ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ লোক সাহিত্যের লীলাভূমি কিশোরগঞ্জ। ষোড়শ শতাব্দীর সাংষ্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত এ জেলা।  ঐতিহ্যবাহী কিশোরগঞ্জের ১৩ টি উপজেলার মধ্যে ৬টি উপজেলার ৯টি  পুরাকীর্তি সংরক্ষন করেছে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। সংরক্ষিত প্রত্নতত্ত্ব স্থলগুলো হলো অষ্টগ্রাম উপজেলা সদরের কুতুব মসজিদ, আওরঙ্গজেব মসজিদ, কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার কবি দ্বিজ বংশী দাস ও কবি চন্দ্রাবতীর স্মৃতি বিজড়িত মন্দির, করিমগঞ্জ উপজেলার মসনদ-ই- আলা ঈশা খাঁ” র স্মৃতি জড়িত  ‘জঙ্গলবাড়ি”, পাকুন্দিয়া  উপজেলার এগারসিন্দুরের  ‘শাদী মসজিদ” ও শাহ মাহমুদ মসজিদ, তাড়াইল উপজেলার  সাহেব বাড়ী (সেকান্দরনগর) মসজিদ ,নিকলী উপজেলার গুরুই মসজিদ ।

কুতুব মসজিদ: কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলা সদরের একটি প্রাচীন মসজিদ হলো কুতুব মসজিদ। মসজিদটি কুতুবশাহ নামক একজন দরবেশ নির্মাণ করেছিলেন। তাই একে কুতুব শাহ মসজিদ বলা হয়ে থাকে। মসজিদটি সুলতানী আমলে নির্মিত হয়েছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। মসজিদের ৫টি গম্বুজ রয়েছে। তন্মধ্যে মধ্যখানেরটি সবচাইতে বড় আকারের। ১৯০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটিকে সংরক্ষিত করেছে।

শাহ মাহমুদ মসজিদ: কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া  উপজেলার এসারসিন্দুর ইউনিয়নে শাহ মাহমুদ মসজিদের অবস্থান। এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি মুঘল আমলের নির্মিত হয়েছিল। তৎকালীন প্রখ্যাত পীর  শাহ মাহমুদ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। তাই এ কে শাহ মাহমুদ মসজিদ বলা হয়।

শাদী মসজিদ: কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া  উপজেলার এগারসিন্দুরের দ্বিতীয় মসজিদটি  ‘শাদী মসজিদ’ নামে পরিচিত। এটি দেশের অন্যতম সু-রক্ষিত মসজিদ। কেন্দ্রীয় মিহরাবের গায়ে সংযুক্ত একটি ফার্র্সি শিলালিপি থেকে জানা যায়, মোগল সম্রাট শাহজাহান-এর শাসন কালে জনৈক শাইখ শিরুর পুত্র শাদী ১০৬২ হিজরীতে (১৬৫২ খ্রি:) এই মসজিদ নির্মাণ করেন। বাইরে থেকে এক অষ্টকোণাকৃতি বলে মনে হবে। সামনের দিকে দেয়ালে এবং ভিতরে মিহরাবে পোড়ামাটির অলংকরণ দেখা যায়।

আওরঙ্গজেব মসজিদ: কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলা সদরের কাস্তল ইউনিয়নে অবস্থিত আওরঙ্গজেব মসজিদ। সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে (১০৮০হিজরী ১৬৬৯ খ্রি;) নির্মান করা হয়। লতাপাতায় মোড়ানো অতি অলঙ্করনে নির্মিত হয়েছে মসজিদটি। ১৯০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটিকে সংরক্ষিত করেছে । ছবিঃ নেই

সাহেব বাড়ী (সেকান্দরনগর) মসজিদ: কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলায় অবস্থিত সাহেব বাড়ী (সেকান্দরনগর) মসজিদ। আমিনুল হক সাদী উপস্থাপিত আলোকিত কিশোরগঞ্জের সাময়িকীতে উল্লেখ করা হয়েছে জেলার তাড়াইল উপজেলার ধলা  ইউনিয়নের ঐতিহাসিক সেকান্দরনগর সাহেব বাড়ীতে মসজিদটি অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে নির্মান করা হয়। তবে  স্থানীয়দের ধারনা মসজিদটি মুঘল আমলের তৈরী । এটি ১৯৯৯ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটিকে সংরক্ষিত করেছে।

গুরুই মসজিদ: কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার গুরুই নামক গ্রামে ঐতিহাসিক গুরুই মসজিদটি অবস্থিত। এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটিতে একটি শিলালিপি রয়েছে। যার ভাষ্যনুযায়ী মসজিদটি ৮৭১হিজরী ১৫৬৭ খ্রি:সনে নির্মান করা হয়। মসজিদের জোড়া কার্নিশ ও প্যারাপেট সরল রেখায়  নির্মিত। প্যারাপ্যাটের উপরিভাগে ব্যাটলম্যান্ট দ্বারা অলঙ্কৃত । এ মসজিদটি  ১৯০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটিকে সংরক্ষিত করেছে।

