ন্যূনতম মজুরি ৫ হাজার টাকার দাবিতে শ্রমিক বিক্ষোভের জের ধরে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে গতকাল শনিবার সকাল থেকে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। সংঘর্ষে ১০ পুলিশসহ কমপক্ষে শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা টঙ্গী-আশুলিয়া সড়কে গাছ ফেলে ও টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ করে রাখে। দফায় দফায় হয়েছে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ। চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ প্রায় অর্ধশত রাউন্ড ফাঁকা গুলীবর্ষণ, জলকামান এবং কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। এতে আনিস নামে এক শ্রমিক গুলীবিদ্ধ হয়। অশান্ত পরিস্থিতি দেখে আশপাশের প্রায় ৬০টি কারখানায় কর্তৃপক্ষ এদিন ছুটি ঘোষণা করে। উত্তেজিত শ্রমিকরা কয়েকটি কারখানা ও ১০/১২টি যানবাহন ভাংচুর করে। আহতদের স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি আপাতত শান্ত হলেও থেমে থেমে বিভিন্ন দিক থেকে শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে অতিরিক্ত পুলিশের পাশাপাশি র্যা ব সদস্যরা অভিযান চালিয়ে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনে।
শ্রমিক ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ন্যূনতম ৫ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে শুক্রবার বিকেল থেকে নিশ্চিন্তপুর এলাকার নাসা গ্রুপের ৫টি কারখানায় বিক্ষোভ করে কয়েক হাজার শ্রমিক। এ সময় তাদের বিক্ষোভে বাধা দেন কারখানা কর্তৃপক্ষ। বাধা পেয়ে তারা সড়ক অবরোধ করে। অবরোধ ভাঙ্গতে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে সেখানে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ হয়। আহত হয় কমপক্ষে ২৫ শ্রমিক। পরে অতিরিক্ত পুলিশ ধাওয়া দিয়ে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে শ্রমিকরা বাড়ি ফিরে যায়। শনিবার সকালে নাসা গ্রুপের ৫টি কারখানায় শ্রমিকরা যথারীতি কাজে যোগ দিতে এসে কারখানার মূল ফটকে ছুটির নোটিশ দেখতে পেয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। একপর্যায়ে কর্তৃপক্ষের সাথে বাদানুবাদ ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। উত্তেজিত শ্রমিকরা এ সময় নাসা গ্রুপের গ্লোবাল লিমিটেড, হাইটেক লিঃ, ওয়াশ লিঃ, নাসা গার্ডেন এবং এ জি সুপার গার্মেন্টস এর জানালার কাচ ও আসবাবপত্র ভাংচুর করে। পরে ওই কারখানার বিক্ষুব্ধ কয়েক হাজার শ্রমিক পার্শ্ববর্তী নরসিংহপুর এলাকায় আশুলিয়া-টঙ্গী সড়ক অবরোধ করে। পুলিশ অবরোধ না করার জন্য শ্রমিকদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে লাঠিচার্জ করে। এ সময় কমপক্ষে অর্ধশতাধিক শ্রমিক আহত হয়। আহত সবুজ, মোঃ জয়নাল, খায়রুল, আব্দুল হালিম, রুবিনা আক্তার, মৌসুমি, হাফিজুর রহমান, মাফু, হাসেমসহ অনেককে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে বলে শ্রমিকরা জানায়। উত্তেজিত হয়ে তারা ১০/১২টি যানবাহন ভাংচুর করে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা এ সময় আশপাশের শারমীন গ্রুপ, অনন্ত গার্মেন্টস, হামীম গ্রুপ, সোনিয়া গার্মেন্টস, এনভয়সহ ৮/১০টি কারখানা ভাংচুর করে। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ফাঁকা গুলীবর্ষণ ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে। শ্রমিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে জামগড়া, নরসিংহপুর, নিশ্চিন্তপুর এলাকার বিভিন্ন বাইপাস সড়কে অবস্থান নেয়। দুপুরের দিকে তারা সংগঠিত হয়ে সেখান থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা। চলে পুলিশি এ্যাকশন। শ্রমিকদের দমন করতে ব্যবহার করা হয় জলকামান। শ্রমিকদের ছোঁড়া ইটপাটকেল নিক্ষেপে এ সময় পুলিশের ডিএমপি’র এস আই শাহজাহান, এস আই ফরিদুল ইসলাম, ব্যাটালিয়ন কনস্টেবল মাহমুদুলসহ ১০ পুলিশ সদস্য আহত হয়। শাহজাহানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে পুলিশ জানায়। শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে পুরো ১ কি.মি এলাকা জুড়ে। পরিস্থিতির অবনতি দেখে আশপাশের প্রায় ৬০টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। ছুটি হওয়ার পরই শ্রমিকরা অন্দোলনকারী শ্রমিকদের সাথে যোগ দেয়। শ্রমিকরা বিক্ষিপ্তভাবে সড়কে গাছ ফেলে ও টায়ার জ্বালিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। বন্ধ হয়ে যায় সড়কে যান চলাচল। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে একাধিক জায়গায়। শ্রমিকরা পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গলিতে ঢুকে চোরাগুপ্তা হামলা করতে থাকে। এ সংঘর্ষে কমপক্ষে ৪০-৪৫ শ্রমিক আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। আহতদের স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। জানা যায় পুলিশি হয়রানীর কথা চিন্তা করে অনেক শ্রমিক চিকিৎসার জন্য ঢাকার হাসপাতালে চলে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েক প্লাটুন অতিরিক্ত পুলিশ যোগ দেয় অভিযানে। তারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বাইপাস সড়কের ভিতরে ঢুকে শ্রমিকদের বিক্ষোভ দমন করতে শুরু করে। দুপুরে সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। বিকেলের দিকে পরিস্থিতি পুরো নিয়ন্ত্রণে আছে বলে পুলিশ দাবি করেন। তবে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে যে কোন বড় ধরনের বিক্ষোভ হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে। এদিকে পুলিশের কাজে বাধা দেয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করার অভিযোগে পুলিশ বিকেলে নাসা গ্লোবাল লিমিটেডের রতন মিয়া (২৪) ও স্টার লিংক গার্মেন্টস এর আবুল হোসেন নামে দুই শ্রমিককে আটক করে।
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক জানান, পুলিশের লোকবল কম থাকায় ব্যাপকহারে এ শ্রমিক অসন্তোষ প্রথম দিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়েছে। তবে পরিস্থিতি বর্তমানে শান্ত রয়েছে। যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশকে সতর্ক রাখা হয়েছে।
আশুলিয়া থানার ইন্সপেক্টর অব ইনচার্জ (ওসি) সিরাজুল ইসলাম বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ফাকা গুলীবর্ষণ করলেও গুলীতে শ্রমিক আহতের ঘটনা আমার জানা নেই। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।