কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলা থেকে ২ কিঃমিঃ পশ্চিমে ভাগলপুর দেওয়ান বাড়ী মসজিদের অবস্থান। মসজিদটি ১১০৫ হিজরী সনে দেওয়ান গৌউস খান প্রতিষ্ঠিত করেন।দেওয়ান গৌউস খান মোঘল আমলে এখানকার গভর্ণর ছিলেন। মসজিদের স্বীয় ৪১ শতাংশের ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত মসজিদটি ১৯২৫ সনে ভূমি ওয়াকফ ষ্ট্রেটে ভাগলপুর দেওয়ান বাড়ীর দেওয়ান সৈয়দ গোলাম মালেক ও দেওয়ান সৈয়দ কাসেম আলী দুভাই মিলে জমি দলিল ভিত্তিক ওয়াকফ করে দেন। আর বর্তমানে মসজিদের মুতাওয়াল্লী হিসেবে রয়েছেন দেওয়ান দেওয়ান সৈয়দ আলী সাজ্জাদ এবং মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি হলেন আলহাজ্ব মাওলনা আ, ফ, ম সাদীর উদ্দীন, সেক্রেটারী দেওয়ান সৈয়দ মসনদ আলী উরুফে খসরু। মসজিদটি বৃটিশ আমলের শেষ দিকে ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। পরবর্তীতে মসজিদটিকে পুনঃ সংস্কার কর হয়।

মসজিদের সামনের বারান্দাটি একটি আধুনিকায়ন এলাকার সর্বস্তরের মানুষের সন্মিলিত প্রচেষ্টায় নির্মাণ ব্যয় কার্য সম্পন্ন করেন, মসজিদের ইমাম কোয়ার্টার ও দেওয়াল প্রাচীর মসজিদ রিপিয়ারিং ভাগলপুর বিশিষ্ট শিল্পপতি আলহাজ্ব জহুরুল ইসলাম সাহেব সম্প্রসারণ করে দেন। মসজিদের বর্তমান মাসিক ব্যয় দেওয়ান বাড়ী ও ইসলাম পরিবার হতে বহন করা হচ্ছে। মসজিদটির নির্মাণশৈলী মোঘল ও সেন বংশীয় স্থাপত্যের স্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে। সুনিপুন সৌন্দর্য্যময় কারুকার্য চমৎকার। এ মসজিদটি এখনও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতায় আসেনি। ভাগলপুর দেওয়ান বাড়ীর ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির পশ্চিম দেয়ালে ৩ টি মেহরাব রয়েছে। মসজিদের পূর্বের দেয়ালে ৩ টি এবং উত্তর-দক্ষিনের দেয়ালে ২ টি দরজা রয়েছে। মসজিদের ৪ কোণে ৪ টি বড় কোণিক মিনার রয়েছে। মসজিদে ২ টি শিলালিপি রয়েছে।

২য় শিলালিপির বিবরণঃ

আরবী ও ফার্সী ভাষায় ২ টি শিলালিপি মসজিদে উৎকীর্ণ করা হয়েছে। আরবী লিপিটির দৈর্ঘ্যে ১ ফুট ৮ ইঞ্চি এবং প্রস্থে ১ ফুট ১ ইঞ্চি। মধ্যবর্তী স্থানে ২ টি উসম্বিতভাবে রেখা অংকন করে মূল শিলালিপিটাকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ৩ টি ছত্রে কাব্যিক ছন্দে শিলালিপির ভাবধারাকে উপস্থাপন করা হয়েছে।

২য় শিলালিপির বংলা অনুবাদঃ

এই মসজিদটি ১৩৬৭ পবিত্র হিজরী সনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এর প্রতিষ্ঠার উপর হাজার শান্তি বর্ষিত হোক।

১ম শিলালিপির বিবরণঃ

শিলালিপি ফার্সী ভাষায় উৎকীর্ণ করা হয়েছে। লিপিটির দৈর্ঘ্যে ১ ফুট ৬ ইঞ্চি প্রস্থে ১২ ইঞ্চি।

শিলালিপি ও দেওয়ান বাড়ীর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিশ্লেষণঃ

শিলালিপির ভাষ্য অনুযায়ী শিলালিপির উৎকীর্ণ হয়েছিল ১১০৫ হিজরী সনে।ঐতিহাসিক বিশ্লেষনে জানা যায়, এই ভাগলপুর দেওয়ান বাড়ীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দেওয়ান আদম খাঁ। দেওয়ান আদম খাঁ ঈশা খাঁর ছেলে। আর আদম খাঁর ৭ম অধস্থন পুরুষ  দেওয়ান ইব্রাহিম খাঁ। ইব্রাহিম খাঁ পর্যন্ত এ বাড়িতে নবাব ঈশা খাঁর বংশধর গণ ছিলেন। দেওয়ান ইব্রাহিম খাঁর কোন ছেলে সন্তান ছিলনা।

