শেফালী-কাশফুল-শাপলায় শুচিশুভ্র প্রকৃতি। আকাশে পেঁজা পেঁজা সাদা মেঘের ভেলা। জগৎ আনন্দময় করে তুলতে দুর্গতিনাশিনী আনন্দময়ীর মর্ত্যে আগমন। ঢাকের বোলে সর্বভূতে শক্তিরূপে সংস্থিতা দেবীর আগমনীবার্তা। মহালয়ার মধ্য দিয়ে শারদীয় দুর্গা পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে গেছে।দুর্গার পূজায় অনেক উপচারের মধ্যে অন্যতম হলো ‘জয়ন্তী তরু’। জয়ন্তীর ডাল ছাড়া দুর্গাপূজায় নবপত্রিকাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া যায় না।
ষষ্ঠীতে বোধনের সময় বেলগাছের নিচে রাখা ‘নবপত্রিকা’কে অধিবাস করানো হয়। ‘নবপত্রিকা’—জয়ন্তী, ধান, অশোক, কলা, হলুদ, ডালিম, বেল, মানকচু ও অপরাজিতা—এই নয়টি গাছের শাখা দিয়ে তৈরি। এই নয়টি গাছ নয়টি দেবীর শক্তি নিয়ে নবপত্রিকাবাসিনী ‘দেবী দুর্গা’।নবপত্রিকার শক্তিকে এভাবে বর্ণনা করা হয়—
‘কদলী ব্রহ্মাণী কচু গাছে কালিকা/ হরিদ্রে পত্রিকিয়ে দুর্গা জয়ন্তী বৃক্ষে জয়ন্তিকা/ বিল্ব বৃক্ষে শিবানী দেবী ডালিমে রক্তদন্তিকা/ অশোক গাছে শোকহারিণী মান্য বৃক্ষে চামুণ্ডা/ ধান্যে মহালক্ষ্মী দেবী নবদুর্গা পরিবৃতা/ অষ্টশক্তি সহিত দেবী নবদুর্গা জগন্মাতা।’এরপর দুর্গাপূজায় সপ্তমীতে বোধনের বেলগাছের ডাল ছেদন করে অর্ধেকটা ডাল নবপত্রিকায় স্থাপন করে, নবপত্রিকাকে মন্দিরের দ্বারে রেখে বিশেষ স্নান করিয়ে প্রার্থনা করা হয় এই ভেবে যে, ‘মা দুর্গা’ এই নবপত্রিকার সঙ্গে মন্দিরে প্রবেশ করবেন। এভাবে নবপত্রিকাকে গণেশ মূর্তির ডালে স্থাপন করা হয়। একই সঙ্গে বোধনের বাকি অর্ধেক বেলগাছের শাখা ঘটে স্থাপন করা হয়। দশমী পর্যন্ত সেই ঘটে পঞ্চপল্লব থাকে। দুর্গামণ্ডপে নবপত্রিকাকে শাড়ি দিয়ে আবৃত করে মাতৃরূপে পূজা করা হয় গণেশ মূর্তির ডান পাশে রেখে।
জয়ন্তীর বৈজ্ঞানিক নাম Sesbania sesban; সংস্কৃতে এর নাম ‘জয়ন্তিকা’। এটি Fabaceac পরিবারের ফুল। মাঝারি আকারের তরু। উচ্চতা গড়পড়তা ১০-২০ ফুট। কাণ্ড গাঢ় বাদামি বর্ণের। কাণ্ডে খুব অল্প ব্যবধানে ঘন ঘন ডাল বের হয়। ঘন পল্লবময়। দ্রুত বর্ধনশীল ক্ষণজীবী বৃক্ষ এটি। বাঁচে প্রায় তিন বছর। পাতা পক্ষল যৌগিক, পত্রক থাকে প্রায় ২০ জোড়া। ভিন্ন ভিন্ন গাছে তিন রঙের ফুল হয়—হলুদ, গোলাপি ও বাদামি। ফুলের আকার দু-তিন সেন্টিমিটার। পাপড়ি চারটি। দুটি পাপড়ি উল্টানো বিস্তৃত, দুটি একত্রীভূত।
পাপড়ির ওপরের ভাগ হলুদ রঙের, নিচের দিক বাদামি রঙের ওপর ছোট ছোট কালো অসংখ্য ছিটেফোঁটা থাকে। কুঁড়ি অবস্থায় শুধু কালো ছিটেফোঁটা বাদামি রংটিই দেখা যায়। পৌষ মাসে ফুল ফোটা শুরু। ফল চিকন লম্বাটে, কাঁচা অবস্থায় সবুজ। শুকিয়ে গেলে বাদামি বর্ণ। প্রতিটি ফলে ২০-২৫টি বীজ থাকে। ফুল যেমন থোকা থোকা ফোটে প্রচুর, ফলও ধরে ঠিক তেমনি। বীজ থেকে বংশ বিস্তার করা যায়।
এই গাছের বিভিন্ন অংশবিশেষ পরিশোধনের মাধ্যমে ভেষজ চিকিৎসায় ব্যথা উপশম, চর্মরোগ নিরাময় ও জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহূত হয়। আরব্য ও পারস্য সাহিত্য থেকে জানা যায়, জয়ন্তীর বীজে বিছা, মৌমাছি, ভিমরুল কামড়ের ব্যথার উপশম হয়। এ ছাড়া গাছের পাতা, ফুল ও বীজ সবুজ সার হিসেবে ব্যবহূত হয়।
পানের বরজ, চা ও কমলালেবুর বাগান, হলুদের খেতে ছায়ার জন্যও জয়ন্তীগাছ লাগানো হয়। ঝিরিঝিরি পাতার ফাঁকে থোকা থোকা ফুল ও ফলে এ গাছের শোভা অপূর্ব।্রসে কারণেও কাননে-উদ্যানে জয়ন্তীগাছ প্রচুর লাগানো হয়। দিনাজপুরের রামকৃষ্ণ মিশন প্রাঙ্গণে একটি জয়ন্তীগাছ রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, মিসর, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়াসহ বহু দেশে এ গাছ পাওয়া যায়।
-কান্তা রিমি রায়