মৃত্যু-বিলাপ-শোকে বিহ্বল ঢাকা। পুরান ঢাকার নিমতলী থেকে দক্ষিণে মিটফোর্ড হাসপাতাল, উত্তরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পশ্চিমে হোসেনি দালান থেকে আজিমপুর কবরস্থান— পুরোটাই যেন এক শোকবলয়। বৃহস্পতিবার রাতে লাগা ভয়াবহ আগুনে নিমতলীর চার ভবনে ১১৭ জনের অভাবিত মৃত্যু হয়েছে। একটি ভবনেই বিয়ের অতিথিসহ ৪১ জন মর্মান্তিকভাবে মারা গেছে। মর্মন্তুদ এই ঘটনায় শুধু স্বজনহারা ব্যক্তিরাই কাঁদছে না, কাঁদছে ঢাকা, শোকার্ত পুরো বাংলাদেশ।
প্রাথমিকভাবে বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ আগুন লাগার কারণ বলা হলেও ফায়ার সার্ভিস বলছে, ৪৩/১ নবাব কাটরার সেই ভবনটির লাগোয়া বিদ্যুতের দুটি ট্রান্সফরমারের একটিও বিস্ফোরিত হয়নি। তাদের ধারণা, ভবনটির সামনে রাস্তায় ট্রান্সফরমারের ঠিক নিচে বিয়ের অনুষ্ঠানের রান্না হচ্ছিল। সেখান থেকেও আগুনের সূত্রপাত হতে পারে, যা ভবনের নিচতলার রাসায়নিক গুদামে লেগে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। মূলত রাসায়নিকের কারণেই বৃষ্টিভেজা রাস্তা আর ঘরবাড়িগুলোও আগুনে জ্বলেছে দাউদাউ করে।
দমকল বিভাগের কর্মীরা বলছেন, মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়া আগুন, রাসায়নিকের দম আটকানো গন্ধ, আর অপ্রশস্ত সিঁড়ির কারণে বেশির ভাগ মানুষ ঘর ছেড়ে বের হওয়ারই সময় পায়নি। তাদের বেশির ভাগ ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা গেছে। দগ্ধ ৩৯ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিএমএইচে চিকিৎসাধীন।
যে বাড়ি থেকে আগুনের সূত্রপাত, সেই গুলজারের বাড়ি থেকেই ৪১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বাড়িটির নিচতলায় ছিল রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম। এ ছাড়া আগুনে আরও পুড়ে গেছে সাতটি বাড়ি এবং এগুলোর নিচতলার গুদাম ও দোকান। পুড়ে যাওয়ার তালিকায় আছে চা-সিগারেটের দোকান, বিস্কুটের কারখানা, বাখরখানির কারখানা, তিনটি পুরোনো কাগজের দোকান, সেলুন, রেস্তোরাঁ, ডেকোরেটর ও ফলের দোকান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুন লাগার পর ওই বাড়ি থেকে লাভার মতো বস্তু আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ‘লাভা’ যেখানেই গেছে, সেখানেই পুড়ে গেছে সবকিছু। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘টিভিতে লাভা দেখছি, আগুনটা ছিল হেই রকম। যেইখানে এইডা পড়ছে, হেইখানেই আগুন লাগছে।’
গতকালও সরেজমিনে দেখা যায়, রাস্তার ওপর এক থেকে দুই ইঞ্চি পুরু কালো রাসায়নিক দ্রব্যের থকথকে কাদা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে পোড়া মোটরসাইকেলের কাঠামো, রিকশার চাকা, জুতা ও তৈজসপত্র।
বৃহস্পতিবার রাতেই ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় এক শর বেশি মৃতদেহ। সকালে বিভিন্ন বাড়ির সামনের নালা, দোকানের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় আরও সাতটি মৃতদেহ।
যেভাবে সূত্রপাত: আগুন লাগা ভবনের উল্টো দিকে দোতলা ভবন থেকে সবকিছু দেখছিলেন আরমান মিয়া। তিনি বলেন, গুদাম থেকে আগ্নেয়গিরির লাভার মতো তরল বস্তু রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল আগুন নিয়ে।
পাশে একটি মুদির দোকানে বসে ছিলেন কর্মী রাজ্জাক ও রানা। রাজ্জাক বলেন, ‘মনে হইতাছিল, আতশবাড়ির মতো গোলা তৈরি হইতাছে। ঝাইড়া দিলাম দৌড়। ইংলিশ সিনেমার মতো আগুন পিছে পিছে দৌড়াইতাছিল।’ স্থানীয় যুবক আরিফ জানান, তাঁরা বালুর বস্তা দিয়ে সেই লাভার গতিরোধ করেন।