দেওয়ান নসিবুর রেজা (বানিয়াচং) ইব্রাহিম খাঁর কন্যা আমাতুজ জোহুরাকে বিবাহ করে এ বাড়িতে বসবাস শুরু করেন এবং পরগণার শাসনাভার প্রাপ্ত হন। দেওয়ান নসিবুর রেজার ছেলে দেওয়ান আহমেদুর রেজা ওরফে পাগলা দেওয়ান। পাগলা দেওয়ানের কোন সন্তান ছিলনা। তার কন্যা আফিকুরন্নেসা বানুকে ২য় বিবাহ করেন আঃ হাশিম (লালমিয়া)। আঃ হাশিম অষ্টগ্রাম থেকে এখানে এসে বিবাহ করে এখনে বসবাস শুরু করেন এবং বিশাল ভূ-সম্পতির মালিকানা সহ পরগণের দেওয়ানী লাভ করেন।

সৈয়দ আঃ হাশিম সিপাহিসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন এর সরাসরি বংশধর। ভাগলপুর বাড়ির দুটি অংশে পশ্চিমাংশে সৈয়দ আঃ হাশিমের বংশধর গণো ব্যয় করেছেন। তার প্রথম অংশ আকিকুন্নেসার ১ম স্বামী গোলাম রহমানের বংশধরগণ বাস করেন।

সৈয়দ গোলাম রহমান সাহেব ছিলেন বাজিতপুর থানাধীন দিলালপুর সাহেববাড়ী নিবাসী। তিনি দেওয়ান বাড়িতে স্থায়ী হন। শোনা যায় সৈয়দ গোলাম রহমান সাহেবের পূর্ব পুরুষ শাহ সৈয়দ আবদুর রহমান মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি হয়ে দিলালপুরের পীর মহল্লায় বসতি স্থাপন করেন। সেখানে তার মাজার রয়েছে। মুলত তিনি ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে  এখানে আসেন। তিনি আরবের অধিবাসী ছিলেন। বর্তমানে ওই বাড়িতে কেউ থাকেনা। ভাগলপুর দেওয়ান বাড়ির ৫১ নন জমিদারি অর্থাৎ ১৫ পরগণার দেওয়ানী ছিল। ভাগলপুর রাস্তার পাশেই এই বিশাল বাড়ি রাস্তা থেকে কিছুদুর বাগান পার হলেই পূর্বেকার সুন্দর বাংলা নমুনার দালান। তারপর আরো কিছুদুর এগিয়ে গেলেই মূল বাড়িতে প্রবেশ করা যায়।

ভিতর বাড়িতেও খুব সুন্দর ফুলের বাগান সজ্জিত। সবচেয়ে উল্লেখ যোগ্য পাগলা দেওয়ান এর মাজার। তিনি বিশাল দেওয়ানী ত্যাগ পূর্বক  ১৫ বছর নিরুদ্দেশ ছিলেন। তিনি মজ্জুপ ফকির ছিলেন। তার অনেক কেরামতের কথা আজও লোকমুখে শোনা যায়। ১৪ বছর পর ১ ফাল্গুন তিনি পুনরায় ভাগলপুরে ফিরে আসেন। তখন বহু লোক তাঁকে দেখতে আসে সে প্রত্যাবর্তন কে স্মরন করে  প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের ১ ম সোমবার তার  মজারে ওরশ শরীফ পালন করা হয়। ‘চেরাগী মুটুক’ প্রকাশ্যে ইমাম বাড়ি। এ ইমাম বাড়িতে মহরমের শোকানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। দেওয়ান ইব্রাহিম খাঁ বিয়ে করেন নরপতি। নরপতির এ বিবি পিরানী বিবি নামে পরিচিত ছিলেন। তার নাম ছিল সৈয়দা এমনচাঁন বানু। পিরানী বিবি সর্বপ্রথম মহরম অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। বর্তমানে দেওয়ান বাড়ি হতে ১ মাইল পশ্চিমে প্রায় ৩ একর ২১ শতাংশ ভূমি প্রকাশ্য ইমাম বাড়ি নামে পরিচিত। তা মহরম মাসের ১০ তারিখে বিভিন্ন স্থান হতে তাজিয়া মিছিল দেওয়ান বাড়িতে এসে জড়ো হয় এবং এখান থেকে পুনরায় তাজিয়া মিছিল ইমাম বাড়িতে এসে শেষ হয়প্রায় ২৫০ বছর পূর্বে এ অনুষ্ঠান শুরু হয় এবং অদ্যবধি চলছে।

এ বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা দেওয়ান ইব্রাহিম খাঁ বাঘের সাথে লড়াই করেছে বলে প্রবাদ আছে। তার জমিদারি এলাকার মধ্যে উত্তরা, কুলিয়ারচর, নরসিংদীর অর্ধেক পর্যন্ত ছিল। দেওয়ান ইব্রাহিম খাঁর ব্যবহৃত ঢাল-তলোয়ার ,বল্লম রয়েছে।এ ঐতিহ্যবাহী বাড়ি অর্থাৎ তার পুরনো ঐতিহ্য নিয়ে শির উঁচু করে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে।

লিখেছেনঃ  মোঃ আমিনুল হক সাদী