সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশব্যাপী জ্বরের প্রাদুর্ভাব মানুষের মনে নতুনভাবে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অজানা এক উৎকন্ঠায় দিন পার করছে সাধারণ মানুষ। ঢাকা শহরব্যাপীই এর মূল প্রাদুর্ভাব ঘটলেও সারা দেশব্যাপীই এর আতঙ্ক বিরাজ করছে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জ্বরে ভোগা রোগীদের মধ্যেও এর আতঙ্ক বিরাজ করছে। হঠাৎ এই রোগের আক্রমনে কিছুটা নাকাল দেশবাসী, বিশেষ করে রাজধানীবাসীর যেন নাভিশ্বাস উঠছে। জ্বর, ব্যাথার যন্ত্রণার ছটফটানি আর অস্বস্তিতে প্রাণ যেন অচলাবস্থা। এ সমস্যাটি নিয়ে গণমাধ্যম, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বেশ তৎপর। কিন্তু তারপরও যেন আতংঙ্কের রেশ কাটছে না। সরকারিভাবে এপ্রিল থেকে জুন ২০১৭ পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ৫১৬ জন। চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে সম্প্রতি সামাজিক সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনও শুরু করেছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মীরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদ্যোগে পরিচালিত এ ক্যাম্পেইনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘বাড়ী ও বাড়ীর চারপাশ মশামুক্ত রাখুন চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধ করুন।’ এ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে ৯২টি পয়েন্টে চিকিৎসক, নার্স, সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের বিশেষ মেডিক্যাল ইউনিট চিকুনগুনিয়া সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করেছেন।
১৯৫২-৫৩ সালে আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ায় প্রথম চিকুনগুনিয়া শনাক্ত করা হয়।২০০৫ থেকে ২০০৬ সালে ভারতে ভাইরাস বাহিত এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।বাংলাদেশে প্রথম চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায় ২০০৮ সালে, রাজশাহীতে।এরপর ২০০৯ থেকে ১২ সাল পর্যন্ত ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি এলাকায় পর্যায়ক্রমে চিকুনগুনিয়ার রোগী পাওয়া যায়। ঢাকার কলাবাগান এলাকায় গত বছরের আগস্ট মাসে চিকুনগুনিয়ার রোগী পাওয়া যায়।গত ডিসেম্বর থেকে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।
রোগতত্ত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, আইইডিসিআর এই রোগের ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে একটি ন্যাশনাল গাইডলাইনও তৈরি করেছে। পাশাপাশি সারা দেশে চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য পাবলিক হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার (চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণ কক্ষ) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘণ্টা কাজ করার জন্য একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়েছে এবং জনসাধারণের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে সার্বক্ষণিক হটলাইন চালু করা হয়েছে। এ সম্পর্কিত তথ্য জানতে ও জানাতে ০১৯৩৭১১০০১১ এবং ০১৯৩৭০০০০১১ নম্বরে যোগাযোগ করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে অনুরোধও করা হয়েছে। পাশাপাশি জাতীয় স্বাস্থ্য বাতায়নের টেলি সেন্টারে ১৬২৬৩ নাম্বারে কল করেও স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া যাবে বলে প্রচার করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চিকুনগুনিয়ার উপসর্গের মধ্যে রয়েছে প্রচণ্ড জ্বর, কখনও কখনও সেটা ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রি কিংবা তারও বেশি হতে পারে। পাশাপাশি সর্দি, হাত ও পায়ের গিঁটে ব্যথা বা ফোসকা পড়ার মতো লক্ষণগুলোও দেখা যায়। এছাড়া মাথাব্যথা, গায়ের কোনো কোনো অংশে র্যাশ ওঠাও চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে,চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা না করে জ্বর হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধই যথেষ্ট। এর সঙ্গে সঙ্গে পানি দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিতে হবে। তীব্র ব্যথার জন্য অন্য ভালো ওষুধ প্রয়োজন হতে পারে, তবে এসপিরিন ব্যবহার না করাই ভালো। রোগীকে আবার যেন মশা না কামড়ায়, এজন্য তাকে মশারির ভেতরে রাখাই ভালো। কারণ, আক্রান্ত রোগীকে মশায় কামড় দিয়ে অন্য কোনো সুস্থ লোককে ওই মশা কামড়ালে ওই ব্যক্তিও এ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। এছাড়া চিকুনগুনিয়া জ্বরের কোনো প্রতিষেধক নেই, কোনো ভ্যাকসিন বা টিকাও নেই। তাই রোগ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো এডিস মশা প্রতিরোধ। চিকুনগুনিয়া ভালো হয়ে গেলেও রোগী প্রায় দুই-এক মাসের মতো ক্লান্তি, অবসাদ, দুর্বলতা ও গিঁটে ব্যথার