রাজার বাড়ির সিংহ-দরজার পাশে, লোহার খাঁচার একটা মস্ত বাঘ ছিল। রাজার বাড়ির সামনে দিয়ে যত লোক যাওয়া-আসা করত, বাঘ হাত জোড় করে তাদের সকলকেই বলত, ‘একটিবার খাঁচার দরজাটা খুলে দাও না দাদা!’ শুনে তারা বলত, ‘তা বইকি! দরজাটা খুলে দি, আর তুমি আমাদের ঘাড় ভাঙো।’
এর মধ্যে রাজার বাড়িতে খুব নিমন্ত্রণের ধুম লেগেছে। বড়-বড় পণ্ডিত মশাইয়ের দলে-দলে নিমন্ত্রণ খেতে আসছেন। তাঁদের মধ্যে একজন ঠাকুর দেখতে ভারি ভালোমানুষের মতো ছিলেন।
বাঘ এই ঠাকুরমশাইকে বারবার প্রণাম করতে লাগল।
তা দেখে ঠাকুরমশাই বললেন, ‘আহা, বাঘটি তো বড় লক্ষ্মী! তুমি কি চাও বাপু।’
বাঘ হাত জোড় করে বললে, ‘আজ্ঞে, একটি বার যদি এই খাঁচার দরজাটা খুলে দেন! আপনার দুটি পায়ে পড়ি।’
ঠাকুরমশাই কিনা বড্ড ভালোমানুষ ছিলেন, তাই তিনি বাঘের কথায় তাড়াতাড়ি খাঁচার দরজা খুলে দিলেন।
তখন হতভাগা বাঘ হাসতে-হাসতে বাইরে এসেই বললে, ‘ঠাকুর, তোমাকে তো খাব!’
আর কেউ হলে হয়তো ছুটে পালাত। কিন্তু এই ঠাকুরটি ছুটতে জানতেন না। তিনি ভারি ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘এমন কথা তো কখনো শুনিনি! আমি তোমার এত উপকার করলাম আর তুমি বলছ কিনা আমাকে খাবে! এমন কাজ কি কেউ কখনো করে?’
বাঘ বললে, ‘করে বইকি ঠাকুর, সকলেই তো করে থাকে।’
ঠাকুরমশাই বললেন, ‘তা কখনোই নয়! চল দেখি তিনজন সাক্ষীকে জিগগেস করি, তারা কি বলে।’
বাঘ বললে, ‘আচ্ছা চলুন। আপনি যা বলছেন, সাক্ষীরা যদি তাই বলে, আমি আপনাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাব। আর যদি তারা আমার কথা ঠিক, তবে আপনাকে ধরে খাব।’ সাক্ষী খুঁজতে দুজনে মাঠে গেলেন। দুই ক্ষেতের মাঝখানে খানিকটা মাটি উঁচু রেখে, চাষীরা একটি ছোট পথের মতন করে দেয়, তাকে বলে আল। ঠাকুরমশাই সেই আল দেখিয়ে বললেন, ‘এই আমার একজন সাক্ষী।’
বাঘ বললে, ‘আচ্ছা, ওকে জিগগেস করুন, ও কি বলে।’
ঠাকুরমশাই তখন জিগগেস করলেন, ‘ওহে বাপু আল, তুমি বল দেখি, আমি যদি কারো ভালো করি, সে কি উল্টে আমার মন্দ করে?’
আল বললে, ‘করে বইকি ঠাকুর। এই আমাকে দিয়ে দেখুন না। দুই চাষার ক্ষেতের মাঝখানে আমি থাকি, তাতে তাদের কত উপকার হয়। একজনের জমি আর একজন নিয়ে যেতে পারে না, একজনের ক্ষেতের জল আর একজনের ক্ষেতে চলে যায় না। আমি তাদের এত উপকার করি, তবু হতভাগারা লাঙ্গল দিয়ে আমাকেই কেটে তাদের ক্ষেত বাড়িয়ে নেয়!’
বাঘ বললে, ‘শুনলেন, তো ঠাকুরমশাই, ভালো করলে তার মন্দ কেউ করে কি না!’
ঠাকুরমশাই বললেন, ‘রোসো, আমার তো আরো দুজন সাক্ষী আছে।’
বাঘ বললে, ‘আচ্ছা চলুন।’
মাঠের মাঝখানে একটা বটগাছ ছিল। ঠাকুরমশাই তাকে দেখিয়ে বললেন, ‘ঐ আমার আর একজন সাক্ষী।’
বাঘ বললে, ‘আচ্ছা, ওকে জিগগেস করুন। দেখি, ও কি বলে।’
ঠাকুরমশাই বললেন, ‘বাপু বটগাছ, তোমার তো অনেক বয়েস হয়েছে, অনেক দেখেছ শুনেছ। বল দেখি, উপকার যে করে, তার অপকার কি কেউ করে?’
বটগাছ বললে, ‘তাই তো লোক আগে করে। ঐ লোকগুলো আমার ছায়ায় বসে ঠাণ্ডা হয়েছে, আর আমাকেই খুঁচিয়ে আমার আঠা বের করেছে। আবার সেই আঠা রাখবার জন্যে আমারই পাতা ছিঁড়ছে। তারপর ঐ দেখুন, আমার ডালটা ভেঙে নিয়ে চলেছে।’
বাঘ বললে, ‘কি ঠাকুরমশাই, ও কি বলছে!’
