সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যাদের অবদান অতুলীনয়, যাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় শিল্প ও সাহিত্য হয়েছে বেগবান প্রাণবন্ত তাঁদের অনেকেই আমাদের মাঝে নেই। লালন শাহ, পাচু শাহ্, হাছন রাজা, কবি জালাল উদ্দিন খাঁ, মমতাজ আলী খান সহ অনেক গুণী মানুষকে। কিন্তু তা্েঁদর সৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে আছে আমাদের সাংস্কৃতিক জীবন আর ইতিহাসের পরতে পরতে। তাদের স্বরণ করে আমরা ধন্য হই। আজকে আমাদের লোক সংগীত, বাউল সংগীত হারিয়ে যাবার পথে রয়েছে। এগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা আমাদের প্রয়োজন। আজকে যাকে নিয়ে লিখতে বসেছি তিনি হলেন কৃষি প্রযুক্তি প্রচারে ও উদ্ভুদ্ধকরণে বিপ্লব ঘটানোর অগ্র সৈনিক, কৃষি গানের যাদুকর সৈয়দ নূরুল আউয়াল তারামিঞা । প্রায় নয়শত বৎসর আগে এই বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে সিলেট এসেছিলেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে সেই অলি আউলিয়াদের কথা আমাদের সবারই জানা। তিনশত ষাট আউলিয়ার সর্দার হযরত শাহ জালাল (রঃ)। তার সাথীদের একজন সৈয়দ তাজউদ্দিন (রঃ)। যার মাজার শরীফ সিলেট জেলায়। তারই উত্তরসুরী খ্যাতনামা কবি, বেতার ও টেলিভিশনের গীতিকার, সুরকার ও নিয়মিত শিল্পী সৈয়দ নূরুল আউয়াল তারামিঞা। যেখানে কৃষি অনুষ্ঠান, সেখানেই তারামিঞা। মনে প্রাণে, চিন্তা চেতনায় তিনি একজন স্বভাব কবি।
সারা বাংলাদেশেই তার পরিচিতি। বেশী পরিচিতি লাভ করেছেন কৃষি, পরিবেশ, মৎস্য, পশু পালন, জনস্বাস্থ্য, বার্ড ফ্লু, এইডস, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, আর্সেনিক, স্যানিটেশন, মাদকবিরোধী, গণশিক্ষা ইত্যাদি বিষয় ভিত্তিক গান গাওয়ায়। এক কথায় বলা যায় তারা মিঞা কৃষি গানের সম্রাট কৃষি গানের যাদুকর। যিনি কৃষি ভিত্তিক গান গেয়ে গণ মানুষকে জাগিয়ে তুলছেন দীর্ঘ ৩২ বছর পূর্ব থেকে। গণমানুষকে কৃষি ক্ষেত্রে উদ্ধুুদ্ধ করার অসামান্য অবদান রাখার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তারামিঞাকে দুইবার কৃষি উন্নয়নে “রাষ্ট্রপতি পদক” ও “বঙ্গবন্ধু পদকে” ভূষিত করেছেন। তাৎক্ষণিক গান রচনা ও সুরারূপ করে নিজেই মঞ্চে উঠে অগনিত মানুষকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম। তার গান মন্ত্র মুগ্ধের মত সবাই শ্রবণ করে সর্বস্তরের কৃষক কিষাণীগণ। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী বহুমাত্রিক লেখক কবি তারামিঞা রচনা করেছেন অসংখ্য গান। তিনি ৩টি গানের বই, ২টি কবিতার বই এবং যৌথ ভাবে ৩টি গানের বই প্রকাশ করেছেন। তন্মধ্যে যৌথভাবে প্রকাশিত “নবী (সাঃ) প্রেম” বই খানা একনজর পড়লেই বুঝা যায় তার মাঝে আধ্যাত্মিক চেতনা কতটুকু। সুফিবাদে বিশ্বাসী শক্তিশালী লেখক তারামিঞার বহু গান দেশের বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে গীত হতে শুনা যায়।
