কিশোরগঞ্জ শহরস্থ পৌরসভাধীন একটি বিরাট জনপদের নাম ‘বত্রিশ’। এ নামকরণের উৎস নিয়ে দুটি মতবাদ রয়েছে। কারও মতে স্থানীয় প্রামাণিকের জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণদাস প্রামাণিক নাবাবী আমলে কোন এক নবাবের মনোরঞ্জন করে উপহারস্বরুপ বত্রিশটি লাখেরাজ পরগনা পেয়েছিলেন। সে থেকেই স্থানটি অর্থাৎ বসবাস চিহ্নিত অঞ্চলটি ‘বত্রিশ’ নামে পরিচিত লাভ করে।

অপর মতবাদ হচ্ছে ইংরেজ আমলে জঙ্গলবাড়ী ও ভাগলপুর দেওয়ানদের জমিদারি নিলামে উঠলে মুক্তাগাছার জমিদার শশীকান্ত মহারাজ বর্তমান কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ সদর জেলাধীন বত্রিশটি পরগনার নিলাম ডেকে এর মালিক হন। সে সূত্রে তিনি উক্ত বত্রিশটি পরগনা ও তালুকের রাজস্ব  আদায় সংক্রান্ত কাজে বর্তমান বত্রিশ এলাকায় একটি রাজস্ব কার্যালয় ও ভবন নির্মাণ করে এলাকাটিকে ‘বত্রিশ’ নামাকরণ করেন।

মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্যের রাজকাচারীউল্লিখিত দুটি মতবাদের মধ্যে শেষের মতবাদটিই নানা কারনে গ্রহনযোগ্য।কারন প্রামানিক জমিদার বাড়ী বা বত্রিশ জমিদার বাড়ী বলে পুরাণো কোন রের্কড পত্রেই উল্লেখ পাওয়া যায়নি বরং প্রামানিক বাড়ীকে কাটাখালের প্রামানিক বাড়ী বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। অপর দিকে মুক্তাগাছার জমিদার বা মহারাজ বাড়ীর রাজস্ব আদায়ের কার্যালয় ও কর্মচারীদের বাসস্থান হিসেবে বর্তমান বত্রিশ এলাকায় একটি বিরাট পাকা বাড়ীসহ একটি পুকুর খনন করেছিলেন।এই বাড়িটি তদানীন্তন পাকিস্তান আমলের প্রাক্কালেও বিদ্যমান ছিল। বাড়ীটির উপরাংশে ‘শ্রী সূর্যকান্ত আচার্য মহারাজের পুত্র শ্রী শশীকান্ত আচার্য মহারাজ কর্তৃক নির্মিত এই নামে লেখা একটি নামফলক যুক্ত ছিল।

পরবর্তীকালে অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে ভবনটি নিশ্চিহ্ন হলে সে ভবনস্থলেই পুরাতন ভবন ভেঙ্গে বর্তমান এতিমখানা ভবিনটি নির্মিত হয়।কিন্ত স্থানটি সেই প্রাচীন মহারাজার স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে এখনও মুরুব্বীদের মুখে রাজার কাচারী নামে পরিচিত। সুতরাং ‘বত্রিশ’ নামাকরণের মূলে মুক্তাগাছার জমিদারদের কথাই আমরা ধরে নিতে পারি।যেহেতু বত্রিশ নিবাসী কৃষ্ণদাস প্রামানিক তখনও কোন ঢণাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে জমিদার তালুকদার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেননি তখন জমিদার বা রাজা মহারাজ খেতাব বা উপাধি হিসেবে মুক্তাগাছার জমিদার আঠারবাড়ীর জমিদার বা মহারাজগনদেরই প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল।

তবে সেই রাজ কাছারীর রাজস্ব আদায়ে মুক্তাগাছা জমিদারদের অধঃস্তন রাজস্ব আদায়কারী এবং নাটোর জমিদারদের রাজ কাছারীর নায়েব হিসেবে বত্রিশ প্রামানিকদের ভূমিকা ছিল বেশি।আর সে সূত্র ধরেই বত্রিশ প্রামানিক পরিবারের প্রধান কৃষ্ণদাস প্রামানিক পরবর্তীকালে হয়ে উঠেন এ অঞ্চলের একজন ধণাঢ্য ব্যক্তি এবং তারই বংশধর পুত্র নন্দকিশোর মতান্তরে বজ্রকিশোর এ জেলা কিশোরগঞ্জ নামকনের সাথে যুক্ত হয়ে উঠেন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব।

