tiktiki-r-dimএক ইংরেজ সাহেব কোন এক মোটেলে রেজার ব্লেড দিয়ে দাঁড়ি কাটছেন, আয়ানাতে দেখা গেলো দেয়ালে একটি অতি সাধারণ টিকটিকি ঘোরাফিরা করছে, ইংরেজ সাহেবের দৃষ্টি চলে যাচ্ছে বারেবারে টিকটিকির উপর, মনে হচ্ছে সরিসৃপ প্রানীটা চোখে চোখ রাখতে চাইছে ইংরেজ সাহেবের। অসাবধানতার রেজর ব্লেড কেটে দিলো সাহবের গালের খানিকটা, রক্ত গড়াচ্ছে, গালে আঙ্গুল চাপা দিয়ে রক্ত বন্ধ করতে চাইছেন, সাহেব তাকালেন আয়নাতে – মনে হচ্ছে টিকটিকিটা ঘাড় উচিয়ে বন্ধ রুমে সাহেব রক্তের ঘ্রাণ নিচ্ছে, বেশ বিব্রত বোধ করছেন ইংরেজ সাহেব কেনো জানি চোখ সড়ছে না প্রানীটার উপড় থেকে- আস্তে করে রেজার থেকে বেল্ড টা খুলে ছুঁড়ে মারলেন টিক্টিকিটার উপর, ঝনাৎ করে বেল্ডটা পড়লো মেঝতে- টিক্টিকিটা অদৃশ্য হলো এক দৌড়ে। দিন চারেক পরে সাহেব আয়নাতে রাতে- মৃদু আলোতে দেয়ালে টিকটিকিটা দেখা গেলো- বেশ একটূ মোটা তাজা, তাকিয়ে আছে সাহেবের দিকে- সপ্তাহ খানেক আর দেখা পাওয়া গেলো না ওটার। আরেক দিন সাহেব যথারীতি দাঁড়ি কাটছেন- ছোটখাটো গুইসাপের আকারে আয়নাতে দেখা গেলো টিকটিকি টাকে-, ঘাড়ে বেল্ড কাটা ক্ষতটা বেশ দগদগে…

-ফুপু আম্মা, টিকটিকি টা তাহলে দিন দিন বড়ই হতে থাকবে? ওটাকে ব্যাথা দেয়ার জন্যে সাহেব কে কামড়ে দেবে! –আমার উতসুকতা।
এটি ছিলো বজ্রবৃষ্টিতে, বৈশাখে আম কুড়ানো বাড়নে আমাদের কে ঘরে আটকে রাখায় আমার ছোট ফুপুর চমতকার গল্প গুলুর একটি।
তখন বাবা গত হয়েছেন বছর পেরোয়নি। বাবার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গল্প থেকে আমি একটি “কীট” এর প্রতি যখন ভয়াবহ ফোবিয়া তে আক্রান্ত তখন আরেকবার টিকটিকি আমাকে ভয়ের জগতে তাড়িয়ে না বেড়াক সেটাতে সংকল্প বদ্ধ ছিলাম আমি।

পিতামহের আগের বাড়ীতে আমার খুব বেশি একটা যাতায়াত হয়নি। পুর্বপুরুষের ভিটামাটী থেকে “লাওওয়ারিশ” করার ব্যাপারটা যখন চরমে, ফুপুআম্মা নিয়ে গেলেন বিক্রমপুরের আমাদের আদি বাড়ীতে।-আড়িয়াল খাঁ এর পাড়ে প্রপিতা মহ, মহীদের আয়না বাধানো ঢাঊস সাইজের কিছু পুরানো কবর জিয়ারত শেষে ঘরে- অনেকে দেখতে এলো, ওদের সবই ভীন্ন, কথা বার্তা চালচলন, ঘর দুয়ার সবই। বড় বড় ঘর পাটাতনের উপড়, পাটাতনের নিচে আয়েশই মানুষ জন দাঁড়াতে পারে। সেকালের ঘর দূয়ার আর তৈজষ আসবাব দেখে পিতামহ দের রুচী বোধে আজো আমি বিস্মিত হই। মাগরিবের আজান হচ্ছে- সাথে সাথে বিকট, ট-ক-ক, ট-ক-ক আওয়াজ ভেসে আসছে, ঘরের চালের “টুলী” এবং আম গাছ থেকে।  এক দৌড়ে-

