টিপু শাহ (?-১৮৫২) পাগলপন্থী আন্দোলনের নেতা। পিতা করিম শাহ-র মৃত্যুর পর ১৮১৩ সালে তিনি এ আন্দোলনের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর অধীনে এ আন্দোলন সরাসরি স্থানীয় জমিদারদের এবং পরোক্ষভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহে রূপ নেয়। তিনি এবং তাঁর অনুসারীরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তীব্র সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এমনকি শেরপুর অঞ্চলে তিনি এক স্বাধীন প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সাফল্য লাভ করেন।
টিপুর বিদ্রোহের প্রধান কারণ ছিল উত্তর ময়মনসিংহে রায়তদের ওপর জমিদারদের যথেচ্ছ নিপীড়ন। কিছু ঘটনাপ্রবাহ এবং নতুনভাবে ধার্য কর জনগণের দুর্দশা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। ১৮২০ সালে শেরপুর জমিদারি অংশীদারদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। ভাগ-বাটোয়ারা সংক্রান্ত জটিলতায় বিপুল ব্যয়সাপেক্ষ দীর্ঘ মামলা-মোকদ্দমার সূচনা হয়। এছাড়া ইঙ্গ-বার্মা যুদ্ধ কোম্পানির আর্থিক অবস্থা খুবই দুর্বল করে দেয়। এ আর্থিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য কোম্পানি জমিদারদের নিকট থেকে বাড়তি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা নেয়। বাড়তি বোঝা পোষানোর জন্য জমিদারেরা আরও বেশি করের বোঝা রায়তদের ওপর চাপায় ও তা জোরপূর্বক আদায় করতে থাকে। জনগণ এ অন্যায় কর ধার্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে।
টিপু শাহ এ প্রতিবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন। তিনি দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা দেন যে, জমিতে কারও একতরফা অধিকার নেই। আল্লাহর সৃষ্ট মানুষ হিসেবে জমির ওপর সকলের সমান অধিকার আছে। জনগণের সুখ, শান্তি, নিরাপত্তা এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য একজন ধর্মপ্রাণ ও ন্যায়বান শাসকের প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি গভীরভাবে অনুভব করেন। তাঁর মতে, যিনি জনগণের উপর অত্যাচার চালান তার শাসক হওয়ার কোনো অধিকার থাকে না। যেহেতু শেরপুরের জমিদাররা রায়ত সাধারণের ওপর অত্যাচার অনাচার চালায় এবং কোম্পানি তাদের সহায়ক, তাই তাদের কারোরই শাসক হওয়ার নৈতিক অধিকার ছিল না। বিরাজমান পরিস্থিতিতে টিপু শাহ ন্যায়বান ও ধর্মপ্রাণ শাসকের ভূমিকা পালনের সিদ্ধান্ত নেন।
টিপুর ঘোষণার ফলে হাজার হাজার মানুষ তাঁর অধীনে সঙ্ঘবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ হয় এবং তারা জমিদারদের কর দেওয়া বন্ধ করে দেয়। তাই স্বাভাবিক নিয়মে টিপুর অনুসারী ও জমিদারদের পাইক এবং বরকন্দাজদের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলতে থাকে। সময়ে সময়ে চলমান সংঘর্ষে পুলিশ ও নিয়মিত সেনাবাহিনী জমিদারদের সহায়তা করত। টিপু ও তাঁর মা’র (পীর-মাতা) নেতৃত্বে পাগলপন্থীরা প্রথমদিকে সফল হয়। এমনকি, তারা শেরপুর এলাকায় স্বাধীন প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করে যা দুবছরেরও বেশি সময় স্থায়ী ছিল।
শেরপুরের উত্তরে অবস্থিত গড়-জরিপ নামক মাটির দুর্গে টিপুর রাজধানী স্থাপিত হয়। তিনি স্বীয় অনুসারীদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন। উদাহরণস্বরূপ দেখা যায় যে, বাকশু সরকার জজ, গুমানু কালেক্টর, জরিপ পাগল ও অন্যান্য কয়েকজন ফৌজদার হিসেবে নিযুক্ত হন। তাঁর শাসননীতি ছিল উদার, জনকল্যাণমূলক ও ধর্মীয় অনুশাসনভিত্তিক। তিনি আল্লাহর নামে ও জনসমর্থনের মাধ্যমে শাসনদন্ড হাতে নেন। তাঁর রাজ্যে তিনি চুরি, ডাকাতি, হত্যা, সুদ, ঘুষ, প্রতারণা, জালিয়াতি এবং অনুরূপ অন্যান্য হীন কাজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি প্রতি কানি (১২০ শতক পরিমাণ জমি) জমির খাজনা চার আনায় নামিয়ে আনেন। লোকজন জমিদারদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয় এবং অপরদিকে টিপু শাহের নামে রাজস্ব ও সুলতানি আদায় হতে থাকে।
অবশ্য পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর যৌথ প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত টিপু বাহিনীর পরাজয় হয় এবং তিনি বন্দি হন। ১৮২৪ সালের ৭ ডিসেম্বর তাঁকে প্রথম বন্দি করা হয় এবং দু’দিন পর তিনি জামিনে মুক্তি পান। শীঘ্রই তাঁকে আবার আটক করা হয় এবং এবারও ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে তিনি জামিনে ছাড়া পান। ১৮২৫ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে তৃতীয় বারের মতো তাঁকে বন্দি করা হয়। এবার তাঁর বিচার করা হয় এবং বিচারে তিনি সাজা পান। তাঁর আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্বন্ধে নানান গল্প চালু আছে। সত্য-মিথ্যা যাই হোক না কেন এগুলি তাঁকে একজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি দেয়।
টিপু বন্দি হওয়ার পরও জাকু পাথর ও দুবরাজ পাথর পাগলপন্থীদের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। কিছুদিন তাঁরা সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে সক্ষম হন। ইতোমধ্যে জনগণের অনেক দাবি পূরণ করা হয় এবং ১৮৩৩-৩৪ সালের মধ্যে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে। পঁচিশ বছর কারাবাসের পর ১৮৫২ সালে টিপু শাহ জেলখানায় মারা যান। [এম. দেলওয়ার হোসেন]
গ্রন্থপঞ্জি এম. দেলওয়ার হোসেন, শেরপুরের ইতিকথা, ঢাকা, ১৯৬৯; সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এবং মুনতাসীর মামুন (সম্পাদিত), বাংলাদেশে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন, ঢাকা, ১৯৮৬। সুত্রঃ বাংলা পিডিয়া