মিরপুর চিড়িয়াখানাসংলগ্ন জাতীয় বন-বাগানে সম্প্রতি এক দুর্লভ আগন্তুকের দেখা পেয়ে ঢাকার পাখি-দর্শকেরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছেন। ঢাকার জনারণ্যে তো বটেই, দেশের সংরক্ষিত অরণ্যেও সহজে এর দর্শন মেলে না। দুর্লভ এ আগন্তুকের নাম খয়রাপাখ পাপিয়া, বাংলাদেশে ১২ জাতের পাপিয়ার মধ্যে এটি সবচেয়ে বড় পাখি। পাখিটি শুধু যে দৈর্ঘ্যেই অনন্য তা নয়, রঙিন ডানা, খাড়া ঝুঁটি ও লম্বা-চওড়া লেজ নিয়ে সৌন্দর্যেও অতুলনীয়। প্রতি বর্ষায় যে তিন জাতের পরিব্রাজক পাপিয়া চুপিসারে এ দেশে আসে, এই সুদর্শন আগন্তুক তার একটি।
বন-বাগানের বৃষ্টিভেজা গাছে খয়রাপাখ পাপিয়াকে শুঁয়োপোকা শিকার করতে দেখা গেছে। পাখিটি লাজুক হলেও ভীতু নয়; মানুষের ভিড় না থাকলে পাতার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে, ছবি তোলার সুযোগ দেয়। মাত্র একটি পাখির দেখা মিললেও মনে হয় এর জোড়াও এখানে আছে। পাখিটির সাজসজ্জা দেখে ও ‘পিইপ-পিইপ’ ডাক শুনে বোঝা যায়, প্রজননের প্রস্তুতি চলছে। বর্ষাই এর প্রজননকাল। বন ছাতারে ও দাগি ছাতারে পাখির দল বর্ষায় চিড়িয়াখানা ও বন-বাগানের গাছে বাসা বাঁধে। লুকিয়ে ওই বাসায় ডিম পেড়ে যাওয়ার জন্যই হয়তো খয়রাপাখ পাপিয়া এখানে এসেছে।
বাংলাদেশে ১২ প্রজাতির পাপিয়া সবই আড়ালে-আবডালে থাকে, পোকা খায় এবং অপরের বাসায় ডিম পাড়ে। বউ-কথা-কও পাপিয়া, করুণ পাপিয়া ও পাকরা পাপিয়া লোকালয়ের কাছে আসে বলে অনেকে এদের কথা জানেন। কিন্তু বাকি নয় জাতের পাপিয়া সচরাচর বনে বাস করে বলে আমজনতার নজরে পড়ে না। এসব অজানা ও রহস্যময় পাখির মধ্যে খয়রাপাখ পাপিয়া সম্পর্কে আমরা খুবই কম জানি। শুধু দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই পাখিটির বাস; বাংলাদেশ ছাড়া মাত্র নয়টি দেশে এর দেখা মেলে। কিন্তু পাখিটি কোথায় স্থায়ী আর কোথায় পরিযায়ী, তা অনেকটা অজানা। শ্রীলঙ্কা, ভারত ও ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলে সারা বছর এবং বাংলাদেশ, নেপাল ও তার পুবের পাঁচটি দেশে শুধু গ্রীষ্মে পাখিটিকে দেখা গেছে।
মে-আগস্ট মাসের প্রজনন-মৌসুমে বাংলাদেশে খয়রাপাখ পাপিয়ার দেখা মেলে এবং তার আগে-পরে মেলে না বলেই আমরা ধরে নিয়েছি, পাখিটি এ দেশে প্রজনন-পরিযায়ী। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া ছানা সম্পর্কে আমাদের তথ্য অপ্রতুল; অগ্রহায়ণে এরা পুবে না পশ্চিমে পরিযায়ন করে, তাও অজানা। এসব বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য পাখিটি নিয়ে আমাদের গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। ছানার পায়ে জন্মস্থান-শনাক্তকারী আংটি লাগিয়ে সহজেই এ ধরনের গবেষণা শুরু করা যায়। মিরপুরের বন-বাগানে পাখিটির উপস্থিতি বন বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্য প্রাণী গবেষকের জন্য বিরল সুযোগ নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের এই দুর্লভ পাখিটি ভবিষ্যতে যেন টিকে থাকে, সে জন্য এখনই আমাদের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।