-ফুপু আম্মা, কিসে ডাকে?
-টক্ক সাপ।
-কই থাকে!
-ঘরের চালে, গাছে-
সাপ!! আবার কি ভয়ংকর করে ডাকতেও পারে! আমার শৈশব মস্তকে প্রানীটা সমন্ধে কৌতুহলের ঝড় বয়ে যেতে থাকে। সময় অসময়ে নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে উপর দিকে তাকিয় থাকি আর আওয়াজ শুনি যদি দেখা মিলে। একদিন খালের ঐ পাড়ের এক বন্ধু দৌড়ে এসে বলে একটা টক্ক সাপ মরে পড়ে আছে যদি দেখতে চাই- দে, ছূট। যেয়ে দেখি মাটিতে কালো মতো শরীরে গুটী গুটী কাটা ,বিরাট সাইজের বিদঘূটে একটা মৃত টিকটিকি (টক্ক সাপ); ফুপুর গল্পের কল্পনায় সাহবের টিকটিকি’টা বাস্তবে ধরা দেয় প্রথম বারের মতো।

বাড়ি ছেড়ে ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে পড়তে এসেছি। রবীন্দ্র নাথের ফটিক সম অবস্থা। আমার কাঁদার উত্তম স্থান জয়নুল আবেদিন সংগ্রহ শালা সংলগ্ন ব্রক্ষ্মপুত্রের পারের ছোট্ট পার্ক। সামনের ঝোপ ঝাড় গলিয়ে দূরে তাকালেই গারো পাহার। ব্রক্ষ্মপুত্রের জলের পাক। শত ছিদ্রের বেনিয়াম গেঞ্চি পড়া, সেমি টাক পরা এক চোখা, উস্কো খুস্কো দাঁড়িতে, অসম্ভব রকমের বদমেজাজী লোকাটা ভাঙ্গা গলায়- “ঘটি গরম ঘটি গরম” বলে মেয়েদের আসে পাশে ঘুড়ে বেড়ায়। একদিন অনেক সাহস করে চানাচুরের জন্য ডাকি, কাছে এসে বলে-
-তুই তো দেহি পেড়াই খালি কান্দস- চানাচুর আর কি খাইবি, আয় তরে মজার জিনিস দেখাই-
আমাকে নিয়ে যান পার্কের একটূ ঢালু’তে কি দারুন একটা সবুজ টিকটিকি একদম পাতার রঙের সাথে মিশে বসে আছে, চাচা বলে ঊঠেন-
-ওর চোখের দিকে বেশি তাকাইস না
-কেনো
– চোখ দিয়ে তোর রক্ত শুষে নিবে, দেখ ওর চোখ কত লাল!
আসলেই তো চোখ লাল, আবার কি দারুন শরীরের রঙ ও পাল্টাচ্ছে হলুদ, লাল, সবুজ।
জঙ্গলের বহুরুপী টিকটিকি আর ইংরেজ সাহেবের টিকটিকি ছাপ মেরে রয়।

