দীর্ঘ সাড়ে তিন বছরের অধিক সময় পর আজ সারাদেশে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এই হরতাল ডাকা হয়।প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ডাকা আজকের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ও ভাংচুরের মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে। তবে দেশের কোথাও বড় ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
হরতাল চলাকালে রাজধানীতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা অধ্যাপক আব্দুল মান্নান ও আজম খানসহ ১৬৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, সহসভাপতি শমসের মবিন চৌধুরী এবং সাংসদ শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানিও রয়েছেন।
এছাড়া ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মহিলা কাউন্সিলর সুরাইয়া বেগম, মমতাজ চৌধুরি টুটু, রাজিয়া আলম এবং পেয়ারা মওলা গ্রেপ্তারের তালিকায় রয়েছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে প্রধান প্রধান সড়কে মিছিল, পিকেটিং, অগ্নিসংযোগ ও গাড়ি ভাংচুর করার অভিযোগে ১৬৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সকাল পৌনে ৮টার দিকে রাজধানীর শাহবাগের কাছে এক সংঘর্ষে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ও ইডেন কলেজ ছাত্রদল নেত্রী পপিসহ কমপক্ষে সাতজন আহত হয়।
খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা অধ্যাপক আব্দুল মান্নানের ধানমন্ডি বাসার কাছে বেলা ১২টার দিকে বিএনপি কেন্দ্র্রীয় নেতা আবুল খায়ের ভুইয়া, এমরান সালেহ প্রিন্স’এর নেতৃত্বে হরতালের সমর্থকরা মিছিল বের করার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। এক পর্যায়ে পুলিশ তাদের অবরুদ্ধ করে রাখে। দুপুর ৩টা পর্যন্ত তারা অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকে।
হরতালে রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম বাস চলাচল করেছে। বাস স্বল্পতায় অফিসমুখী অনেককে অতিরিক্ত ভাড়ায় ঠেলাগাড়িতেও চড়তে দেখা গেছে। প্রধান প্রধান সড়কের পাশের বেশিরভাগ দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।
গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। লঞ্চ, বিমান ও ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক ছিলো বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সমস্যার সমাধান, টেন্ডারবাজি-দখলবাজি, সরকারবিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন-হয়রানি বন্ধ, বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ বন্ধ, প্রশাসন দলীয়করণ ও চাকুরিচ্যুতি, পক্ষপাতমূলক নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ, ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী লাঞ্ছনার বিচারসহ ১১ দফা দাবিতে সরকারকে সতর্ক করতে এ হরতালের ডাক দেয় বিএনপি।
গত ১৯ মে পল্টন ময়দানে বিএনপির মহসমাবেশে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের শরিকরা এতে সমর্থন দেয়।
হরতাল উপলক্ষে রাজধানীতে বিডিআর, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এবং র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্তত ১০ হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়।
সকাল সাড়ে ৭টায় বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমান উল্লাহ আমান, দপ্তর সম্পাদক রিজভী আহমেদের নেতৃত্বে একটি মিছিল নয়া পল্টনে দলের কার্যালয়ের দিকে যেতে চাইলে কাকরাইলে হোটেল নাইটিঙ্গেলের কাছে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে তাদের থামিয়ে দেয়।
এরপর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মইন খানের নেতৃত্বে শান্তিনগর থেকে একটি মিছিল নয়া পল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাওয়ার পথে নাইটিঙ্গেলের কাছে পুলিশ মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
সকাল ৮টার দিকে কারওয়ান বাজারের সামনের রাস্তায় খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা অধ্যাপক আবদুল মান্নান, শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা আব্দুল আওয়াল মিন্টু ও আহমেদ আজম খান এবং সাবেক সাংসদ সেলিম রেজা হাবিব ও যুবদলের সাধারণ সম্পদক সাইফুল আলম নীরবের নেতৃত্বে মিছিল বের করা হয়।
পুলিশ তাদের মিছিল আটকে দেয় এবং নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাজধানীর প্রধান সড়কে মিছিল বের করায় আব্দুল মান্নান ও আজম খানসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে।
এ বিষয়ে তেজগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) তপন কুমার ঘোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাস্তায় যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করায় তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দক্ষিণ শাজাহানপুর জামে মসজিদের সামনে বিএনপি নেতকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ঘটে। এ সময় পুলিশকে ইটপাটকেল মারার ঘটনায় বিএনপির দুই কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। বেলা ১১টার দিকে নিজ বাসার কাছ থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মির্জা আব্বাসকে।
পুলিশ কাকরাইলে নাইটিঙ্গেলের কাছে এবং ফকিরাপুল মোড় থেকে একটু সামনে জোনাকি সিনেমা হলের সামনে কাঁটাতারের বেষ্টনী দিয়ে নয়া পল্টনের পুরো সড়ক অবরোধ করে রাখে। এছাড়া বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন রাখা হয় নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ও আশপাশের অলিগলির মুখে।
কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে হরতালের সমর্থনে মিছিল করে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা।
এ সময় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তৃতীয় তলায় ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সহসভাপতি আব্দুল্লাহ আল নোমান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদীন ফারুকসহ কেন্দ্রীয় নেতারা।
রিজভী আহমেদ জানান, হরতালের খবর পর্যবেক্ষণে নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, সকাল সাড়ে ৭টার দিকে শাহবাগ মোড়ে প্রথম দফা ছাত্রদলের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংর্ঘষ শুরু হয়। ছাত্রদল কর্মীরা শাহবাগ মোড়ে হরতালের সমর্থনে মিছিল করতে গেলে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালায়। এ সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয়। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়।
সংঘর্ষের পর ছাত্রদলের কর্মীরা এ্যানির নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে অবস্থান নেয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরা ছাত্রদল কর্মীদের হাসপাতাল এলাকা ত্যাগ করতে বলে। এতে কর্মচারীদের সঙ্গে ছাত্রদল কর্মীদের বাগবিতণ্ডা শুরু হয়। এক পর্যায়ে ছাত্রদল কর্মীরা হাসপাতালের একটি জানালা ও রাস্তায় গাড়িতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে দুপেক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। এতে এ্যানি ও পপিসহ সাতজন আহত হয়। পরে পুলিশ সেখান থেকে ছাত্রদলের কর্মীদের সরিয়ে দেয়।
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলাম আলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা শান্তিপূর্ণ হরতালের পক্ষে মিছিল করছিলাম। এসময় ছাত্রলীগ ও পুলিশ আমাদের ওপর হামলা চালায়। পুলিশ আমাদের কয়েকজন কর্মীকে আটক করে নিয়ে যায়।”
সকালে হাতিরপুলের কাছ থেকেও পুলিশ কয়েকজনকে আটক করেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ সোহেল রানা টিপু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা হরতালের বিপক্ষে ক্যাম্পাসে মিছিল করেছি। শাহবাগের ঘটনার সঙ্গে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ জড়িত নয়।”
বিএনপির ডাকা এই হরতাল কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে মাঠে নামে চারদলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), ন্যাশনাল পিপলস পার্টিসহ (ন্যাপ) সমমনা সাতটি দলের নেতাকর্মীরা।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির এটি প্রথম হরতাল। এর আগে স্থানীয় দুই নেতার মৃত্যুতে পুরান ঢাকা এবং বগুড়ায় হরতাল পালন করে স্থানীয় বিএনপি।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে সর্বশেষ ২০০৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোট সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে।