বাংলাদেশের মানুষ ভোজন বিলাসী। আর এই পরিচয়ে প্রথমেই আসে মাছ এবং ভাতের কথা। অর্থাৎ, মাছে-ভাতে বাঙালি। ভোজনে পটু এই জাতির খাদ্য তালিকায় প্রথম পছন্দের মাছ হল ইলিশ। আবহমান বাংলার নিজস্ব যে পরিচয় তা হচ্ছে সাগর-মোহনা, নদ-নদী, বিল-ঝিল, হাওড়-বাওড়। এদেশের জলরাশির প্রতিটি কণা থেকে সোনার জন্ম হয়। জলে মাছ, জলে ফসল, জলেই দেশের কৃষিক্ষেত্র আজ পলি আচ্ছাদিত উর্বরা শক্তি। আমাদের দেশের জলরাশিতে সারাক্ষণ সূর্যরশ্মি পরে। এই রশ্মির আলোর প্রভাবে জলজ সম্পদ উৎপাদনে পরিপূর্ণ। যেজন্য এখনও জলজ সম্পদে টিকে আছে ৭৫০ প্রজাতির মাছ, ৭০ প্রজাতির চিংড়িসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী।

দেশের জাতীয় ও জননন্দিত মাছ হিসেবে ইলিশের সমাদর আদিকাল থেকেই। ইলিশ মাছ মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর কোলোষ্টরল কমাতে সাহায্য করে এবং উপকারী কোলোষ্টরলের পরিমাণ বাড়ায়। ইলিশে খাদ্যের প্রাণীজ আমিষের অবদান শতকরা ৯·৫ ভাগ। এবারে মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশে ইলিশের উৎপাদন আমাদের আশার সঞ্চার করেছে। পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে শতকরা ১১ ভাগ। শুধুমাত্র প্রজনন ক্ষেত্রগুলোতে ডিমওয়ালা মাছ সংরক্ষণ এবং জাটকা মারতে না দেয়াতে এবারের এই অধিক উৎপাদন। দেশের ১৪৩টি উপজেলা এবং ১৪১৯টি ইউনিয়নে প্রায় ৪·৫ লাখ স্থায়ী ও অস্থায়ী জেলে ইলিশ মাছ ধরলেও শুধুমাত্র ডিম ছাড়ার স্থান হিসেবে উপকূলীয় ৭টি জেলার ২০টি উপজেলার ৭ হাজার বর্গ কিঃ মিঃ উপকূলীয় এলাকা। এখানে প্রজনন মৌসুমে প্রজননক্ষম মাছ সংরক্ষণের কারণে এবারে অভূতপূর্ব উৎপাদন এসেছে। পঞ্চাশের দশকে আমাদের দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ১ থেকে ১·৫ লাখ টন। পরে তা কমলেও ১৯৮০-৮১ সালে সেই উৎপাদন ১ লাখ টনে দাঁড়ায়। যদিও ১৯৮৬-১৯৮৭ সালে উৎপাদন হয় ২·৪২ লাখ টন।

ইলিশ মাছ আমাদের অর্থনীতিতে প্রথম থেকেই তার অবস্থান সুদৃঢ় করে নিয়েছে। ২০০১-০২ সালে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২·৩০ লক্ষ টন। দেশের অর্থনীতিতে যার অবদান ছিল শতকরা ১৩ ভাগ। জিডিপি’ তে অবদান ছিল শতকরা ১·২৫ ভাগ। অর্থনীতিতে অবদানের পাশাপাশি মানবদেহের প্রয়োজনে ইলিশের অবদান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শরীরের পুষ্টি রক্ষা এবং বৃদ্ধির জন্য ইলিশ মাছের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

কেননা, প্রতি ১০০ গ্রাম ইলিশ মাছ থেকে পাওয়া যায়- ক্যালসিয়াম ০·১৮ গ্রাম, ফসফরাস ০·২৮ গ্রাম, লৌহ ২১৩ মিঃ গ্রাম। এছাড়া এই মাছের মাংশে খাদ্যউপাদান রয়েছে শতকরা ২·২ ভাগ আঁশ, ৫৩·৭ জল, ১৯·৪ বডি ফ্যাট এবং ২১·৮ প্রোটিন। যেজন্য ইলিশ মাছ স্বাদ ও মুখরোচক খাদ্য হিসেবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে বাঙালির কাছে।

