ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার সিংরইল মধ্য নগর গ্রামের রিকশাচালক উজ্জ্বল মিয়া ওরফে অর্জুন । তার ঘরে দু’টি শিশুকন্যা থাকার পর আশা করেছিলেন একটি পুত্র সন্তানের। গত ২৪ নভেম্বর তার স্ত্রী জন্ম দেন তৃতীয় সন্তান। সেটিও মেয়ে। মন খারাপ হয়ে যায় অর্জুনের। সন্তান জন্ম দেওয়ার দু’দিন পরই মারা যায় তার স্ত্রী রেহেনা বেগম। দীর্ঘ দিন ধরে অপুষ্টিতে ভুগছিলেন তিনি। একদিকে অভাবের সংসারে ঘরে দুই মেয়ে থাকার পর আবারও কন্যা শিশুর জন্ম, এরই মধ্যে স্ত্রীর মৃত্যু। অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। নিকটাত্মিয়রা বাচিঁয়ে রাখার চেষ্টা করে দুই দিনের শিশুটিকে। অনামিকা নামে ওই শিশুটির বয়স এখন ৩ মাস। মাস খানেক আগের কথা।

কিশোরগঞ্জ শহরে রিকশা চালাচ্ছিলেন অর্জুন। যাত্রী আমেরিকার নাগরিক একটি বেসরকারি সংস্থার স্বেচ্ছাসেবি কর্মকর্তা কার্ল জেইস। আমেরিকার ক্যালিফোর্ণিয়ার বাসিন্দা জেইস আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থা ক্রিশ্চিয়ান সার্ভেস ইন্টারন্যাশনালে সেচ্ছাসেবি প্রকল্প পরিচালক হিসাবে বাংলাদেশে কাজ করছেন। তার স্ত্রী জুডিথও একই প্রকল্পের স্বেচ্ছাসেবি কর্মকর্তা। তাদের দুই কন্যা লিয়েনা (৯), এলিসিয়া (৮) ও পুত্র এন্ড্রকে নিয়ে থাকেন কিশোরগঞ্জ শহরের শোলাকিয়া বনানী মোড় এলাকায়। ভাঙাভাঙা শব্দে দু’একটা বাংলা বাক্য বলতে পারেন কার্ল জেইস। রিকশায় চড়তে চড়তে তিনি চালকের কুশলাদি জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন অর্জুন মিয়ার কষ্টের কথা। পরদিন অর্জুন মিয়া তার ৩ মাসের শিশুকে নিয়ে আসেন তার কাছে। শিশুটিকে দেখে জড়িয়ে ধরে আদর করেন কার্ল জেইস ও তার স্ত্রী জুডিথ।

অর্জুনের কাছে প্রস্তাব করেন, তিনি রাজি থাকলে শিশুটিকে দত্তক নিতে চান তারা। মা-হারা সন্তানকে নিয়ে অনেকটা বিপাকেই পড়েছিলেন অর্জুন। তার শিশু সন্তান ভালো পরিবেশে থাকবে। স্বপ্নের দেশ আমেরিকার আলোবাতাসে বেড়ে উঠবে তার সন্তান! নিঃশর্তে রাজি হয়ে যান তিনি। আনন্দের ঝিলিক দেখা দেয় আমেরিকান ওই দম্পতির চোখেমুখে। পরম মমতায় শিশুটিকে মায়ের স্নেহ দিয়ে লালন-পালন করতে থাকেন জুডিথ। অবশেষে আদালতের মাধ্যমে শিশুটিকে দত্তক নেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করেন তারা। বৃহস্পতিবার কিশোরগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মালিক আব্দুল্লাহ আল-আমিন মিস কেইসের মাধ্যমে শিশুটিকে আমেরিকান দম্পতির হাতে তোলে দেন। এর আগে শিশু অনামিকার বাবা অর্জুন মিয়া আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে নিঃশর্তভাবে তার সন্তানকে দত্তক দেওয়ার ঘোষণা দেন।

শিশুটির বাবা এ প্রতিবেদকে জানান, অভাবের সংসারে দু’টি ছোট ছোট কন্যা সন্তানকে নিয়ে অতি কষ্টে জীবনযাপন করছিলাম। কিন্তু আমাদের ইচ্ছা ছিল একটি পুত্র সন্তানের। তাই তৃতীয়বার সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু, এবারও কন্যা শিশু জন্ম নেয়। স্ত্রীর মৃত্যুতে মাত্র দুই দিনের শিশুকে নিয়ে বিপাকে পড়ি। এ অবস্থায় আমেরিকার স্যারের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় সুখে থাকবে এর চেয়ে বেশি আনন্দের আর কী হতে পারে?’ এ সময় তার মন ছিল ভারাক্রান্ত। শেষবারের মতো দত্তক দেওয়া নিজের সন্তানকে আদর করছিলেন। আমেরিকান নাগরিক কার্ল জেইস ও জুডিথ অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমরা একটি অসহায় দরিদ্র পরিবারের শিশু সন্তানের বৈধ অভিভাবক হতে পেরে গর্বিত। এখন থেকে আমাদের চারটি সন্তান।

আমরা তাকে আদর দিয়ে বড় করে তুলবো। কার্ল জেইস জানিয়েছেন, আদালতসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সেরে আগামী ২ মে বাংলাদেশ থেকে দত্তক নেওয়া ৩ মাসের শিশু অনামিকাকে নিয়ে আমেরিকায় ফিরে যাবেন বলে ।