয় তখন এই স্থানটির নামকরণ করা হয়েছিল হয়বতনগরের জমিদার দেওয়ান মাতোব খানের নামে মাহতাবগঞ্জ। কিন্তু এই নামটিও প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি বরং পুরানথানা নামেই স্থানটি ব্যাপকভাবে পরিচিত লাভ করে’। উপরোল্লেখিত আলোচনা থেকে আমরা বেশ ক’টি ধারণা পেলাম। কিশোরগঞ্জ নামকরণ বিষয়ে অনেকেই বিভিন্ন মত পেশ করে তাদের মতের পক্ষে যুক্তি তোলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কোন যুক্তিকেই খাট করে দেখার কারণ নেই। অতএব ধরে নেয়া যায় যে, কিশোরগঞ্জ নামকরণ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন। এ ক্ষেত্রে কোন যুক্তিকে একেবারেই সত্য অথবা অসত্য এমনটি না বলে বরং ভবিষ্যত গবেষক ও ঐতিহাসিকদের হাতে ছেড়ে দেয়াই যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করছি।

লিখেছেনঃ মোহাম্মদ আব্দুল লতিফ