চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারাও এ ব্যাপারে তৎপরতা শুরু করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে রদবদলের ঘোষণা দিয়েছেন। এ পর্যায়ে মেয়রের পর মহানগর কমিটির সভাপতির পদটি হারাতে হতে পারে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে। তাকে স্বেচ্ছায় সাংগঠনিক পদ ছাড়ার আহ্বান জানানো হবে। ২০০৬ সালের ২৬ জুন দলের কাউন্সিলে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। তবে এখন পর্যন্ত ৭১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেননি তিনি। অনেকটা কাগজে-কলমে রয়ে গেছে কমিটি। এক সপ্তাহের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার কথা থাকলেও ১৮ জনের একটি কমিটি করা হয়েছিল। যার অধিকাংশ সদস্যই শারীরিকভাবে অসুস্থ বা নিজ নিজ অবস্থানে ব্যস্ত। এছাড়া রয়েছে গ্রুপিং-লবিং। আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আতাউর রহমান খান কায়সার গতকাল শনিবার সমকালকে জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে রদবদল প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ রদবদলের আগে চোখের ভাষায় এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে জানিয়ে দেওয়া হবে, ‘দয়া করে দলের পদ
ছাড়ূন।’
আতাউর রহমান খান কায়সার বলেছেন, কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্বে রদবদল হতে পারে। তিনি এসব বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলবেন। কায়সার এখন চট্টগ্রামে অবস্থান করছেন। ঢাকায় আসবেন সোমবার। তার মতে, নির্বাচনে পরাজয়ের দায়ভার এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকেই নিতে হবে। তার দম্ভই কাল হয়েছে।
আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেছেন, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগকে ঢেলে সাজানো হবে। এ নিয়ে দলের মধ্যে প্রাথমিক আলাপ-আলোচনাও হয়েছে। এ ব্যাপারে কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়া হবে। কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য আমিনুল ইসলাম আমিন জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সার্জারি অবশ্যম্ভাবী।
চট্টগ্রাম-৮ আসনের সাংসদ ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি নুরুল ইসলাম বিএসসি কোনো রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর লজ্জা-শরম নেই। লজ্জা থাকলে নির্বাচনের পরের দিনই তিনি দলের পদ-পদবি ছেড়ে দিতেন। কিন্তু তিনি স্বেচ্ছায় তা করবেন না। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে চাপ দিয়ে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করাতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমি শারীরিকভাবে অযোগ্য কিংবা অসুস্থ নই_ এটাই হয়তো আমার অযোগ্যতা। যে কারণে প্রথম সহ-সভাপতি বা সংগঠনের দ্বিতীয় ব্যক্তি হতে পারিনি।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ বলতে বোঝায় মহিউদ্দিন চৌধুরী ও কাজী এনামুল হক দানু। মহিউদ্দিনের বিশ্বস্ত, নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক দানু ছিলেন মহিউদ্দিনের ছায়া। নির্বাচনের কয়েকদিন আগে নাগরিক কমিটি ও দল নিয়ে মহিউদ্দিনের সঙ্গে মতদ্বৈধতা হলে তিনি দূরে সরে যান। কমিটির ব্যাপারে তিনি দাবি করেন, ২০০৬ সালের ২৭ জুন কমিটি হওয়ার পর তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি সভাপতি মহিউদ্দিনের কাছে দিয়েছিলেন। কিন্তু মহিউদ্দিন তা প্রকাশ করেননি। ঢাকাতেও পাঠাননি।
