গ্রাম বাংলায় এককালে কলের গান ছিল। এ কথা আজ কে’না জানে? বর্তমান প্রজন্ম কলের গান দেখেনি।এই কলের গানের কোম্পানির মালিক ব্যবসায়ীর বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলায় ছিল। এ কথা আমরা অনেকেই জানিনা বা জানতাম না। তাঁর নাম হেমেন্দ্র মোহন বসু। সংক্ষেপে এইচ বোস। পিতা হরমোহন বসু। ১৮৬৬ খ্রীঃ ইটনার জয়সিদ্ধি গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। ভারতীয় উপমাহাদেশে তিনিই প্রথম অবিভক্ত বাংলায় কলের গান, মোটর গাড়ী, বাই সাইকেল, টর্চলাইট ও সুগন্ধি তেলের কারখানা প্রভৃতি নির্মাণের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। হেমেন্দ্র মোহন বসুই প্রথম তাঁর সুগন্ধি কুন্তলীন ও দেলখোস।

তেলের প্রচার বিজ্ঞাপন ও ভারতীয় সুসাহিত্যের উৎসাহ প্রেরণার জন্য ১৮৯৬ সালে ‘কুন্তলীন’পুরস্কার প্রবর্তন করেন। বাঙালীর মধ্যে তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি কলকাতা হ্যারিসন রোডে মোটরগাড়ী ও বাই সাইকেলের ব্যবসা খুলেন। তাঁর প্রথম কেনা মোটর গাড়ীর নাম ছিল ‘টুসিটার ড্যাকার’(১৯০০ খ্রী) গাড়ী।

এটি তিনি নিজেই ড্রাইভিং করে চালাতেন। সে সময় গাড়ী সহ চালক আনতে হতো ইংল্যান্ড থেকে। অথচ তিনি নিজেই সে যুগে ড্রাইভিং শিখে ভারতের মাটিতে ‘গ্রেট ইষ্টার্ন’ মোটরগাড়ী কোম্পানী স্থাপন করেছিলেন। ভারতীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাঁর সবচেয়ে কৃতিত্বের বিষয় হলো কলের গানের ‘রেকর্ড’ তৈরীর কারখান স্থাপনের ইতিহাস।১৯০৫ খ্রীঃবঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে তাঁর তৈরী কলের গান রেকর্ডে সর্বপ্রথম গান রেকর্ড করা হয়’বন্দে মাতরম’নামের বিখ্যাত দেশাত্ববোধক গান। এসব দেশাত্ববোধক গানে কন্ঠ দিয়েছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডি,এল,রায় প্রমূখ কবি সাহিত্যিক গণ। কিশোরগঞ্জের এক কৃতি সন্তানের গ্রামোফোন রেকর্ডে গান গেয়েছেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর, ডি,এল রায় এর চেয়ে বড় গৌরবের বিষয় এ জেলা বাসীর আর কি হতে পারে? হেমেন্দ্র মোহন বসুর কলকাতা শহরে একটি প্রেস ছিল।

কলকাতা শহরে  তিনিই প্রথম ভারতীয় রঙিন আলোক চিত্র গ্রহনে পথিকৃৎ। খেলাধুলায় তিনি ছিলেন উৎসাহী। কিশোরগঞ্জে থাকা অবস্থাকালে তিনি কিশোরগঞ্জ ইউনিয়ন স্পোর্টিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। কলকাতা তাঁর ৫২ নম্বর আমহাট স্ট্রীটের নিজ বাড়িতে কিশোরগঞ্জের বহু জ্ঞানীগুনি জনের এককালে আসা যাওয়া ছিল। কটিয়াদী উপজেলার মসুয়া গ্রামের বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর বোন মৃনালিনী দেবীকে তিনি বিয়ে করেছিলেন।সত্যজিৎ রায়ের জীবনী গ্রন্থে উল্লেখ আছে, তিনি তাঁর ছেলে বেলা হেমেন্দ্র মোহন বসু তাঁর  ফুফার এইচ, বোস কোম্পানীর কলের গান শুনে আর তাঁর তোলা ছবি ‘অটোক্রোম স্লাইড’থেকেই পরবর্তীকালে চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রেরণা লাভ করেন। যদিও তাঁর পিতা সুকুমার রায় ও দাদা উপেন্দ্র কিশোর রায় উভয়েই ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক।

হেমেন্দ্র মোহন বসুর পুত্র ও কন্যাদের মধ্যে পুত্র নীতিন বোস ছিলেন আরতীয় খ্যাতনামা চিত্র পরিচালক, কার্তিক বোস ছিলেন ভারতের অন্যতম ক্রিকেটার, কন্যাদের মধ্যে মালতী ঘোষাল ছিলেন ভারতের অন্যতম সঙ্গীত শিল্পী। তিনি ভারতের বেতার,টিভিও এইচ বোস গ্রামোফোন রেকর্ডে রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।