তখন ঠাকুরমশাই তো মুশকিলে পড়লেন। আর কি বলবেন, ভেবে ঠিক করতে পারলেন না। এমন সময় সেখান দিয়ে একটা শিয়াল যাচ্ছিল। ঠাকুরমশাই সেই শিয়ালকে দেখিয়ে বললেন, ‘ঐ আমার আর একজন সাক্ষী। দেখি, ও কি বলে।’
তারপর তিনি শিয়ালকে ডেকে বললে, ‘শিয়ালপণ্ডিত, একটু দাঁড়াও। তুমি আমার সাক্ষী।’
শিয়াল দাঁড়াল, কিন্তু কাছে আসতে রাজী হল না। সে দূর থেকেই জিগগেস করল, ‘সে কি কথা! আমি কি করে আপনার সাক্ষী হলুম?’
ঠাকুরমশাই বললেন, ‘বল দেখি বাপু, যে ভালো করে, তার মন্দ কি কেউ করে?’
শিয়াল বললে, ‘কার কি ভালো কে করেছিল, আর কার কি মন্দ কে করেছে, শুনলে তবে বলতে পারি।’
ঠাকুরমশাই বললেন, ‘বাঘ খাঁচার ভিতরে ছিল, আর আমি ব্রাহ্মণ পথ দিয়ে যাচ্ছিলুম-’
এই কথা শুনেই শিয়াল বললে, ‘এটা বড় শক্ত কথা হল। সেই খাঁচা আর সেইপথ না দেখলে, আমি কিছুই বলতে পারব না।’
কাজেই সকলকে আবার সেই খাঁচার কাছে আসতে হল। শিয়াল অনেকক্ষণ সেই খাঁচার চারধারে পায়চারি করে বললে, ‘আচ্ছা, খাঁচা আর পথ বুঝতে পেরেছি। এখন কি হয়েছে বলুন।’
ঠাকুরমশাই বললেন, ‘বাঘ খাঁচার ভিতরে ছিল, আর আমি ব্রাহ্মণ পথ দিয়ে যাচ্ছিলুম।’
অমনি শিয়াল তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললে, ‘দাঁড়ান, অত তাড়াতাড়ি করবেন না, আগে ঐটুকু বেশ করে বুঝে নিই। কি বললেন? বাঘ আপনার বামুন ছিল, আর পথটা খাঁচার ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল?’
এই কথা শুনে বাঘ হো-হো করে হেসে বললে, ‘দূর গাধা! বাঘ খাঁচার ভিতর ছিল, আর বামুন পথ দিয়ে যাচ্ছিল!’
শিয়াল বললে, ‘রোসো দেখি-বামুন খাঁচার ভিতরে ছিল, আর বাঘ পথ দিয়ে যাচ্ছিল?’
বাঘ বললে, ‘আরে বোকা, তা নয়। বাঘ খাঁচার ভিতরে ছিল, বামুন পথ দিয়ে যাচ্ছিল?’
শিয়াল বললে, ‘এ তো ভারি গোলমালের কথা হল দেখেছি। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কি বললে? বাঘ বামুনের ভিতরে ছিল, আর খাঁচা পথ দিয়ে যাচ্ছিল?’
বাঘ বললে, ‘এমন বোকা তো আর কোথাও দেখিনি! আরে বাঘ ছিল খাঁচার ভিতরে, আর বামুন যাচ্ছিল পথ দিয়ে।’
তখন শিয়াল মাথা চুলকাতে-চুলকাতে বললে, ‘না! অত শক্ত কথা আমি বুঝতে পারব না!’
ততক্ষণে বাঘ রেগে গিয়েছে।
সে শিয়ালকে এক ধমক দিয়ে বললে, ‘ও কথা বুঝতেই হবে! দেখ্, আমি এই খাঁচার ভিতরে ছিলুম-দেখ-এই এমনি করে-’
বলতে-বলতে বাঘ খাঁচার ভিতরে গিয়ে ঢুকল, আর শিয়ালও অমনি খাঁচার দরজা বন্ধ করে হুড়কো এঁটে দিল। তারপর শিয়াল ঠাকুরমশাইকে বলল, ‘ঠাকুরমশাই, এখন আমি সব বুঝতে পেরেছি। আমার সাক্ষ্য যদি শুনতে চান, তবে তা হচ্ছে যে, দুষ্ট লোকের উপকার করতে নেই। কাজেই বাঘ মামার জিৎ। এখন আপনি শিগগির যান, এখনো ফলার ফুরোয়নি।’ বলে শিয়াল বনে চরতে গেল, আর ঠাকুরমশাই ফলার খেতে গেলেন।
এই গল্পটির লেখক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এর জন্ম ১৮৬৩ সালের ১০ই মে, বাংলা ১২৭০ শে বৈশাখে কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার সমূয়া গ্রামের বনেদি রায় পরিবারে। তার সম্পর্কে জানতে এইখানে ক্লিক করুন।
darun…oshombhob bhalo laghlo ..golpo tee poray..