প্রকৃত অর্থেই যারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার সংগ্রামে নিজের জীবন-যৌবন উৎসর্গ করেন তেমন মানুষের সংখ্যা দিন দিনই বাংলাদেশ থেকে কমে যাচ্ছে।  আর নিঃস্বার্থ, ত্যাগী, নিবেদিত  প্রান রাজনৈতিক কর্মীতো বাংলাদেশের অভিধান থেকে মোটামুটি নির্বাসিতই হয়েছে।  কিন্তু এমন রাজনীতিবিদতো বাংলাদেশে ছিল, এবং কিশোরগঞ্জেও ছিল, যারা কিনা আমাদেরকে গৌরবান্বিত করেছিল, আলোর পথ দেখিয়েছিল।  কিশোরগঞ্জেরইতো সন্তান বাবু ত্রৈলক্ষনাথ চক্রবর্তী, নগেন সরকার, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এবং সদ্য প্রয়াত (জানুয়ারী ৯, ২০১২) আইউব রেজা চৌধুরী।

আজকের লেখাটা আমি উৎসর্গ করছি ভাটির শার্দূল নামে ক্ষ্যাত বিপ্লবী রাজনীতিবিদ আইউব রেজা চৌধুরীকেই।  তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ১৯৬৯ সালে যখন  সারা বাংলাদেশ ফুসছিল গণঅভ্যূত্থানের জোয়ারে। আমি তখন সরারচর শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্র।  একদিন আইয়ুব রেজা চৌধুরী এলেন আমাদের হাই স্কুলে, সাথে আরও কয়েকজন স্থানীয়নেতাকে নিয়ে, এবং আমাদের সবাইকে বললেন ক্লাস বর্জন করে তাদের সাথে মিছিলে যোগ দিতে।  আমাদের শিক্ষকরাও বাধা দিলেননা। আমরা শত শত ছাত্র মিছিল করে সরারচর বাজার প্রদক্ষিন করলাম। মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আকাশে, গগন বিধারী স্লোগান সবার কন্ঠেঃ  ১১ দফা মানতে হবে, জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো, ৬ দফা মেনে নাও-মানতে হবে।

মিছিল শেষে খেলার মাঠে জনসভা। সেখানে স্থানীয় বেশ কয়েকজন বক্তৃতা করলেন,  কিন্তু সবার চোখ সুদর্শন, লম্বাদেহী, অনলবর্ষী বক্তার দিকে।  তাঁর আগমনের কথা কয়েকদিন আগে থেকেই মাইকে ভেসে  আসছিল – ভাটির শার্দূল, বিপ্লবী নেতা আইউব রেজা চৌধুরী।  তার বক্তৃতা তন্ময় হয়ে শুনেছিলাম আর মনের গহীনে তাকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলাম সেই কিশর বয়সে। তাঁর বলা সব কথা আজ স্মৃতির পাতা থেকে ঝরে গেছে, কিন্তু মনে আছে তার প্রত্যয়ের কথা, দৃঢ়চেতা মনভাবের কথা।

দ্বিতীয়বার এই বিপ্লবী নেতার সাথে আবার দেখা  হয় সম্পুর্ন এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসের ৩১ তারিখে কিশোরগঞ্জ জেলে। আমি তখন বাজিতপুর কলেজের ছাত্র। সেদিন আকাশ ছিল মেঘলা। সকালে আমার বন্ধু সামসুর কাছ থেকে খবর পেলাম যে আমাদের কলেজের অধ্যাপক ইয়াকুব আলীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে এবং কলেজের এবং এলাকার মানুষেরা তাঁর মুক্তির দাবীতে মিছিল করবে এবং কিশোরগঞ্জ কোর্টে যাবে।  অধ্যাপক ইয়াকুব আলীর সাথে  আমার  সরাসরি কোন পরিচয় বা যোগাযোগ আমার তখনও হয়নি, কিন্তু তার বিপ্লবী রাজনীতির কথা আমি শুনেছিলাম।  কিশোর বয়সে মেহনতী মানুষের পক্ষের রাজনীতিতে সেই সময় অনেক সৎ এবং মেধাবী তরুন-যুবকরাই আকৃষ্ট হয়েছিল।  আমিও শোষিত মানুষের পক্ষে রাজনীতি করার তাগিদ  অন্তরে দারুনভাবেই অনূভব করতাম। সেই দিনের মিছিলে যোগ দিয়েছিল শত শত মানুষ, এবং জীবনে প্রথমবার (এবং শেষবারও) রেলগাড়ির ছাদে উঠে কিশোরগঞ্জ গিয়েছিলাম।  আমাদের মিছিল কোর্ট এলাকায় যেতেই দাঙ্গা পুলিশ পুরো এলাকা গিরে ফেলে এবং সেখান থেকে সেদিন মোট ২২ জনকে ধরে নিয়ে জেলে চালান করে দেয়।  সেই সময় ২২ জনের রাজনৈতিক মামলাটি সারা কিশোরগঞ্জ জেলায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল।  যেকথা বলছিলাম, সেরাতে জেলে গিয়েই আবার দেখা
হয়ে গেলো আইউব রেজা চৌধুরীর সঙ্গে।  তাঁকে এর কয়েকদিন আগেই জেলখানায় আনা হয়েছিল।  আমি যেহেতু বয়সে তরুন ছিলাম এবং রাজবন্দী ছিলাম, সে সুবাদেই একটি ছোট সেলে জায়গা পেলাম যেখানে আইউব রেজা চৌধুরী এবং ইয়াকুব আলীও ছিলেন।

