প্রায় ২২ বছর ধরে রূপকথা, উপকথা ও বিচিত্র গল্পগাঁথার কিচ্ছাপালা পরিবেশন করতে করতে ইসলাম উদ্দিন কিচ্ছাদারের নিজের জীবনই হয়ে উঠেছে জীবন-নাট্যের বিচিত্র এক পালা। এই দীর্ঘ সময়ে দুই হাজারেরও বেশি রাত কিচ্ছাপালা করেছেন তিনি। গ্রামীণ কিচ্ছাদারের মধ্যে সম্ভবত ইসলামই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের প্রশিক্ষক নির্বাচিত হন। ইসলাম উদ্দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া কিচ্ছাপালাটি নিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নাট্যকলা বিভাগ’ ভারতের জাতীয় নাট্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিলি্লর এনএসডি এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনি নগরীতে আলোড়ন তোলে। নিজেও রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে লন্ডনে কিচ্ছাপালা পরিবেশন করেন তিনি। কিচ্ছাপালা করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীসহ ঢাকার বিভিন্ন নাট্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনেও ।
ইসলাম উদ্দিনের জন্ম ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২ আগস্ট কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ থানার নোয়াবাদ গ্রামে। অল্প বয়সেই গ্রামীণ নাট্যপালার অভিনয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। প্রথম পর্যায়ে ‘কাশেম-মালা’ ও ‘দস্যু বাহরাম’ নামের দুটি ঝুমুর যাত্রাপালায় অভিনয় করেন। তখন তাঁর বয়স ১২/১৩।
এরই মধ্যে ইসলামদের এলাকায় কিচ্ছাগান করতে আসেন কুদ্দুস বয়াতী। তাঁর কিচ্ছাপালা দেখে মুগ্ধ নিজাম, মনে মনে ওস্তাদের আসন দিয়ে ফেলেন কুদ্দুস বয়াতীকে। একদিন কিচ্ছাগানের শিক্ষা নেওয়ার জন্য হাজির হয়ে গেলেন বয়াতীর বাড়িতে। ৬০০০ টাকা সম্মানীর বিনিময়ে তাঁকে কিচ্ছাগান শেখাতে রাজিও হয়ে গেলেন কুদ্দুস বয়াতী। এক বছরের মধ্যে ইসলামকে কিচ্ছাগানে পারদর্শী করে তোলার কথা দেন তিনি। এক এক করে কেটে গেল ছয়টি মাস। কিন্তু ইসলাম লক্ষ করলেন, গুরু তাকে কিচ্ছাগানের কোনো শিক্ষাই বুঝিয়ে দিচ্ছেন না। এ অবস্থায় ইসলাম কুদ্দুস বয়াতীর প্রধান সহকারী বিষ্ণুপদের শরণাপন্ন হলেন। ‘উনি কইলেন_’তুমি দলের তবলচি মাস্টার হাশেমের কাছে যাও। সে আমার থেকে বেশি অভিজ্ঞ।’ হাশেমের কাছে গেলাম। সে আমাকে বসে বসে কিচ্ছার গল্পগুলো বোঝায়। একদিন বাড়িতে আইসা একটা ডায়েরি নিয়ে যাই। পরে সে কোনো জায়গায় যে কিচ্ছার প্রোগ্রাম করে, ওই প্রোগ্রামটা আমি আমার ডায়েরিতে তুলে রাখি। পরে আমি তিন মাসের মধ্যে ওস্তাদের সবগুলো কাহিনী ডায়েরিতে লিখে ফেলি। এই করে করে নয় মাস হয়ে গেছে আমার। চৈত্র মাসের দিন আসে। ওস্তাদ কয়_ ‘অনুষ্ঠান নাই। ল একটা কাজ করি।’
‘কী কাজ?’
‘ব্যবসা করি।’
‘ওস্তাদ আমি ব্যবসা করতাম না। আমি আমার কাজ করবাম চাই।’
‘কী কাজ?’
‘আপনার যে বাদ্যযন্ত্রগুলো আছে ওগুলো আমারে দিয়ে দেন। আমি ভাটি এলাকায় পালাগান করতে যাইতে চাই।’
আমার কথা শুনে ওস্তাদ বলতেছে, ‘তুমি কী পারবা এই কিচ্ছাগান করতে?’
আমি কই_’চেষ্টা করে দেখি।’
‘তুমি কোন পর্যন্ত গেছো তা আমি জানি না… তুমারে আমি শিখাইছি না।’
‘আমি যেটুকু জানি, সেটুকু নিয়েই চেষ্টা করে দেখি, কিছু করতে পারি কিনা।’
উনার দলের হারমোনিয়াম মাস্টার নিজাম উদ্দিন, তবলচি মাস্টার নিমাই এবং বিষ্ণুপদ_এই তিনজন লোক নিয়া প্রথম গেলাম কদমশ্রী গ্রামে। ওটা নিজামের ভগি্নপতি বাড়ি।
লোকজন এসে বলে_’নিজাম, তুমি কারে নিয়া আইছো?’
