হাইকোর্টের একটি আদেশের পর কিশোরগঞ্জের নিকলীর রোদা নদী জলমহালের নিরঙ্কুশ মালিকানা এখন সরকারের। অথচ গত ১৩ জুলাই থেকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের এক নেতাসহ প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে নদীটি ভোগদখল করছে। প্রতিদিন নদী থেকে লুট হচ্ছে হাজার হাজার টাকার মাছ। সাত দিন ধরে প্রকাশ্যে এ লুণ্ঠন চললেও মাছ ধরা বন্ধে প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি, ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি দখলদারদের বিরুদ্ধে।

গত বৃহস্পতিবার নিকলীর ইউএনও মো. হাবিবুর রহমান জানান, জলমহালটি এখন সরকারের মালিকানাধীন। স্থানীয়রা জলমহাল থেকে মাছ ধরছে জানার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের বাধা দেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে ইউএনও আরো জানান, একটি বিশেষ মহল জলমহালের ইজারা বন্দোবস্ত হাইকোর্টে নানাভাবে স্থগিত করিয়ে দীর্ঘদিন ভোগদখল করে আসছে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোদারপুড্ডা বাজার এলাকা থেকে নিকলী সদরের গোবিন্দপুর গ্রাম পর্যন্ত নদীটি প্রায় তিন কিলোমিটার বিস্তৃত। বদ্ধ (চলমান নয়) জলমহাল হিসেবে সরকার এ নদী বন্দোবস্ত দিয়ে আসছে। সর্বশেষ ১৪১৭-২২ বঙ্গাব্দ মেয়াদে এক লাখ ৯৬ হাজার টাকায় ডুবি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিকে রোদা নদী ইজারা দেওয়া হয়।

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্র জানায়, জোতের দাবিদার ৫২ পরিবারের পক্ষে রোদারপুড্ডা গ্রামের সুভাস চন্দ্র দাস বাদী হয়ে জলমহালের ৫৪ দশমিক ৮ একর ভূমির মালিকানা দাবি করে হাইকোর্টে ডিক্রি চেয়ে মোকদ্দমা দায়ের করেন। বাদীপক্ষের দাবি, জলমহালটি নদী নয়, ব্যক্তিমালিকানার জোত জমি। ২০০৪ সালেই হাইকোর্ট বিবাদীপক্ষের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। পুরো প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নূরুজ্জামান।
আদেশের পর ডুবি সমিতির পক্ষে ইজারাদার আজিজুর রহমান জলমহালের ৫৪ দশমিক ৮ একর ভূমির দখল হারান। পান মাত্র ২০ দশমিক ৫৭ একর ভূমি। এদিকে ভবানীপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির পক্ষে সাধারণ সম্পাদক স্বপন বর্মণ ২০১০ সালে মন্ত্রণালয়ে আবার জলমহালের প্রকল্প দাখিল করেন। ওই বছরই প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। অন্যদিকে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চেয়ে ডুবি সমিতি আবেদন করে। শুনানি শেষে গত ২৭ মে বিচারপতি মামনুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ আগের অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার আদেশটি স্থগিত করেন। ফলে ২৭ মের পর থেকে জলমহালটি পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাইকোর্টের আদেশের পর প্রায় দেড় মাস কোনো পক্ষই নদীতে জাল ফেলেনি। গত ১৩ জুলাই থেকে হঠাৎ রোদারপুড্ডা ও কুর্শা এলাকার জোতের দাবিদার লোকজন জলমহালে প্রকাশ্যে জাল ফেলে মাছ ধরে নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও নেতৃত্বে আছেন সেই আওয়ামী লীগ নেতা মো. নূরুজ্জামান। বিএনপির ইউনিয়ন পর্যায়ের এক শ্রেণীর নেতাও আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে আছেন। এলাকাবাসী জানায়, এর আগে ২০০৪ সালের নিষেধাজ্ঞার আদেশের পরও ওই একই মহল জলমহালটি ভোগদখল করেছে।

