পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার সাঁইথিয়া রেলস্টেশনে যাত্রীবাহী দুটি ট্রেনের সংঘর্ষে ৬৭ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে কমপক্ষে ১৪৮ জন। গতকাল সোমবার ভোরে স্টেশন ছাড়ার অপেক্ষায় থাকা একটি ট্রেনকে পেছন থেকে অপর একটি দ্রুতগামী যাত্রীবাহী ট্রেন ধাক্কা দিলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। পরে কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, কলকাতা থেকে ১২৫ মাইল উত্তরে সাঁইথিয়া স্টেশনে বনাঞ্চল এক্সপ্রেস ট্রেনটি ছাড়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। এ সময় উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস ট্রেনটি পেছন থেকে এসে ধাক্কা দেয়। উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস ট্রেনটি কলকাতায় যাচ্ছিল। আর বনাঞ্চল এক্সপ্রেস যাচ্ছিল ঝাড়খন্ডের রাজধানী রাঁচি। সংঘর্ষে বনাঞ্চল এক্সপ্রেসের দুটি যাত্রীবাহী ও একটি মালবাহী কামরা দুমড়েমুচড়ে যায়। দুটি বগি স্টেশনের ওভারব্রিজের ওপরে উঠে যায়। এতে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসের দুই চালক ও বনাঞ্চল এক্সপ্রেসের গার্ড ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এ ছাড়া আরও ৬৫ জন যাত্রী নিহত ও ১৪৮ জন আহত হয়। গ্যাস-কাটার দিয়ে ট্রেনের বগি কেটে দুুমড়েমুচড়ে যাওয়া কামরার ভেতরে আটকে পড়া হতাহত লোকজনকে উদ্ধার করা হয়। তাদের স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়।
পশ্চিমবঙ্গের ত্রাণমন্ত্রী মুর্তাজা হুসেইন দুর্ঘটনায় ৫৭ জন নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন। তবে অন্যান্য সূত্র মৃতের সংখ্যা ৬৭ জন বলে জানায়।
গতকাল দুপুরে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সাংবাদিকদের বলেন, দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দেন। তিনি নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে পাঁচ লাখ ও পরিবারের একজনকে রেলে চাকরি এবং গুরুতর আহত প্রতি পরিবারকে এক লাখ রুপি ও অন্যান্য আহত ব্যক্তিকে ২৫ হাজার রুপি দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করেন। এদিকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার নিহত পরিবারপিছু তিন লাখ রুপি এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করার ঘোষণা দিয়েছে। মমতা পরে আহতদের দেখতে সিউরি হাসপাতালে যান।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দুর্ঘটনার তিন ঘণ্টা পর উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। এর আগে তাঁরা নিজেরাই হতাহতদের উদ্ধার করতে থাকেন। তবে পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির স্থানীয় বাসিন্দাদের এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, দুর্ঘটনার এক ঘণ্টার মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধারকাজ শুরু করা হয়। সেনাবাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী, পুলিশ ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় উদ্ধার তৎপরতা চালায়।
পশ্চিমবঙ্গের পুলিশের মহানির্দেশক ভূপিন্দর সিং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, দুর্ঘটনার সঙ্গে নাশকতার কোনো প্রমাণ তাঁরা পাননি। তবে দুর্ঘটনার পেছনে নাশকতা ছিল কি না তা পুলিশ খতিয়ে দেখছে। কর্মকর্তাদের ধারণা, উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস ট্রেনটি যখন স্টেশনে ঢুকছিল, তখন এর চালক তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলেন। কারণ ট্রেনটি তখন অতি দ্রুতগতিতে চলছিল এবং চালক সিগনাল মানেননি।
সংশ্লিষ্ট অনেকেই জানান, ভোরের দিকে যাত্রীরা ঘুমিয়ে থাকার কারণে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে। ট্রেনের একজন যাত্রী বলেন, ‘আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ ও ঝাঁকুনিতে আসন থেকে কামরার মেঝেতে পড়ে যাই। লোকজনের আর্তচিৎকার শুনতে পাই। সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।’ রজনী ধর নামের একজন যাত্রী বলেন, ‘প্রচণ্ড শব্দে আমি অচেতন হয়ে পড়ি। পরে উদ্ধারকারীরা আমাকে কামরার ভেতর থেকে টেনে বের করেন।’
বিরোধী দল বিজেপি এই দুর্ঘটনার জন্য রেলকে দায়ী করেছে। এদিকে গতকাল পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় এই ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য মমতাকে দায়ী করে অবিলম্বে তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছেন বাম বিধায়কেরা।
পশ্চিমবঙ্গে গত দুই মাসের মধ্যে এটি দ্বিতীয় ভয়াবহ রেল-দুর্ঘটনা। গত ২৭ মে গভীর রাতে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রামে মুম্বাইগামী জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনায় ১৪৫ জন নিহত হয়েছিল। কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, ওই দুর্ঘটনা ছিল মাওবাদীদের নাশকতা।
প্রথম আলো