বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে কিশোরগঞ্জের ডা. এএ মাজহারুল হক একজন নেপথ্য নায়ক। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ইপিআর-এর মাধ্যমে তার বাসার টেলিফোনে এসে পৌঁছেছিল। তখন তিনি মুক্তিকামী কিশোরগঞ্জবাসীর মধ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী, কুলিয়ারচর, নরসিংদীর বেলাব, মনোহরদীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন এবং তাদেরকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। তার সরাসরি তত্ত্বাবধানে কিশোরগঞ্জের বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আসাদুল্লাহ একদল দুর্ধর্ষ মুক্তিসেনাকে নিয়ে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
১৬ই ডিসেম্বর সমগ্র দেশ স্বাধীন হয়ে গেলেও কিশোরগঞ্জের স্বাধীনতা-বিরোধীরা শক্ত অবস্থান নিলে তিনি ব্যাপক রক্তপাত ও সংঘাত এড়ানোর লক্ষ্যে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গৌরাঙ্গ বাজারস্থ তার নিজ বাসভবনে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। আ. আউয়াল খান ও নূরুজ্জামান চান মিয়া (সাবেক পৌর চেয়ারম্যান), আল বদর কমান্ডার কেএম আমীনুল হক, নেজামে ইসলামী নেতা মাওলানা আশরাফ আলী বৌলাইসহ প্রায় ২০০ জনকে তিনি মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে বিনা রক্তপাতে কিশোরগঞ্জকে মুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেদিন কিশোরগঞ্জ সরকারি স্কুল ছাত্রাবাসে প্রতিষ্ঠিত মিত্র বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পে বিপুল মুক্তিযোদ্ধা ও আত্মসমর্পণকারী-আটক স্বাধীনতা বিরোধীদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন ডা. মাজহারুল হক। কারণ সে সময়ে কিশোরগঞ্জে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জিল্লুর রহমান, আ. সাত্তার উকিল, আ. হামিদ তখনও রণাঙ্গন থেকে দেশে এসে পৌঁছান নি। তিনি মুক্তাঞ্চল থেকে প্রথম কিশোরগঞ্জে প্রবেশ করার ফলে সিনিয়র নেতা হিসেবে জাতির ইতিহাসে এবং কিশোরগঞ্জের স্বাধীনতার মহান লগ্নে এই গৌরবময়-ঐতিহাসিক দায়িত্বটি পালন করেন।
স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার এবং বিজয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে তিনি কিশোরগঞ্জের ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে আছেন। বৃটিশবিরোধী সংগ্রামী, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ডা. এএ মাজহারুল হকের সারাটা জীবন নিবেদিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে। ১৯৩২ সালে তিনি তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ মহকুমার কুলিয়ারচর থানার লক্ষ্মীপুর গ্রামের প্রসিদ্ধ বিটি বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা নওয়াব আলী ছিলেন সমাজসেবক ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব আর চাচা হাসান আলী সে আমলে বিএবিটি ডিগ্রিধারী উচ্চ শিক্ষিত পণ্ডিত। ডা. এএ মাজহারুল হকের স্কুলজীবন অতিবাহিত হয় পার্শ্ববর্তী বাজিতপুরে এবং ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে। ১৯৪৮ সালে তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তার সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ, ওবায়দুল্লাহ খান (সেন্টু)। এ সময়ে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বিশেষ করে, সামপ্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে তার অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
কুলিয়ারচর, বাজিতপুর, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি ও শান্তি বজায় রাখার জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। এভাবেই রাজনীতি ও এলাকার মানুষের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং সেটা সারা জীবন অটুট থাকে। ১৯৫০ সালে তিনি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন। পঞ্চাশ দশকের শুরুতেই তিনি বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ও গণমুখী রাজনৈতিক সচেতন মানসিক অগ্রসরতাকে সঙ্গী করে ঢাকায় আসেন এবং দেশের একমাত্র মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ঢাকা মেডিকেলের আদিপর্বে একজন ছাত্র হিসেবে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে এবং প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকেন। প্রথম শহীদ মিনারের গৌরবময় অল্পকজন নির্মাতাদের মধ্যে ডা. এএ মাজহারুল হক অন্যতম।
ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য তিনি সংক্ষিপ্ত কারাবাস এবং পাকিস্তানি পুলিশের নির্যাতনও ভোগ করেন। ডা. মাজহারুল হক সরকারি চাকরি গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে তৎকালীন গ্রাম-বাংলায় আধুনিক চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য ১৯৫৭-৫৮ সাল থেকে কিশোরগঞ্জ শহরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন। তিনি কিশোরগঞ্জ শহরে স্থায়ীভাবে পেশাজীবন অতিবাহিতকারী প্রথম এমবিবিএস চিকিৎসক। দীর্ঘ অর্ধ-শতাব্দীর অধিক সময় নিরবচ্ছিন্নভাবে চিকিৎসা পেশায় প্রবাদপ্রতিম জনপ্রিয়তা ও সুনামের সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্থানীয় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সামনের কাতারে শামিল আছেন। তিনি কিশোরগঞ্জে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। বঙ্গবন্ধু কিশোরগঞ্জে এলে তার বাসাতেই অবস্থান করতেন। জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন তার অন্তরঙ্গ মানুষ। বর্তমানে তিনি কিশোরগঞ্জ শহরে অবসর জীবনযাপন করছেন।
লিখেছেনঃ ড. মাহফুজ পারভেজ, দৈনিক মানব জমিন থেকে নেয়া