সরেজমিনে রোদা নদীতে গিয়ে দেখা যায়, তিন কিলোমিটার দীর্ঘ নদীর বিভিন্ন স্থানে ভিম জাল, খরা জাল ও গইরা জাল পাতা। স্থানীয়রা জানায়, প্রতিদিন সকাল-বিকাল এসব জাল দিয়ে ধরা মাছ স্থানীয় আড়তে বিক্রি করা হচ্ছে। মাছের আড়তের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, প্রতিদিন কমপক্ষে ৩৫-৪০ হাজার টাকার মাছ লুট হচ্ছে। তাঁরা আরো জানান, প্রতি মৌসুমে এ জলমহাল থেকে আয় হয় ২৫-২৬ লাখ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ আয়ের প্রধান অংশটিই যাচ্ছে নেতাদের পকেটে।
রোদারপুড্ডা গ্রামের উত্তর-পূর্ব কোনায় নদীর একাংশে ৬০ শতাংশ জায়গায় সরকারের মৎস্য বিভাগ অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে। চোখে পড়ে, সেখানে বেশ কিছু লাল নিশান পাতা। এর ভেতর পরিকল্পিত উপায়ে মাছের চাষাবাদ হওয়ার কথা। অভয়াশ্রমকে কেন্দ্র করে রোদারপুড্ডা মাছের আড়তের এক পাশে মৎস্য বিভাগ পাকা ভবন তুলে অফিস খুলে বসেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, মৎস্য বিভাগের নাকের ডগায় ওই অভয়াশ্রম থেকেও প্রভাবশালীরা অবাধে মাছ ধরে নিচ্ছে। কুর্শা গ্রামবাসী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. শামসুদ্দিন, রোদারপুড্ডার মাছ ব্যবসায়ী মো. বকুল মিয়া প্রমুখ কালের কণ্ঠকে জানান, এ জলমহালের ইজারা ব্যবস্থাপনা মামলায় আটকে দিয়ে প্রভাবশালী মহলটি যুগ যুগ ধরে জলমহালটি লুটেপুটে খাচ্ছে। ওদের ভয়ে এলাকার সাধারণ ও গরিব জেলেরা নদীতে জাল ফেলার সাহস দেখান না। তাঁরা মনে করেন, এখন গুটিকয়েক ব্যক্তি জলমহাল থেকে লাভবান হচ্ছে। জলমহালটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ইজারা বন্দোবস্ত দিলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাবে।
জারইতলা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. আক্কাস আলীর বিরুদ্ধেও নদী থেকে মাছ ধরার অভিযোগ রয়েছে। আক্কাস আলী জানান, তিনিও জোতের একাংশের মালিক। নদী থেকে মাছ ধরার অভিযোগ সম্পর্কে জানান, ১৩ জুলাই থেকে মাছ ধরা হচ্ছে, এটা ঠিক। তবে তা আওয়ামী লীগ নেতা নূরুজ্জামানের নেতৃত্বেই হচ্ছে। তিনি ওই নেতার সঙ্গে আছেন।

নদীর দখলদার আওয়ামী লীগ নেতা মো. নূরুজ্জামান স্বীকার করেন, গত ২৭ মে হাইকোর্টে আগের একটি অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার আদেশ স্থগিত হয়েছে। তাঁদের প্রতিপক্ষ কৌশলে ওই আদেশটি স্থগিত করায়। তবে এতে জলমহালটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়নি- এ দাবি করে তিনি জানান, জলমহালটি এখনো তাঁদের দখলেই আছে। নিষেধাজ্ঞার আদেশ স্থগিতের দেড় মাস পর থেকে মাছ ধরার কারণ সম্পর্কে তিনি জানান, ১৩ জুলাই থেকে নয়, আগে থেকেই মাছ ধরা হচ্ছে। আগামী সপ্তাহে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশটি আবার স্থগিত হবে।

লিখেছেনঃ  নাসরুল আনোয়ার