চন্দ্রাবতীর শিব মন্দির: কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ৫ কি.মি. পূর্ব-উত্তর দিকে মাইজখাপন ইউনিয়নের কাচারিপাড়া গ্রামে ফুলেশ্বরী নদীর তীরে এই মনোরম মন্দিরটি অবস্থিত। মধ্যযুগের প্রখ্যাত কবি চন্দ্রাবতীর তথা বাংলার প্রথম মহিলা কবি এই মন্দিরটি নির্মাণ করে ছিলেন। এই গ্রামেই চন্দ্রাবতীর জন্ম গ্রহন করেছিলেন। মন্দিরের দেয়ালে অসংখ্যা পোড়ামাটির অলংকরণ একে সুশোভিত করে তোলেছে। ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক এ মন্দির দেখতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুর দর্শণার্থীর আগমন ঘটে । ১৯৮৭ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মন্দিরটিকে সংরক্ষিত করেছে।

কবি দ্বিজবংশীদাস  মন্দির: কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ৫ কি.মি. পূর্ব-উত্তর দিকে তৎকালীন অখন্ড মহিনন্দ- মাইজখাপন ইউনিয় এক থাকাকালীন সময়ে মৃত ফুলেশ্বরী নদীর তীরে কবি দ্বিজবংশী দাস মন্দির অবস্থিত। মাইজখাপনের কাচারিপাড়া গ্রামে ফুলেশ্বরী   নদীর তীরে এই মনোরম মন্দিরটি কালের স্বাক্ষী হিসেবে দন্ডয়মান রয়েছে। মুঘল আমলের নির্মিত এই মন্দিরটির  দেয়ালে নানা পোড়ামাটির অলংকরণ একে অঅরও সুশোভিত করে তুলেছে। ১৯৮৭ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মন্দিরটিকে সংরক্ষিত করেছে।

ঈশা খাঁর স্মৃতি বিজড়িত জঙ্গলবাড়ি: কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ১০ কি.মি. উত্তর-পূর্ব দিকে করিমগঞ্জ উপজেলার নরসুন্দা নদীর তীরে বনজঙ্গল ঘেরা একটি স্থান ‘জঙ্গলবাড়ি” নামে পরিচিত। এ এলাকাটিই বারভুইয়া নেতা মসনদ-ই- আলা ঈশা খাঁ দ্বিতীয় রাজধানী ও দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করতেন । তবে বর্তমানে অবশিষ্ট আছে কেবল উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ইটের পাঁচিল দিয়ে ভাগ করা দু’টি চত্বর। স্থানীয়দের নিকট পাঁচিলটি ‘প্রাসাদ প্রাচীর” নামে পরিচিত। এর দক্ষিণ প্রান্তে একটি তোরণ আছে। তোরণটির সামেনে ‘করাচি” নামে পরিচিত একটি পূর্বমূখী একতালা ভবন আছে। এর উত্তরে একটি তিনগম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ আছে। তোরণের পিছনে ‘অন্দর মহল’ নামে এক তলা দক্ষিণ মুখী ভবন আছে । গোটা ইটের দেয়াল চুনকামসহ গথর লেপন দিয়ে ঢাকা। সম্পূর্ণ  নিরাবরণ । সামনে লম্বা একটি পুকুর আছে। মসজিদটির স্থাপত্যে মোগল প্রথাসিদ্ধ রীতির ছাপ রয়েছে।   ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ঈশা খাঁ’র স্মৃতি বিজড়িত জঙ্গলবাড়িকে সংরক্ষিত করে প্রত্নতত্ত্ব পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষনা করেছে।

এদিকে জেলার অন্যন্য পুরাকীর্তিগুলো অযত্ন অবহেলায় বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে জেলার ইতিহাস ঐতিহ্য মুছে যেতে বসেছে। স্থানীয় এলাকাবাসী  বিষয়টির প্রতি সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন। এ ব্রাপারে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও গবেষক ড. মোঃ আতাউর রহমান এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, কিশোরগঞ্জের ১৩ টি উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায়  ছড়িয়ে থাকা ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ৬টি উপজেলার ৯টি   পুরাকীর্তি সংরক্ষন করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, মসনদ-ই- আলা মহা বীর  ঈশা খাঁ’র স্মৃতি বিজড়িত   জঙ্গলবাড়িকে একটি যাদুঘর ও এগারসিন্ধুর দুর্গকে সংরক্ষিত করা হবে।

লিখেছেনঃ
আমিনুল হক সাদী,  কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি
ফোন # ০১৭২৪৯৯৪৫৮৫