 

আইউব রেজা চৌধুরীকে এত কাছে পেয়ে যাব কোন্দিন ভাবতেই পারিনি।  আমার কাছে মনে হয়েছিল জেলে আছিতো কি হয়েছে, আইউব রেজা চৌধুরীর মতো বিপ্লবী নেতার সাথে এক ঘরে আছি এটা কয়জনের জীবনে ঘটে।  খুব দ্রুতই আইউব রেজার চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ পরিচয় এবং ভালো সম্পর্ক হয়ে গেল। তার কাছ থেকেই প্রথম জেনেছিলাম যে একটি শ্রেণীবিভিক্ত সমাজে কোন মানুষই আসলে শ্রেণী স্বার্থের উর্ধেনা, এবং কেউই আসলে রাজনীতির বাইরেনা।  তিনে আর একটা কথা বলতেন যে, যেকোন মানুষ যদি তার সাথে কয়েক মিনিট যেকোন প্রসংগ নিয়েই আলোচনা করে, তাহলে তিনি বলে দিতে পারবেন সেই লোকটা সমাজে কোন শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে।  প্রথমে আমআর কাছে এই কথাটা অবিশ্ব্যাস্য মনে
হলেও কালের ব্যাবধানে এর মর্মার্থ ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম।  তাঁর জ্ঞান, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, এবং দর্শন আমাকে খুবই আকর্ষন করতো। কয়েকদিন পরেই সেই দুঃখ ভরা দিনটি এসেছিল, অর্থাৎ আইউব রেজা চৌধুরীকে ময়মনসিংহ জেলে পাঠিয়ে দিল। যাওয়ার আগে আমার মন খুবই খারাপ হয়েছিল, সেটা বুঝতে পেরে তিনি আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, “আবার দেখা হবে বিজয়ের পতাকা তলে”।

তারপর আর কোনদিন তাঁর সংগে দেখা হয়নি।  তাঁর রাজনীতির সংস্পর্শেও আর আসা হয়নি।  এর পরে প্রবাসের মাটিতেই কেটে গেছে প্রায় ত্রিশ বছর।  দেশের রাজনীতির খবর রাখলেও দেশের মাটিতে পা না রেখে আর যাই করা যাক রাজনীতি করা যায়না বলেই আমার বিশ্বাস, কারণ রাজনীতি করতে হলে মানুষদের পাশে থাকতে হবে, অংশীদার হতে হবে তাদের সুখের এবং দুঃখের।

পত্রিকান্তরে খোঁজ রাখতাম আইউব রেজা চৌধুরীর রাজনীতির।  তিনি সাংগঠনিকভাবে খুব বেশী সাফল্য দেখাতে না পারলেও একজন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তাত্ত্বিক হিসাবে বাম রাজনীতির অংগনে বেশ বড় জায়গা করে নিয়েছিলেন।  তাঁর সর্বশেষ প্রয়াস ছিল কমিউনিস্ট ইউনিওয়ন, যার একটা মূল সুত্র হচ্ছে,

“বাঙলাদেশের অগ্রসর ও বিপ্লবী কমিউনিস্টদের কর্তব্য প্রধানতঃ দেশীয় পুঁজিবাদ উচ্ছেদ ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সংগঠিত করা।” –আইউব রেজা চৌধুরী (২৩.১২.২০১১)

আমার যেকথাটা আজও জানার বাকী রয়ে গেল তা হলো, কিসের বিজয়ের কথা সেদিন তিনি আমাকে বলেছিলেন? নিশ্চয়, মেহনতী মানুষের মুক্তির কথা, তাদের রাজনৈতিক বিজয়ের কথা।  সে বিজয় আজো আসেনি।  বিজয়ের পতাকা তলে আমাদের আর দেখা হয়নি, তাই বলে বিজয় কি আসবেনা?  আমার দৃঢ বিশ্বাস ইতিহাস সুনির্দিষ্ট পথে সে বিজয় একদিন অবশ্যই আসবে, এবং বিপ্লবী নেতা আইউব রেজা চৌধুরী সেদিন আমাদ্র পাশেই থাবেন।  কমরেড তোমাকে লাল সালাম!

খালেকুজ্জামান মতিন, লক হ্যাভেন, পেনসিলভেনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র