এক দেশে জন্মে আরেক দেশের হয়ে খেলার ইতিহাস ফুটবলে অনেক আছে। এর বেশির ভাগেরই ‘নতুন’ দেশ বেছে নেওয়ার কারণ, জীবিকা বা জাতীয় দলে খেলার নিশ্চয়তা। কিন্তু ব্যতিক্রমী দুজন ফুটবলার জাপানের তুলিও তানাকা ও উত্তর কোরিয়ার জং তায় সে। শেকড়ের টানে ফিরে আসা এই দুই এশীয় ফুটবল তারকার গল্প শুনিয়েছেন দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
ব্রাজিলিয়ান সামুরাই
তিনি একজন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার। পেলে, গারিঞ্চা, রোনালদোদের মতো হলুদ জার্সি পরে বিশ্বকাপে যাওয়া হবে না তাঁর। তার পরও তিনি একজন বিশ্বকাপযাত্রী ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার। ডেকো, কাকাউদের মতো বিশ্বকাপ খেলবেন তিনি অন্য কোনো জার্সি গায়ে।
তাই বলে তাঁকে ডেকোদের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলবেন না। একটা জায়গায় তিনি বাকি সবার চেয়ে আলাদা। তিনি একজন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার, যাঁর শরীরে বইছে সামুরাই রক্ত—তিনি মার্কোস তুলিও তানাকা।
বলা হয়, ব্রাজিল কোনো দিন বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব পার হতে না পারলেও বিশ্বকাপে থাকবে ব্রাজিল। কারণ সোজা। প্রতি বিশ্বকাপেই একাধিক দলের হয়ে মাঠে নামেন ব্রাজিলে জন্ম নেওয়া ফুটবলাররা। এবার বিশ্বকাপেও সে রকম কয়েকজনকে দেখতে পাবেন।
দেখতে পাবেন জাপানের হয়ে মাঠে নামা তানাকাকেও। তানাকা হবেন জাপানের হয়ে বিশ্বকাপ খেলা তৃতীয় ব্রাজিলীয়। কিন্তু ওই যে কথা, তানাকা বাকি সবার চেয়ে আলাদা।
অন্য ব্রাজিলীয় ফুটবলাররা যেখানে জীবিকার টানে, জাতীয় দলের হয়ে খেলার নিশ্চয়তার টানে দেশ ছাড়েন; তানাকা ব্রাজিল ছেড়েছিলেন শেকড়ের টানে। আরও ভালো করে বললে বলা যায়, সামুরাই রক্তের টানে।
তানাকার ঠাকুরদাদা ইয়োশিয়ুকি ১১ বছর বয়সে ব্রাজিলে গিয়েছিলেন জীবিকার টানে। কফিবাগানের শ্রমিক থেকে কফিবাগানের মালিকে পরিণত হওয়া ইয়োশিয়ুকি ৯২ বছর বয়সে মারা গেছেন। যত দিন বেঁচে ছিলেন, নাতির কানে মন্ত্রের মতো বলে গেছেন, ‘ব্রাজিলে বসে আমাদের জাপানি গর্বটা নষ্ট করা যাবে না।’
সেই গর্বের টানে ১৬ বছর বয়সে জাপানে ফিরে এসেছেন তানাকা। জাপানে লিগ-টিগও খেলতে শুরু করেন। এর মধ্যে ১৯৯৮ বিশ্বকাপে জাপান খেলেছে। তাতে তানাকা এমন কিছু জাপান-ভক্ত হয়ে পড়েননি। কিন্তু ২০০২ সালে জাপান-কোরিয়া বিশ্বকাপের সময় হঠাৎ করে তিনি বুঝতে পারলেন, দাদু কিসের গর্বের কথা বলতেন!
বিশ্বকাপে জাপানের জাতীয় সংগীত বেজে উঠতেই বিদ্যুৎ খেলে গেল তানাকার শরীরে, ‘আমার শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। নিজে নিজে ভাবলাম, “অবশেষে আমি জাপানি হতে পেরেছি। অবশেষে আমি বদলে গেছি”।’
জাপানি হলেন বটে, কিন্তু জাপানের হয়ে মাঠে নামাটা সোজা হয়নি তানাকার। ২০০৩ সালে জাতীয় দলে অভিষেক হয় আক্রমণে ওঠার জন্য খ্যাতি পেয়ে যাওয়া এই ডিফেন্ডারের। ২০০৬ সালে জে লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেন। তার পরও ঠাঁই হয়নি তাঁর জিকোর দলে।
হাল ছাড়েননি তানাকা। সামুরাইরা হাল ছাড়ে না। অবশেষে ধৈর্যের পুরস্কার পাচ্ছেন তানাকা। কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে এবার দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে মাঠে নামবেন তিনি।
কোচ তাকেশি ওকাদারও অগাধ আস্থা তানাকার ওপর। তাঁর আক্রমণে ওঠার ক্ষমতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই ওকাদার। কিন্তু কোচ চান, তানাকা যেন আক্রমণ থেকে দ্রুত রক্ষণে ফিরে নিজের কাজটা করতে পারেন; ব্রাজিলের লুসিওর মতো।
আবার চলে এল একজন ব্রাজিলিয়ানের কথা!