এনামুল হক দানু বলেছেন, নেতৃত্বে রদবদল জরুরি হয়ে পড়েছে। নতুন-প্রবীণের সমন্বয়ে সংগঠনকে নতুন করে সাজাতে হবে। এ নিয়ে তারা আজকালের মধ্যেই বৈঠকে বসবেন।
এ কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছেন, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অগণতান্ত্রিক ও অসাংগঠনিক আচরণের কারণে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তাই সংগঠনকে বাঁচাতে নির্বাচনী বিপর্যয় মেনে নিয়ে দলের পদ-পদবি থেকে মহিউদ্দিন চৌধুরীর সরে যাওয়া উচিত।
বহুধাবিভক্ত আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই চার বছর ধরে। এ কারণে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ভূমিকা প্রাণবন্ত ও আন্তরিক ছিল না। ওয়ার্ড কমিটিগুলো সক্রিয় না থাকায় একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেন।
মহানগর কমিটির ১৮ সদস্যের বেশিরভাগই মহিউদ্দিনের পছন্দের লোক, যারা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সভা-সমিতিতে প্রায়ই অনুপস্থিত থাকেন। অন্যরা মহিউদ্দিনকে বাইরে রেখে সভা-সমাবেশ করেন। মহিউদ্দিনের অপছন্দের ব্যক্তি নুরুল ইসলাম বিএসসি। বিএসসি আবার ১৮ জনের কমিটির সহ-সভাপতি। তিনি তার নিজস্ব পদ্ধতিতে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করেন।
তবে চট্টগ্রাম মহানগর কমিটি নিয়ে শনিবার পর্যন্ত দলের ভেতরে আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক হয়নি। কেন্দ্রীয় নেতারা বিক্ষিপ্ত আলাপচারিতায় চট্টগ্রামের নির্বাচন মূল্যায়ন করছেন। এক্ষেত্রে অধিকাংশই পরাজয়ের জন্য কেবল এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকেই দুষছেন। একই সঙ্গে তারা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগকে মহিউদ্দিনের প্রভাবমুক্ত করার বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় নেতারা বলেছেন, নির্বাচনের ফল নিয়ে নেতাকর্মীদের জড়তা কাটার পর চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগে সার্জারি চালানো হবে। কেননা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী নিজেই প্রার্থিতা ঘোষণা করে শেখ হাসিনাকে জিম্মি করেছেন। দল পরিচালনায় যা খুশি তাই করেছেন। এ অবস্থা আর মেনে নেওয়া হবে না।
অবশ্য মহিউদ্দিন চৌধুরীকে মাইনাস করার পক্ষেও নন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তারা তাকে দলের উপদেষ্টা পরিষদে রাখার জন্য দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রস্তাব দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। উপদেষ্টা পরিষদ এখনও পূর্ণতা না পাওয়ায় ওই পদে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে রাখার সুযোগ রয়েছে। কেউ কেউ তাকে টেকনোক্রেট মন্ত্রী করারও প্রস্তাব দেবেন বলে জানিয়েছেন।
মহিউদ্দিনের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই
চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে নগর আওয়ামী লীগকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করান জহুর আহমদ চৌধুরী ও এমএ মান্নান। দু’জনেই এখন মৃত। তাদের জীবিতকালে চট্টগ্রামের প্রগতিশীল রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এগিয়ে ছিল বহুদূর। দলের দুঃসময়ের যে কোনো সভা-সমাবেশে আওয়ামী লীগের অগ্রণী ভূমিকা নজরে পড়ার মতো। এমএ মান্নান নগর আওয়ামী লীগের সভাপতিকালে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ২০০৬ সালের ২৭ জুন নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে মেয়রের প্রভাব বিস্তার করে এমএ মান্নানকে সরিয়ে সভাপতি হন মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বেছে নেন তার পছন্দের মানুষ এনামুল হক দানুকে।