ইলিশ মাছ খাদ্যের খোঁজে এবং ডিম ছাড়তে লোনা জল থেকে মিষ্টি জলে আসে। ডিম ছাড়া শেষ হলে আবার ফিরে যায় লোনা জলে। আসা-যাওয়ার সময় ধরা পড়ে জেলেদের জালে। কখনও ইলিশ হয়ে, আবার কখনও জাটকা হিসেবে। এদেশের তাপমাত্রা, কার্বন-ডাই অক্সাইড, পি-এইচ, অক্সিজেন, জলের ক্ষারত্ব, ঘোলাত্ব স্রোত এবং প্রাকৃতিক খাদ্যের জন্য রয়েছে অনুকূল পরিবেশ। সাধারণত সাগরের মোহনা থেকে নদ-নদীর উজানে প্রায় ১৩০০ কিঃ মিঃ পর্য- ইলিশ মাছের বিচরণ ক্ষেত্র। স্থান-কাল ভেদে ইলিশ মাছের আকার যাই হোক না কেন, পুরুষের তুলনায় স্ত্রী ইলিশ মাছের আকার বড় হয়ে থাকে। একটি পরিপক্ক ইলিশ তার পরিণত অবস্থায় ৫ থেকে ২০ লাখ ডিম দিয়ে থাকে। বর্তমানে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার জন্য ইলিশের প্রজনন ক্রিয়ায় প্রভাব পড়েছে। সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাসে ইলিশ মাছ ডিম ছেড়ে থাকে। ভোলার ঢলচর, মনপুরা, নোয়াখালী জেলার হাতিয়ার, কালিরচর ও মৌলভীরচরকে ইলিশের প্রজনন এলাকা হিসেবে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়।

২০০৮ সালে আমাদের দেশে ইলিশের উৎপাদন বিগত বছরের তুলনায় শতকরা ১১ ভাগ বেশি হলেও উৎপাদন ও সংরক্ষণের জন্য রয়েছে অনেক প্রতিবন্ধকতা। তার মধ্যে ফারাক্কার মরণ ছোবল, নদীগুলোতে পলি পরে ভরাট, মেঘনা নদীর মোহনার জায়গা বেহাত হয়ে যাওয়া, দেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং জলজ পরিবেশ দূষণের মত সমস্যা উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া আমাদের জেলেদের লোভ ও অজ্ঞতার কারণে হাজার হাজার মেঃ টন জাটকা ধরে ইলিশের বংশ শেষ করে দিচ্ছে। তবে চলতি বছর এই সমস্যার মোকাবিলা করে আশানুরূপ আহরণ করা সম্ভব হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে- জাটকা নিধন রোধ করা, ইলিশের আবাসস্থলকে সমুন্নত রেখে উৎপাদন করতে দেশের মৎস্য অধিদপ্তর নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে এ বছরে এই সফলতা। জেলেদের বিকল্প আয়-রোজগারের ব্যবস্থা, জাটকা নিধন রোধকল্পে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। এখন শুধু ভৌত এবং অবকাঠামোগত অবস্থার পরিবর্তন এনে ইলিশ রক্ষার নানামুখী পরিকল্পনা হাতে নেয়া দরকার। মাছের উৎপাদন যা-ই বাড়-ক না কেন প্রতি বছর যেভাবে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ দেশের মোট জনগোষ্ঠির সাথে যোগ হচ্ছে তাতে এই বাড়তি উৎপাদন মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। ইলিশ মাছকে রক্ষা করতে হলে আমাদের করার আছে অনেক কিছু। নভেম্বর থেকে মে মাস পর্য- সময়ে মৎস্য সংরক্ষণ আইন-১৯৫০ (সংশোধিত) আইনের মাধ্যমে জাটকা ধরা নিষেধ আছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বাজারে বছরের সব সময়ে জাটকা পাওয়া যায়। এজন্য প্রয়োজন সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন এবং তা কার্যকর করা।

রাজবাড়ি জেলার গোয়ালন্দে পদ্মা-যমুনা নদীর সঙ্গমস্থলে জলের বর্ণ দুধরনের। পদ্মার ঘোলা জল এবং যমুনার স্বচ্ছ জলের মিলনস্থানে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ বিচরণ করে থাকে। এখানে ইলিশের প্রজননক্রিয়া ভাল হয়। এই প্রজনন এলাকাকে সংরক্ষিত করতে হবে যাতে ইলিশের নিরাপদ অভয়াশ্রম হয়। জলদূষণ রোধে কঠোর ব্যবস্থা এবং ইলিশ রক্ষার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে জাটকা রক্ষায় আইনি প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয়  “আন্ত-সম্পর্কীত দপ্তর” স্থাপন করতে হবে। ইলিশ নির্ভর জেলেদের অবসরকালীন সময়ের জন্য কাজের ব্যবস্থা ও ইলিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি এই মাছের গুরুত্ব বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়া ইলিশ বিচরণ জলাশয়গুলোর নাব্যতা তৈরি করতে হবে এবং বর্ষার সময়ে বাড়তি জলের স্টকহোল্ড গড়ে তুলতে হবে। মেঘনার মোহনা দখলমুক্ত রাখতে হবে, তাহলেই ভবিষ্যতে স্বাচ্ছন্দ্যময় এক ইলিশ জোন গড়ে উঠবে।

লেখক: গৌতম কুমার রায়