হাওয়ায় জ্বলছে আগুন!: আগুন নেভাতে প্রথমে এসেছিল ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তর থেকে দুটি ইউনিট। সেই ইউনিটের প্রধান দমকল বাহিনীর উপপরিচালক আবদুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যখন আসি, তখন দেখি রাস্তা থেকে পাঁচতলা বাড়ি গ্রাস করে নিয়েছে আগুনের শিখা। কী জ্বলছে বুঝতে পারছি না, যেন হাওয়ায় আগুন জ্বলছিল। লোকজন আমাদের ধাক্কাতে থাকে সামনে যাওয়ার জন্য। আমরা সামনে যেতে পারি না। লোকজন উত্তেজিত হয়। পানি দিতে থাকি। কিছু আগুন নিভলে আমরা সামনে যাই।’
৫০ নম্বর নিমতলীর পাঁচতলার বাসিন্দা ডাকসুর কর্মচারী বাবু সরকার বলেন, ‘হঠাৎ বিকট শব্দ। তার পরই দেখি, চারদিকে আগুনের গোলা পড়তাছে। গলির ভেতরে আগুন ঢুকতাছে জলোচ্ছ্বাসের মতো। পুরা রাস্তা থাইকা শুরু কইরা ছাদ পর্যন্ত আগুন জ্বলতাছে হাওয়ার উপরে।’
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক আবু নাঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, আগুন লাগার তিনটি সম্ভাব্য সূত্র হচ্ছে বাড়ির নিচতলার রাসায়নিকের গুদাম, সামনের দুটি ট্রান্সফরমার আর বিয়ের অনুষ্ঠানের রান্নার চুলা। তবে মূল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে রাসায়নিক দ্রব্য থেকে।
এ ভবনে ৪১ জনের লাশ: পাঁচতলা বাড়িটিতে পরিবারসহ থাকতেন মালিক তিন ভাই—গুলজার, দিদার ও ফারুক। আগুনে তিনটি পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই মারা গেছেন। গুলজারের দুই ছেলে ও স্ত্রী, দিদারের ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী, ফারুকের দুই মেয়ে ও স্ত্রী—কেউ বেঁচে নেই। ওই বাড়ির তৃতীয় তলায় ছিল একটি ভাড়াটে পরিবার। তাদের মেয়ের বাগদানের অনুষ্ঠানে বরপক্ষের ১৫ জন এসেছিলেন, বাকিরা ছিলেন রাস্তায়। এঁদের অনেকের লাশ পাওয়া গেছে। বর-কনে বাইরে থাকায় বেঁচে গেছেন।
আশপাশের পুড়ে যাওয়া আরও সাত বাড়ির কোনোটি থেকে ১১ জন, কোনোটি থেকে সাতজন, কোনোটি থেকে চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
বাচ্চাটি আঁকড়ে ধরে আছেন মা: ১০ মাসের সন্তান রাব্বিকে রক্ষা করতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন মা লাভলী বেগম। আগুনের গোলা থেকে বাঁচাতে সন্তানকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে ছুটে বের হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। কারণ বাইরে আগুন, রাস্তা পর্যন্ত জ্বলছিল। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সামনের নর্দমা থেকে যখন তাঁকে উদ্ধার করা হয় তখন দেখা গেল, বাচ্চাটি আঁকড়ে ধরে আছেন তিনি।
এত মৃত্যুর কারণ ধোঁয়া: ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আবদুর রশীদ বলেন, রাসায়নিক দ্রব্য থেকে সৃষ্ট এই আগুনের ধোঁয়া ছিল ভয়াবহ গাঢ়। ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা গেছে বেশির ভাগ মানুষ। আগুনের তাপও ছিল বেশি। বাড়িগুলোতে ধোঁয়া বের হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পথও ছিল না। ফলে দম বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে বেশির ভাগ মানুষের।
লাশের খোঁজে: আগুন কিছুটা নিভে আসার পর স্বজনের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে হাজারো মানুষ। রাস্তায় রাখা লাশের স্তূপে, পুড়ে যাওয়া বাড়ি, হাসপাতাল, মর্গ—সব জায়গায় স্বজনের খোঁজে মরিয়া ছিল স্বজনেরা। পুড়ে যাওয়া বাড়িগুলো থেকে ৫১টি লাশ উদ্ধার করে রাখা হয় নবাব কাটরা ছাতা মসজিদের সামনের সড়কে। স্বজনের খোঁজে আসা মানুষ লাশ বহনকারী ব্যাগের চেইন খুলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া মুখ দেখেই চিৎকার করে উঠছিলেন। কেউ বা জড়িয়ে ধরছিলেন পাশের জনকে।
একটি একটি করে ব্যাগের চেইন খুলে চেহারা দেখে, শরীরের অলংকার, পোশাকের ধরন, দাঁত ইত্যাদি দেখে শনাক্ত করার চেষ্টা করছিলেন স্বজনেরা। কেউ কেউ ফোন করে জিজ্ঞেস করেন অন্য স্বজনদের। ‘মুক্তাদিরের কোমরে কি চেইন ছিল?’, ‘আম্মা কি শাড়ি পরছিল?’