আমাদের রুনি
জং তায়ে-সের জন্ম জাপানে। বাবা-মায়ের সুবাদে নাগরিক তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার। অথচ ফুটবল খেলেন উত্তর কোরিয়ার হয়ে। ‘বহুজাতিক’ এই ফুটবলারকে আমরা তাহলে কোন পরিচয়ে চিনব!
তাঁর জাতিগত পরিচয় আমাদের খোঁজ করার দরকার নেই। তাঁর পরিচয় এখন একটাই—এশিয়ার রুনি বা মানুষের রুনি!
২০০৬ সালে জাতীয় দলে অভিষেকের পর থেকে গোল করার যে অসামান্য দক্ষতা জং দেখিয়ে আসছেন, তাতে এর চেয়ে ভালো পরিচয় আর হতে পারত না। উত্তর কোরিয়ার জার্সি গায়ে ২১ ম্যাচে ১৪ গোল করে ফেলেছেন। স্টেডিয়াম ভরা লোকেরাই চিৎকার করে তাঁর নাম রেখে দিয়েছে—ইনমিনুই রুনি, আমাদের রুনি।
এশিয়ার রুনির জাতীয়তা নিয়ে সংকট তৈরি হলো তাঁর মা-বাবার কারণে। যদিও জংয়ের বাবা-মা ছিলেন উত্তর কোরিয়ার নাগরিক। কিন্তু রাজনৈতিক তো বটেই অর্থনৈতিক কারণে তাঁরা সংসার পেতেছিলেন জাপানে। সেখানেই জন্ম জংয়ের। জং বড় হতে হতে তাঁর বাবা-মা দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকত্ব পেয়ে যান।
কিন্তু চরম রাজনৈতিক বিরোধী উত্তর কোরিয়ার প্রতিই টান টের পেতেন তাঁরা। সে জন্য ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন জাপানের উত্তর কোরিয়ান এক স্কুলে। সেখানেই জং নিজেকে উত্তর কোরিয়ার মানুষ বলে ভাবতে শুরু করেন। জং সাধারণ কেউ হলে সমস্যা ছিল না।
যেহেতু তিনি একজন ‘রুনি’ তাই তাঁকে দলে পেতে উঠে-পড়ে লাগল জাপান ও দুই কোরিয়া। শেষমেশ জংয়ের ইচ্ছের জয় হলো। ফিফা তাঁকে অনুমতি দিল উত্তর কোরিয়ার হয়ে খেলার।
এই আনন্দে জং প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমি কখনোই দক্ষিণ কোরিয়ান নই। আমি উত্তর কোরিয়ান হিসেবে জন্মেছি, উত্তর কোরিয়ান স্কুলে পড়াশোনা করেছি; শুধু থেকেছি জাপানে। কিন্তু আমি উত্তর কোরিয়ান হিসেবে গর্ববোধ করি।’
জং বেশ বোঝেন তাঁর দক্ষিণ কোরিয়ান বন্ধুরা হয়তো কষ্ট পান। কিন্তু তিনি স্বপ্ন দেখেন, একদিন দুই কোরিয়া এক হয়ে যাবে। সেদিন আর তাঁর ওপর কারও রাগ থাকবে না। জং আরও কয়েকটা স্বপ্ন দেখেন। প্রথম স্বপ্নটা নিতান্ত ব্যক্তিগত। ইউরোপের ক্লাব ফুটবল খেলতে চান। আর শুধু এশিয়ার নয়, এবার ইউরোপের রুনি হতে চান। আসলে ঠিক রুনি নন, তিনি হতে চান দ্রগবা, ‘রুনির সঙ্গে তুলনাটা অপছন্দ করি না। এটা তো বিরাট সম্মান। কারণ তিনি এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার। কিন্তু আমার আইডল দ্রগবা। আমি তাঁদের মতো ইংল্যান্ডে খেলতে চাই। এই বিশ্বকাপে আমরা ব্রাজিল ও পর্তুগালের বিপক্ষে খেলব। ওখানে ভালো খেললে কেউ না কেউ তো ডাকবেই।’
কিন্তু ব্রাজিল, পর্তুগালের মতো দুই ‘দৈত্য’, সেই সঙ্গে আফ্রিকার কালো ঘোড়া আইভরি কোস্ট—এদের বিপক্ষে জংদের পক্ষে কি আদৌ ভালো কিছু করা সম্ভব? এখানেই জংয়ের দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত স্বপ্নটা লুকানো। তিনি ১৯৬৬ সালের উত্তর কোরিয়ান রূপকথার গল্প জানেন। জানেন পূর্বসূরিরা ইতালিকে (১-০) হারিয়ে দিয়েছিল, প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলতে এসেই উঠে গিয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনালে। সেখানে শেষ অবধি ইউসেবিওর পর্তুগালের বিপক্ষে ৩ গোলে এগিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত সেমিফাইনালে যাওয়া হয়নি। তবে ফুটবল-বিশ্বকে উত্তর কোরিয়া চমকে দিয়েছিল ঠিকই।
আবার সে রকম একটা চমক দিতে চান জং, ‘বিশ্বকাপের টিকিট পেতে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এবার আমরা এমন কিছু করতে চাই যাতে বিশ্ব চমকে যায়। আমরা গ্রুপ পর্ব পার হয়ে যেতে চাই এবং তিনটি ম্যাচেই একটি করে গোল করতে চাই আমি।’
এই না হলে এশিয়ার রুনি!