‘কুদ্দুস বয়াতীর ছাত্র।’
‘কুদ্দুস বয়াতীর কিচ্ছাই ভালো লাগে না, তুমি কুদ্দুস বয়াতীর ছাত্র নিয়া আইলা।’
কেউ আগ্রহ দেখাল না কিচ্ছাগান শোনার জন্য। আমার মন খারাপ হয়ে গেল। রাত্রিবেলা নিজাম রে বললাম_ ‘চানি্ন রাত, কেউ যখন কিচ্ছাগান শুনতে চাইছে না তখন নিজেরা মিলে কয়েকটা গান গেয়ে রাতটা পার করি।’ তখন কুপি বাত্তি ধরাইছে। নিমাজ উদ্দিন গান শুরু করছে। কয়েকজন মানুষ আসছে। পরে আসা একজন মুরবি্ব কইলেন_ ‘নিজাম উদ্দিন, গান তো শুনছি, তুমরা যখন কিচ্ছা নিয়া আইছো, তুমাদের কিচ্ছা একটু শুনি। আমি যখন প্রথম কিচ্ছার বন্দনায় টান দিয়ে একটা জাম্প করলাম, তখন ওই লোকটা কয়_’দাঁড়াও। তারপর বলল_’এই তুমি বসো।’ বসলাম। কয়েকজনরে বলল_ ‘এই তোরা কি কিচ্ছা শুনবি?’
‘হ হ শুনবো।’
‘তাহলে আমার বাড়িতে যাইয়া হ্যাজাক নিয়া দোকান থেকে ত্যাল ভরে নিয়ে আয়। কিচ্ছার ভাব ভালো আছে। কিচ্ছা হবে।’ লোক পাঠায়ে দিয়ে ত্যাল-ট্যাল ভরে আইনা হ্যাজাক বাতির আলোয় আসর শুরু হয়া গেল। আমার প্রথম কিচ্ছাগানের পালা ছিল ‘গুলে হরমুজ’।
কেন্দুয়া থানার কদমশ্রী গ্রামে প্রথম কিচ্ছাগান পরিবেশন করার পর ইসলাম উদ্দিন যান কালিয়াঝুরি থানায়। এই থানার বিভিন্ন গ্রামে টানা ২৪ দিন কিচ্ছাগান পরিবেশন করলেন। খরচ বাদে সম্মানী পেলেন ২ হাজার ৮৩০ টাকা। “ওস্তাদের বাড়িতে আইসা আমার পুরা টাকাটা ওস্তাদের হাতে দিয়ে বললাম_এই যে ওস্তাদ এটা আমার জীবনের প্রথম উপার্জন। ওস্তাদের হাতে ১৪০০ টাকা দেওয়ার পরে অন্তত সে ১০ টাকা দিয়াও বলল না যে ‘ইসলাম এই নাও অনেক পরিশ্রম করছো এই ১০ টাকা রাখো।’ মনে খুব আঘাত লাগল। ওস্তাদের দল ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। দল করলাম নিজের গ্রামে এসে।
এখানে তাঁর প্রথম কিচ্ছাগান ‘উতলা সুন্দরী ও কাকাধরের খেলা।’ এরপর নিয়মিতভাবে দল নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে পরিবেশন করতে লাগলেন ‘আমির সাধু’, ‘সুন্দরমতি’, ‘রাম-বিরাম’, ‘ গেন্দেকুল’, ‘জাহাঙ্গীরবাদশা’, ‘মতিলাল’, ‘ফিরোজ খাঁ’, ‘রূপকুমার’ ইত্যাদি কিচ্ছাগান।
ইসলাম উদ্দিনকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘কোথায় পালাগান করতে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে?’
তিনি জানান, ‘পালাগান করতে তো একটা ভাব লাগে। গ্রামে সেই ভাবটা পাওয়া যায়। গ্রামের জনগণ সব ভাষা বুঝতে পারে। শহরে গেলে, শহরের ভাষা বলতে আমাদের খুব ভেজাল হয়।’
‘যদি অভিনয়ের জন্য ঢাকায় কেউ স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করেন থাকবেন?’ ভীষণ আত্দপ্রত্যয়ী ইসলাম উদ্দিন জানান, ‘না আমি ঢাকায় পালাগান করার জন্য স্থায়ীভাবে থাকতে চাই না। কেননা যেই আমি গ্রামে পালাগান করে ঢাকার মানুষের কাছে মর্যাদা পেয়েছি, সেই আমি ঢাকায় স্থায়ীভাবে চলে গেলে মর্যাদাহীন হয়ে যাব। গ্রামে থেকেই পালাগান করতে চাই আমি।’
নাট্যকার সাইমন জাকারিয়ার প্রেরণায় ২০০৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার নারীগ্রন্থ প্রবর্তনায় ‘কিচ্ছাদার’ নামে যে পালাটি পরিবেশন করেন, তাতে উঠে এসেছে তাঁর নিজের বৈচিত্র্যময় জীবন। এই পরিবেশনাটি নিশ্চিতভাবে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের ঐতিহ্য নাট্যধারায় একটি নতুন দৃষ্টান্ত। কেননা ইসলাম ছাড়া অন্য কেউ নিজের আত্দজীবনীর মঞ্চায়ন করেছেন কি না আমাদের জানা নেই।