পেছনে উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দোতলা ভবন। ডানে-বাঁয়ে বিশালাকৃতির গাছপালা। মাঝখানে ছিল সরকারি হাসপাতালের পুরনো একতলা পাকা ভবন। কথিত ইজারাদাররা ভবন ভেঙে সাবাড় করে ফেলেছে। চলছে গাছকাটার কাজ। বাজিতপুরের সরারচরে দুই কোটি টাকা মূল্যের সরকারি এ সম্পদ এভাবেই বেহাত হতে বসেছে।
রিভিশনাল সেটেলমেন্ট (আরএস) বা সংশোধনী জরিপ অনুযায়ী কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার সরারচর উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভূমির মালিক স্বাস্থ্য বিভাগ। স্বাস্থ্য বিভাগই জায়গাটি রক্ষণাবেক্ষণ করছে। পরিশোধ করছে খাজনা। ওই ভূমিতে একটি হাসপাতালও রয়েছে। কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদ উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র বাদে ৮০ শতাংশ জায়গা যুবলীগ নেতার নামে সম্প্রতি ইজারা দিয়েছে। ইজারা নেওয়ার পর একটি সরকারি দালান ভেঙে ইট বিক্রি করা হচ্ছে। কাটা হচ্ছে শতবর্ষী দুটিসহ ৩০টি বিশাল আকৃতির গাছ।
বেআইনিভাবে সরকারি দালান ভাঙা ও গাছপালা কাটার খবর পেয়ে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত মঙ্গলবার ইজারাদারকে বাধা দেওয়া হলেও কাজ বন্ধ হয়নি।
জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনিছুজ্জামান বলেন, ‘কৃষিকাজের জন্য জায়গাটি একসনা বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে ওই জায়গার দালান ভাঙলে বা গাছ কাটা হলে ইজারা বাতিল করা হবে।’ তিনি জানান, স্টেট অ্যাকুইজিশন (এসএ) বা রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ খতিয়ানে জায়গার মালিক জেলা পরিষদ। তবে সংশোধনী (আরএস) খতিয়ানে জায়গাটি এখনো স্বাস্থ্য বিভাগের। নথি সংশোধনের জন্য মামলা দায়ের করা হয়েছে। ‘নথি সংশোধনের আগ পর্যন্ত ভূমির মালিক স্বাস্থ্য বিভাগ। আপনারা কিভাবে ইজারা দেন?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘জমি বেহাত হওয়ার আশঙ্কায় ইজারা দেওয়া হয়। সিভিল সার্জনকে নিয়ে জেলা পরিষদের বৈঠকে রেজল্যুশন করে জায়গাটি ইজারা দেওয়া হয়।’
তবে কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মৃণাল কান্তি পণ্ডিত বলেন, ‘জেলা পরিষদের বৈঠকে স্বাস্থ্য বিভাগের এ ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়ার বিষয়ে কোনো রেজল্যুশন হয়নি। নিয়মবহির্ভূতভাবেই জেলা পরিষদ স্বাস্থ্য বিভাগের ভূমি ইজারা দিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে (ডিজি) ঘটনা অবহিত করা হচ্ছে।’ তাঁর মতে, এটি ওই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের সম্পদ। এখানে ভবিষ্যতে ১০ শয্যার হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের কোয়ার্টার (আবাসন) তৈরি করা হবে। স্বাস্থ্য বিভাগ ওই জায়গার খাজনা পরিশোধ করে। তিনি আরো বলেন, ‘জমি বেহাত হওয়ায় উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হবে।’
জেলা পরিষদ সূত্র জানায়, বাজিতপুরের মজলিশপুর মৌজার আরএস ১২ নম্বর খতিয়ানের ২৩ ও ২৪ নম্বর দাগে ১ দশমিক ১৯ একর জমি। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ জমি গত ৩০ মার্চ জেলা পরিষদ সরারচরের বুড়িকান্দা গ্রামের শওকত হোসেনের নামে ইজারা দেয়। ভ্যাট, খাজনা, আয়করসহ বার্ষিক ৯ হাজার ৬০০ টাকায় ইজারা দেয়। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, ‘জায়গাটির দাম হবে প্রায় দুই কোটি টাকা।’
উপজেলা ভূমি অফিস সূত্র জানায়, এসএ খতিয়ানে জমির মালিক জেলা পরিষদ হলেও আরএস খতিয়ানে তা সরকারের পক্ষে স্বাস্থ্য বিভাগ, কিশোরগঞ্জের নামে চূড়ান্তভাবে রেকর্ডভুক্ত আছে। এর মধ্যে দুই দাগে ভূমির পরিমাণ ৭৭ শতাংশ ও বাদবাকি ৪২ শতাংশ পুকুর। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. জমিরউদ্দিন বলেন, ‘হাসপাতালের জায়গা জেলা পরিষদ থেকে ইজারা দিয়েছে। এ বিষয়ে বাজিতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) গত ১৫ এপ্রিল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য লিখিতভাবে জানিয়েছি। ইউএনওর নির্দেশে সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসি ল্যান্ড সরেজমিন তদন্ত করে ও রেকর্ডপত্র ঘেঁটে ইউএনওকে গত ২২ অক্টোবর প্রতিবেদন দিয়েছেন।’
এসি ল্যান্ডের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ‘এ ভূমি স্বাস্থ্য বিভাগের নামে রেকর্ডভুক্ত। আরএস খতিয়ান সংশোধন ছাড়া জেলা পরিষদ কর্তৃক ওই ভূমি ইজারা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
বাজিতপুর ইউএনও সারজিল হাসান বলেন, ‘এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে গত ২৩ অক্টোবর প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ওই ভূমিতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পুরনো পাকা ডিসপেনসারি দালান ভেঙে ফেলার কাজ প্রায় শেষ। সাফ করা হচ্ছে জঙ্গল। একটি বড় কাঁঠালগাছের ডালপালা কাটা। এ জায়গায় শতবর্ষের পুরনো দুটি রেইনট্রিগাছসহ প্রায় ৩০টি গাছ রয়েছে। এসব গাছের দাম সাত-আট লাখ টাকা হবে। এলাকাবাসী জানায়, গত কয়েক মাসে বেশ কিছু সরকারি গাছ কাটা হয়েছে। তাদের আশঙ্কা, বাকি গাছগুলো যেকোনো সময় কেটে ফেলা হবে। ঘটনাস্থলে পাওয়া যায় ইজারাদার ও যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত শওকত হোসেনকে। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আফজাল হোসেনের শ্যালক ওমর ফারুক রাসেল। তাঁদের সঙ্গে যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত হুমায়ুন কবীর, লিটন ভূঁইয়াসহ আরো ১০ জন যুবককে দেখা গেল। শওকত হোসেন প্রথমে বলেন, ‘এখানে কলা-পেঁপের চাষ হবে।’ পরক্ষণে বলেন, ‘বৃদ্ধাশ্রম করা হবে।’ শেষে আবার বলেন, ‘ধানের চাতাল করা হবে। আর পুকুরে মাছের চাষ হবে।’ সংসদ সদস্যের শ্যালক রাসেল বলেন, ‘জায়গাটিতে কী করা যায়, বন্ধুবান্ধব মিলে তা চিন্তাভাবনা করে দেখা হচ্ছে।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রভাবশালী একটি মহল জায়গাটি আত্মসাতের উদ্দেশ্যে শওকত হোসেনের নামে ইজারা বন্দোবস্ত নিয়েছে। ১০-১২ জন মিলে জায়গাটি ভাগবাটোয়ারা করার পরিকল্পনা করছে। তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এক ব্যক্তিসহ ক্ষমতাসীন দলের বেশ কয়েকজনের নাম প্রকাশ পাচ্ছে। সরকারি সম্পদ এভাবে বেহাত ও লুণ্ঠিত হতে দেখে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ। গোপনে অনেকে ক্ষোভের কথা জানালেও কেউ নাম-পরিচয় প্রকাশ করে মুখ খুলতে রাজি হয়নি।
You must log in to post a comment.