কান্নার রোল: সকাল থেকে ঘটনাস্থলে মৃতের স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। স্বজনদের কান্না দেখে অনেকেই আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। দুপুরের দিকে স্বজনহারানো একজনকে উদভ্রান্তের মতো হেঁটে হেঁটে বিলাপ করতে দেখা যায়।
আগুন লাগা মূল ভবনটির সামনের ভবনে থাকতেন মুন্নী বেগম ও তাঁর পরিবার। মুন্নী, তাঁর মেয়ে লাভলী ও লাভলীর ১০ মাস বয়সী বাচ্চা রাব্বি আর মুন্নীর খালা রমিজা বেগম—কেউ বেঁচে নেই। মুন্নী বেগমের ছেলে রিপন মিয়া রাতেই তাঁর মা আর খালার লাশ পেয়েছিলেন। সকালে পান বোন আর ভাগ্নের লাশ। রিপনের হাউমাউ কান্না দেখে চোখের পানি মুছছিলেন অনেকে।
সকাল ১০টার দিকে সেরাজুল ইসলাম মোল্লা নামের এক ব্যক্তি ‘ভাই, ভাই’ বলে চিৎকার করছিলেন। চার ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ভাই রহিম মোল্লাকে না পেয়ে সকাল থেকে এখানে-ওখানে ছোটাছুটি করছিলেন সেরাজুল। পরে তাঁদের চাল-ডালের দোকানের ভেতরে পাওয়া যায় রহিমকে। তবে প্রাণহীন। চালের বস্তা সরিয়ে নিথর রহিমকে যখন বের করে আনা হলো, তখন সেরাজুল প্রায় অজ্ঞান।
মায়ের ছবি নিয়ে সকাল থেকেই পাগলের মতো ঘুরছিলেন গোলাম হোসেন। পরিবারের পাঁচ সদস্যের মধ্যে তিনজনের মৃতদেহ পাওয়া গেলেও তাঁর মা-বোনের কোনো হদিস তখনো মেলেনি। এক আত্মীয়ের বাসায় তাঁর মায়ের একটি ছবি ছিল। সেই ছবিটি দমকল বাহিনীর লোকদের বারবার তিনি দেখাচ্ছিলেন, তাঁর মাকে কেউ দেখেছেন কি না। গোলাম হোসেন শুধু হাঁটছেন আর কাঁদছেন।
বাচ্চু মিয়ার পরিবারের আট সদস্যের মধ্যে এখন আছেন শুধু দুই ভাই—জীবন আর জুয়েল। নামাজ আদায় করতে গিয়ে বেঁচে গেছেন তাঁরা। বাবা-মা, ভাই-বোন হারিয়ে এখন পাগলপ্রায় দুই ভাই। একই বাড়িতে বসবাসকারী চার ভাড়াটেও জীবন হারিয়েছেন এ ঘটনায়।
‘ভাগ্যবতী’ এক শাহানূরের কথা: শাহানূর বেগমের বাড়ির সব আসবাব, টাকা-পয়সা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শাহানূর বেগমকে ভাগ্যবতীই বলতে হয়। কারণ, ঘরে ছিল দুই শিশুসন্তান, জায়ের ছেলে আর ননদ। এদের সবাই অক্ষত অবস্থায় বেঁচে গেছে।
আগুন ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাটি দেখতে পেয়েছিলেন শাহানূর। প্রথম আলোকে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘ননদকে নিয়ে চারতলায় বসে কথা বলছি। হঠাৎ দেখলাম, জানালা দিয়ে আগুন আসছে। ননদ বেবি আপাকে বললাম, তাড়াতাড়ি নামেন। এরপর আমার দুই মেয়ে আর জায়ের এক ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে নেমে আসলাম। কিন্তু নিচতলায় নেমে দেখি, ওপর থেকে আগুন আসছে, নিচেও আগুন। গেট খুলে দেখি নিচে হাঁটু পর্যন্ত লাভার মতো বস্তু বয়ে যাচ্ছে।’
শাহানূর বলতে থাকেন, ‘গেট খুললেই ভেতরে আগুন চলে আসে। তখন দূরে ভাগনেদের দেখতে পেলাম। চিৎকার দিয়ে বললাম, আমার বাচ্চাদের বাঁচাও। তাঁরা পাশের বাড়ির টিনের ফটক ভেঙে এদিকে ফেলল। কিন্তু লাভার উত্তাপে সেই টিনে পা ফেলার জো নেই। পরে টিনের ওপরে চটের বস্তা আর পর্দা ফেলে কোনো রকমে পার হই।’