১৯৭৯ইং সনে সরকারী চাকুরীতে যোগদান করে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করে অবসর সময়ে রাত জেগে রচনা করেন প্রতি নিয়োমিত মুর্শীদি, মারফতি, পল্লীগীতি, বিষয় ভিত্তিক, দেশাত্ববোধক, হামদ-নাত ইত্যাদি তাছাড়া কবিতা, ছড়া, জারী গান, নাটক, বিভিন্ন বিষয়ের উপর ফিচার। ক্ষণস্থায়ী এ জগৎকে তিনি অন্তর থেকে অনেক দূরে রেখে পরজগতের প্রতি তার নজর বেশী। এ দুনিয়ার মূল্য শুধু ভোগ বিলাস আর বিশ্রাম খানা । তাই তিনি লিখেছেন এর পরকালের কর্মের প্রতি সকল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গেয়েছেন “একটি দমের নাই ভরসা কিসের বাহাদুরী, তোমার মনে কেন জাগে না ছাড়তে হবে এ ঘর বাড়ি”। মানব দেহের পঞ্চ ইন্দ্রকে নিয়ে গভীর চিন্তা করে মানুষ মানুষের সন্ধান করে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের মরহুম বাউল সম্রাট জালাল উদ্দিন খাঁ যেমনি ভাবে সৃষ্টি তত্ত্ব, নিগুর তত্ত্ব, আত্ব তত্ত্ব, পরাঘাটা, পঞ্চতত্ব, বিরহ তত্ব, সাধন তত্ব, বন্ধুয়া, বিচ্ছেদ, দেশতত্ব, বিচার, ভযন, ইত্যাদি বিষয়ে শত শত গান রচনা করে গেছেন তেমনি কবি তারামিঞাও বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি পড়তে পড়তে স্থান করে নিয়েছেন। তারামিঞার গানের বইগুলি পড়লেই বুঝা যায় বাউল সম্রাট জালাল উদ্দিন খাঁর গানের সংগে তার গানের অর্থ এবং ভাবের দিক দিয়ে কোন অংশে কম নয়। এছাড়া কৃষি বিষয়ক অসংখ্য গান রচনা করেছেন।
যেমন পরিবেশ রক্ষার জন্য গেয়েছেন “দেশের বাতাস উল্টে গেলরে আষাঢ় মাসে খড়া ভাই-সেচের চিন্তা কর আগে আয় আয়রে চাষী ভাই”। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য গেয়ছেন “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই, মানুষের বাঁচার জন্য খাদ্যের যোগান চাই”। রাসায়নিক সার ব্যবহার, বেশি ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়, তাই তিনি গেয়েছেন- “সারের রাজা জৈব সার- গোবর কম্পোষ্ট সবুজ সার, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করে করলে ব্যবহার”, শরীর সুস্থ্য রাখার জন্য পুষ্টি প্রয়োজন তিনি গেয়েছেন- “স্বাস্থ্য পুষ্টি অর্থ চান, ফলের চারা বেশী লাগান- ফলে ফলে ঝগড়া করে মূল্য বেশী কার”, চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের বাঁশী হিসাবে তারামিঞা গায়- “সামনে মোদের আসছে দুর্দিন বাঁচার আশা দায়- ঔষধী গাছ লাগাও আঙ্গীনায়”, বার্ড ফ্লু থেকে বাঁচার জন্য সচেতণতা প্রয়োজন।
তাই তিনি গেয়েছেন- “হাঁস মুরগী কাইট্যা কুইট্যা, হাতে লাগাও সাবান- বার্ড ফ্লু থেকে থাকিও সাবধান”, মৎস্য চাষ বৃদ্ধির জন্য গেয়েছেন- “দেখা দিছে মাছের আকাল-বাজারেতে মিলে না তাড়াতাড়ি ছাড় ভাই রুই কাতলার পোনা” কৃষকের অতি কষ্টের ফসল ইঁদুরে প্রায় ২৫ ভাগ নষ্ট করে। তাই কৃষকদেরকে ইঁদুর মারতে উদ্ভুদ্ধ করনের জন্য তিনি গেয়েছেন- “ছুটলে ধরা দিবেনা ইঁদুর পাইলে ক্ষতি কইর না”। সু ফসল পেতে হলে সু বীজ নিশ্চয়”।
অধিক ফসলের জন্য হাইব্রিড ধানের আবাদ আমাদের জরুরী, তাই তিনি গেয়ে বেড়ান “আদরের বুবুজান, শুন তারামিঞার গান, ধানের মাঝে হাইব্রিডের ফলন খুব ভালা” । তিনি আরও গেয়েছেন- “কৃষি প্রধান বাংলাদেশের কৃষির উন্নতির মূলে, সু-ফসলের আশা বৃথা- সু-বীজ না হলে”, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষ রোপনের বিকল্প নাইÑ “বাঁচার আশা আছে যার, গাছের চারা লাগাও এবার। দুলনা থেকে কবর যেতে গাছের ভাই দরকার” । শাক সব্জী বেশী খাবার জন্য তিনি দেশবাসীকে জানান আঙ্গীনাতে করাগা বাগান, সারা বছর খাও সব্জী নিয়া পুলা পান। এছাড়াও তিনি কৃষি বিষয়ক কয়েকটি নাটক লিখে দেশের বিভিন্ন কৃষক সমাবেশে মঞ্চস্থ করেছেন। তন্মধ্যে “এসো দেশ গড়ি” “ক্ষেতে খামারে” “বাড়াই খালির পাড়ে” এবং গন শিক্ষা মূলক নাটক “আলোর পথে” বিভিন্ন স্থানে মঞ্চস্থ করে বেশ সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেছে। তার কাছে বসলেই বুঝা যায় তার প্রতিভার রূপ। অনর্গল কবিতার ছন্দ মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে। তারামিঞা “রাষ্ট্রপতি পদক” ও “বঙ্গবন্ধু পদক” এছাড়াও সাহিত্য ও সংগীতে অনন্য অবদানের জন্য ১২টি সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেছেন। বহু সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন কর্তৃক সংবর্ধিত হয়েছেন কবি তারামিঞা। স্থানীয় সহযোগী শিল্পীদের নিয়ে ১৯৯০ সনে গড়ে তুলেছেন “উজিয়াল শিল্পী গোষ্ঠী” নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। মানুষের মনোজগতে প্রবেশ করে গণ সচেতনতামূলক যে কার্যক্রম তিনি প্রতিনিয়ত করে চলছেন তা কোন সেমিনার বা সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমেও সম্ভব নয়।
আকাশ সংস্কৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে শিল্পী তারামিঞা চালিয়ে যাচ্ছে তার ক্ষিপ্ত ঘোড়া। তার সাথী হল দুতারা, ঢোল, বাঁশি, মন্দিরা, হারমুনিয়াম ইত্যাদি দেশীয় বাদ্যযন্ত্র। তারামিঞা গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের মাঝে মিশে থাকতে ভালবাসে এবং ভালবাসে কৃষকের মুখের হাসি। সর্বদা হাসি খুশী, সরল ও প্রাণবন্ত আমাদের তারা ভাই। কৃষি নির্ভর এদেশের উন্নয়নের মূলে হল কৃষি। কৃষি প্রযুক্তি কৃষক ভাইদের মাঝে তড়িৎ গতিতে পৌছে দিতে কবি ও শিল্পী তারামিঞা নিবেদিত প্রাণ পুরুষ। গণ মানুষের শিল্পী, মাটি ও মানুষের বাউল, গণ জাগরণের চারণ কবি, নন্দিত গীতিকার, স্বভাব কবি, বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিয়মিত শিল্পী তারামিঞাকে যদি সরকারী ভাবে সাহায্য সহযোগীতা করা হয় তবে দেশ তথা জাতীর আর্ত সামাজিক উন্নয়নে আরও ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে ধরে রাখতে হলে কবি তারামিঞার অপ্রকাশিত কাব্যগুলো প্রকাশের প্রয়োজন আগামী প্রজন্মের জন্য। তার অসংখ্য গান, কবিতা, ছড়া আমাদের বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
দেশের বিত্তবান ভাই বোনদের কাছে অনুরোধ অসাধারণ প্রতিভাধর এই কবি ও শিল্পী তারামিঞাকে হারালে আমাদের চলবে না। তাকে আমাদের ধরে রাখতে হবে আমাদের কর্মের মাধ্যমে। কবি তারামিঞা ১৯৫৯ইং সনের ২রা মার্চ কিশোরগঞ্জ জেলাধীন করিমগঞ্জ উপজেলার চাঁনপুর গ্রামে (মাতুলালয়ে) জন্মগ্রহণ করেন। নিজ বাড়ী সদর উপজেলা বৌলাই তেরহাসিয়া (পরী সাহেব বাড়ী)। তার পিতা মরহুম সৈয়দ আকবর আলী (রঃ) মাতা মরহুমা সৈয়দা মালেকা খাতুন, মরহুমা সৈয়দা হাফিজা খাতুন। পিতার তিন পুত্র ও এক কন্যার মাঝে সর্ব কনিষ্ঠ কবি তারামিঞা। বৌলাই পরী সাহেব বাড়ির কৃতি সন্তান বর্তমানে কিশোরগঞ্জ শহরের গাইটাল এলাকায় জনতা স্কুল সংলগ্ন ১০২৩ নং বাড়িতে স্ত্রী এক পুত্র ও দুই কন্যাকে নিয়ে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন। একমাত্র বোন বহু পূর্বে এবং বড় ভাই দুবছর আগে চিরবিদায় নিয়েছেন। তার এক ভাই গদিনশীন হিসাবে পূর্ব পুরুষদের হাল ধরে আছেন। কবি তারামিঞা তার পিতা, মাতা ও বড় ভাইয়ের মাজারে খেদমতের দায়িত্বেও আছেন। প্রতি শুক্রবার বাড়ীতে মা, বাবা ও ভাইয়ের মাজারে ভক্তবৃন্দদের নিয়ে মিলাদ মাহফিল ও জিকির আজকার করে থাকেন। তারামিঞার অপ্রকাশিত কাব্য ১৮টি। আমরা শিল্পী তারামিঞার সুস্থ, সুন্দর ও দীর্ঘ জীবন কামনা করি।