কমিটির ১৮ জন
নগর মহানগর কমিটির নয়জন সহ-সভাপতি হলেন যথাক্রমে আবুল কালাম সওদাগর, ডা. সৈয়দুর রহমান, বেলায়েত হোসেন, নুরুল ইসলাম বিএসসি, মাহতাব উদ্দিন, সেকান্দর হায়াত খান, আবু তালেব, অ্যাডভোকেট সুনীল ও নঈম উদ্দিন। তিন যুগ্ম সম্পাদক হলেন অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, ডা. আফসারুল আমিন ও খোরশেদ আলম সুজন। কোষাধ্যক্ষ হলেন মোঃ আবদুস সালাম এবং তিন সাংগঠনিক সম্পাদক হচ্ছেন রেজাউল করিম চৌধুরী, মোঃ বদিউল আলম ও আবদুর রশিদী।
বর্তমানে তাদের অবস্থা
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মহানগর কমিটির নয়জন সহ-সভাপতির মধ্যে অধিকাংশই শারীরিকভাবে অক্ষম। কমিটির সহ-সভাপতি আবুল কালাম সওদাগর দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে বিছানায় রয়েছেন। অভিন্ন অবস্থা অপর সহ-সভাপতি মাহতাব উদ্দিনেরও। অন্যদিকে শারীরিক অক্ষমতার কারণে ঘর থেকে বের হতে পারেন না ডা. ছৈয়দুর রহমান। সহ-সভাপতি নঈম উদ্দিনও হৃদরোগী। নানা রোগে আক্রান্ত আবু তালেবও নিষ্ক্রিয়। এ দুই সহ-সভাপতিকে মাঝেমধ্যে কমিটির নির্ধারিত সভায় দেখা গেলেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে মাঠ পর্যায়ে কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারেন না। অসুস্থতার কারণে দলীয় কার্যক্রম থেকে দূরে রয়েছেন সেকান্দর হায়াত খানও। দলের কর্মসূচিতে নিয়মিত নন অ্যাডভোকেট সুনীল। বেলায়েত হোসেন মোটামুটি সক্রিয় থাকলেও তার স্ত্রী-পুত্র জামায়াতপন্থি বলে অভিযোগ রয়েছে। কমিটির চার নম্বর সহ-সভাপতি নুরুল ইসলাম বিএসসি তৎপর থাকলেও কোন্দলের কারণে সামনে আসতে পারছেন না।
তিন যুগ্ম সম্পাদকের মধ্যে ইব্রাহিম হোসেন বাবুল তার আইন পেশা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। খোরশেদ আলম সুজন সাবেক মেয়র মহিউদ্দিনের হজ কাফেলা নিয়ে ব্যস্ত। ডা. আফসারুল আমিন মন্ত্রী হওয়ার কারণে নগর রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে থাকতে পারেন না। তিন সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যে রেজাউল করিম আবার নুরুল ইসলাম বিএসসির পক্ষের লোক, বদিউল আলম অসুস্থ, আবদুর রশিদও নানা সমস্যায় বলে জানা গেছে।
সহ-সভাপতি প্রসঙ্গে কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী এনামুল হক দানু বলেছেন, ‘অনেক কর্মকর্তাই বয়সে প্রবীণ ও কঠিন রোগে ভুগছেন_ এ কথা ঠিক। তবে এক সময় দলের কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তারা। তাদের সম্মান দেখাতে কমিটিতে রাখা হয়েছে।’
সমন্বয় নেই
আওয়ামী লীগে এখন দুটি গ্রুপ। একটি সাবেক মেয়র মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে, অপরটির নেতৃত্বে রয়েছেন সাংসদ নুরুল ইসলাম বিএসসি। এ দুটি গ্রুপ এক হলে নগর আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হবে। নগর আওয়ামী লীগের হাল ধরার জন্য অনেকে তৎপর।
ওয়ার্ড কমিটিগুলোতে নানা গ্রুপিং
নগর কমিটি দু’ভাগে বিভক্ত হলেও ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নতুনভাবে আওয়ামী লীগ নেতা আজম নাসিরের একটি গ্রুপও বিভিন্ন ওয়ার্ডে সক্রিয় থাকতে দেখা যায়। ফলে নির্বাচনে একেকটি ওয়ার্ড থেকে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর প্রার্থী হয়েছেন ৫ থেকে ৭ জন পর্যন্ত।