অনেক গুলু বছর পর দেশে, বাড়ীতে পল্লী বিদ্যুৎ নিয়ন লাইট, এনার্জী বাল্ব। অ্যাপেল এর দূর্দিনের প্রযুক্তিতে ফায়ার ওয়ার ড্রাইভ বা IEEE এক্সটার্ণাল ড্রাইভ বলে দারুন একটা ড্রাইভ বেরোয়, অসম্ভব দ্রুত গতির (ডাটা টারন্সফার)এবং সাইজেও ৮০ গিগস (তখন বিরাট ব্যাপার) ভিডিও ফুটেজ সম্পাদনার কাজে দেশে এটা আমার কম্পিঊটার সিস্টেমে আমার সাথী হয়।
বিভিন্ন প্রকার কীট পতঙ্গের বসতি, সাথে ঘর ভর্তী টিকটিকি দেয়ালে দৌড়াদৌড়ি, ডাকাডাকি। টিকটিকি আতঙ্কের নিরসন কল্পে (থেরাপী) মাথায় একদিন ফন্দি চাপে- কোন ভাবে যদি টিকটিকি গুলুকে ট্র্যাকিং করা যেতো- যেমন ওদের কে ধরে শরীরে নাম লিখে দেয়া বা নাম্বার দেয়া। ব্যাপারটা আমার এক ভক্ত( লেলিন) কে বলতেই কথা নেই- অদ্ভুত কায়দায় আমার সামনেই খপাত করে ধরে ফেল্লো একটা । ওর কৌশলে আমি মুগ্ধ হই। মার্কার দিয়ে নাম লিখা হয়- বুশ থেকে শুরু করে সাদ্দাম এমনকি বাঙ্গালদেশের নায়ক নায়িকও বাদ পরে না।
অনেক রাতে মশারীর ভেতর থেকে আমি দেয়ালে বুশ, সাদ্দামের দৌড়াদৌড়ি দেখি আবার নায়ক নায়িকা বংশবৃদ্ধি কর্মে লিপ্ত আছে, দূর থেকে ভিলেন লেজ নাড়িয়ে ওদের কে আক্রমনের জন্য ছোট খাটো হুংকার দিচ্ছে-বিনোদন পাই।আমার আতঙ্ক কমতে থাকে। আবার কখনো সখনো রাত বিরাতে ইংরেজ সাহেবের ব্লেড কাটা টিকটীকি’র অকস্মাত আগমনে শংকিত হই।

কালবৈশাখির রাতে ঝড়ের পূর্বাভাসে কেমন করেই জানি ওদের দৌড়াদৌড়ি বেড়ে যায় দ্বিগুন- এই উভচর সরীসৃপ প্রানীটির পর্বসূরীদের ইতিহাস তো প্রাক প্রাগৈতিহাসিক। প্রাকৃতিক দূর্যোগ আঁচ অনুমান করার আগাম অনুভুতি না থাকলে কি আর জলেস্থলে অতরীক্ষে ছিলো ওদের হাজার হাজার বছরের একচ্ছত্র আধিপত্য!

২০১০ এ দেশে আমার রুমে ফেলে রেখে আসা আমার সেই ড্রাইভ টা এবছর দেশ থেকে আনাই , ছয় সাত বছরে আপেল প্রযুক্তি অনেক বদলেছে, ফায়ার ওয়ার থেকে থান্ডার বোল্ট পোর্ট, যদিো এডপ্টারে ফায়ার ওয়ার ব্যবহার যোগ্য। দীর্ঘদিনের অবহেলায় ড্রাইভটার দুটো পোর্ট (পাওয়ার মডিঊল) নষ্ট হয়ে যায়। পূরোনো ফুটেজ, ছবিগুলুর জন্য কোথায় যেন শুন্যতা অনুভুত হতে থাকে। সহকর্মি বিশেষ এডপটার প্রযুক্তি ব্যবহারে ডাটা পুনঃদ্ধারের উপদেশ দেয়। দুরু দুরুবক্ষে খুলতে শুরু করি ড্রাইভটার বহির্ভাগ- কি দারুন!! একে একে বেরুতে থাকে আমার কালবৈশাখের বিনিদ্র রজনীর বিনোদনের সাথী হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে, চুপিসারে লুকিয়ে থেকে বাংলাদেশর ইটনা থেকে ঊড়ে আসা টিকটিকির ডিমের খোসা! আমার জোরাসিক উপহার।   পুনশচঃ-ডাটা উদ্ধার করতে পেরেছি, না পারলেও দুঃখ ছিলো না, অতি সাবধানে কাগজের ব্যাগে যত্ন করে বুক পকেটে নিয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছি টিকটিকি ডিমের খোসা এই দূর পরবাসে।