উপসর্গে ভোগেন। চিকনগুনিয়া প্রতিরোধে প্রথমেই মশার জন্মস্থান ধ্বংস করতে হবে। আবাসস্থল ও এর আশপাশে মশার প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট করতে হবে। বাসার আশপাশে ফেলে রাখা মাটির পাত্র, কলসী, বালতি, ড্রাম, ডাবের খোসাসহ যেসব জায়গায় পানি জমতে পারে, সেখানে এডিস মশা প্রজনন করতে পারে। এসব স্থানে যেন পানি জমতে না পারে সে ব্যাপারে লক্ষ রাখতে হবে এবং নিয়মিত বাড়ির আশ-পাশে পরিষ্কার রাখতেই হবে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, ঢাকা শহরের অধিকাংশ জায়গায় হলো চিকনগুনিয়ার বাহক এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য উত্তম ক্ষেত্র। ময়লা,আবর্জনার সাথে যুক্ত বর্ষার জলাবদ্ধতায় যেন নাকাল নগরবাসী। কিন্তু নাগরিক অসচেতনতা আর সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে চিকনগুনিয়ার আক্রমণে ভুগছে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে ঢাকা শহরের বাইরেও বিভিন্ন এলাকায় চিকনগুনিয়া আতংঙ্কের খবর পাওয়া যাচ্ছে। তাই ম্যালেরিয়া,কালাজ্বর রোগের মতো এ রোগ প্রতিরোধ ও নির্মূলের জন্য প্রয়োজন বাহক দমনের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ। আর এ বিশাল কর্মযজ্ঞ কে সফল করতে শুধু স্বাস্থ্য বিভাগ বা সিটি কর্পোরেশন কে দায়ী করলেই হবে না। ইতোমধ্যে অনেকেই এ নিয়ে বক্তব্য দিয়ে সমালোচিত হয়েছেন বা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শিকার হয়েছেন। কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। একটি সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ও বসবাসের স্থান ধ্বংস করতে অব্যাহত প্রচারাভিযান এবং পাশাপাশি এ রোগের সঠিক চিকিৎসা সম্পর্কে ব্যাপক সামাজিক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমেই সম্ভব জনমনে বিদ্যমান আতংঙ্ক দূর করা।
বর্তমানে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সহায়তায় ও সরকারী উদ্যোগে যেভাবে বাংলাদেশে চিহ্নিত ২৬টি জেলার ১০০টি কালাজ্বর প্রবণ এলাকায় জাতীয় কালাজ্বর নির্মূল কর্মসূচীর অধীনে একটি সার্ভেইলেন্স সিস্টেমের মাধ্যমে কার্যকর পদ্ধতিতে কালাজ্বর নির্মূলের লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হচ্ছে, ঠিক তেমনি চিকুনগুনিয়া নির্মূলের লক্ষ্যেও চিহ্নিত এলাকায়ও এধরণের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হওয়া প্রযোজন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’(WHO)র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক অফিস চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে ‘গাইড লাইনস্ ফর প্রিভেনশন এন্ড কন্ট্রোল অব চিকুনগুনিয়া ফিভার’ প্রকাশ করেছে। এতে আউটব্রেক ম্যানেজমেন্ট বা প্রাদুর্ভাব ব্যবস্থাপনা করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা রয়েছে, শুধু তাই নয় এতে বিভিন্ন স্তরের পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারেও নির্দেশনা রয়েছে, যেমন স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব-করণীয়, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর করণীয়, পারিবারিক স্তরে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। পাশাপাশি এতে প্রাদুর্ভাবকালীন সময়ে কার্যকর যোগাযোগ, বাহকের উপর কার্যকর নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণের উপরও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা রয়েছে। এখানে সমন্বিত উপায়ে বাহক ব্যবস্থাপনার যে কয়েকটি উপাদানের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে- ১. এডভোকেসি, সমাজ উদ্বুদ্ধকরণ,আইন প্রণয়ন ২. স্বাস্থ্য খাত ও অন্যান্য খাতের সাথে সংযোগ তৈরি করা ৩. সমন্বিত পদ্ধতির প্রয়োগ ৪.প্রমাণ-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ৫. দক্ষতা উন্নয়ন।
সর্বশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশ অতীতে এর চেয়েও বড় জনস্বাস্থ্য সংঙ্কটে বিশ্বে উত্তরণের পথ দেখিয়ে মডেল তৈরি করেছে,আধুনিক বিজ্ঞানের উৎকর্ষতাকে কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবন করেছে টেকসই সমাধানের পথ। আর উদ্ভাবিত এই সমাধানের পথ শুধুমাত্র বাংলাদেশের আপামর সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান করেনি বরং বাংলাদেশের গন্ডি ছাড়িয়েও বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাই, স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষক ও সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ সকলের সমন্বয়ে গৃহিত একটি জাতীয় বৃহৎ উদ্যোগই পারে, এ সংঙ্কটের আশু অবসান ঘটাতে। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কার্যকর পর্যবেক্ষণ। সর্বোপরি তবেই সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাধান হবে চিকুনগুনিয়ার আতংঙ্ক।
সুমিত বণিক, জনস্বাস্থ্যকর্মী ঢাকা।