কিশোরগঞ্জ আমার কিশোরগঞ্জ।আমাদের কিশোরগঞ্জে আছে বহু বিষ্ময়কর দর্শনীয় বিষয়। আছে ভ্রমনের জন্য মনোরম স্থান আর হানিমুনের মত আনন্দময় উজানভাটির হাওর। হাওর হাতছানি দেয় নয়নাভিরাম জায়গা খুঁজে পেতে বাংলাদেশের ভিতরে অন্য কোথাও কিংবা বিদেশমুখী হওয়ার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করিনা। নিজ এলাকায় স্বাদেশিকতার মানসিকতার স্বাদ নিয়ে আজই বেড়িয়ে পড়ুন। ঘুরে আসুন কিশোরগঞ্জের ১৩ টি উপজেলার প্রত্যন্তর অঞ্চলসমূহ।যেখানে দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দু পা ফেলিয়া। শরৎকাল বাংলার এই ঋতুটি উৎসবের আনন্দের ও ঘর ছাড়ার। ঘর থেকে বেড়িয়ে দেখুন ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরির খেলা।শরৎ ঋতুর একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে যা আমাদের আত্নাকে স্পর্শ করে। এই স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে চলুন আমাদের অঞ্চলের সৌন্দর্যকে চোখে দেখি। বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকুই বা আমরা জানি রবীন্দ্রনাথেও ছিল এই ক্ষেদোক্তি।

এই উক্ত অনুসরন করে আমরাও যদি আজ নিজেদের প্রশ্ন করে বলি,পৃথিবীতো অনেক পরে,নিজের এই ছোট্ট বাংলাদেশ, এই বাংলাদেশের ভেতরই আছে আমাদের উজান ভাটির দেশ জেলা কিশোরগঞ্জ। এই কিশোরগঞ্জ সম্পর্কেই বা আমরা কতটুক জানি? কিশোরগঞ্জ জেলার সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পুরাকীর্তি। করিমগঞ্জের জঙ্গলবাড়ীর বীর ঈশাঁখার দুর্গ,পাকুন্দিয়া এগারসিন্দুর দুর্গ, লালমাটি, মাটির উঁচু টিলা, মাটির ঘর ইত্যাদি।

 কিশোরগঞ্জের হয়বতনগর জমিদার বাড়ি, নিকলীর প্রাচীন গুড়ই মসজিদ আর কিশোরগঞ্জ সদর থানার পাতুয়ার মধ্যযুগীয় কবি চন্দ্রাবতীর বাড়ী, ও শিব মন্দির এ জেলার ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান সমূহ পরিদর্শন করা মানে এগুলোও সাংস্কৃতিক পর্যটনের পর্যায়ভুক্ত। এমনি আরো অনেক সাংস্কৃতিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমুহ আমাদের চোখের আড়ালে পড়ে রয়েছে।এই জেলা কিশোরগঞ্জের ১৩ টি উপজেলায় যার সবগুলোর খবর বা সন্ধান আমরা অনেকেই আজ নানান ব্যস্ততার জন্য হোক বা ব্যক্তিগত ব্যস্ততার জন্যই হোক জানা অথবা দেখার সুযোগ নেই অনেকেরেই।এ বার অনেকের জানা অজানা তথ্য নিয়েই আজকের বিশেষ আয়োজন দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া। ঐতিহাসিক ভাবে বিভিন্ন স্থান পরিকল্পিত পর্যটনশিল্পের অন্তর্ভূক্ত হলে এখান থেকে যেমন আয় হবে তেমনি স্থাপনাটিও ধ্বংশের হাত থেকে রক্ষা পাবে। জেলা কিশোরগঞ্জের প্রতিটি দর্শণীয় স্থানে রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট। কোনটি পুরাতত্ত্ব, কোনোটি ঐতিহাসিক, কোনটি মসজিদ মন্দির মঠ। কোনটি প্রাচীন রাজ্য রাজধানীর ধ্বংসপ্রাপ্ত দরবারগৃহ।

কোনটি সেনানিবাস বা দূর্গ, কোনোটি নীলকুঠি, কোনটি জলটুঙ্গি, তবে সব ধরনের সৌন্দর্যই সমান ভাবে আকৃষ্ট করতে পারেনা। প্রাকৃতিক উপস্থাপনার সাথে বাস্তবের মিশেলেই কেবল একটি নান্দনিক পরিবেশ তৈরী হতে পারে। অর্থাৎ যেকোন সৌন্দর্যমন্ডিত স্থানকে শৈল্পিক ভাবে উপস্থাপন করতে হলে অবশ্যই দৃষ্টিভঙ্গি ও বুদ্ধিমত্তা সহ একটি সার্বিক পরিকল্পনা থাকা চাই। না হয় এর প্রকৃত সত্য ও সৌন্দর্য ধরা পরেনা। স্মরনাতীত কাল থেকেই জেলা কিশোগঞ্জের ভূপ্রকৃতি ও মসলিন বস্ত্র শিল্প ও সম্পদ বিশ্বের অভিযাত্রী ব্যবসায়ী ও ভূ-পর্যটকদের উৎসুক দৃষ্টি আকর্ষন করেছে। তারা অবাক হয়ে দেখেছে পুর্তগীজ ফরাসী ও ইংরেজরা , এই পৃথিবীতে এমন একটি অঞ্চল আছে যেখানে পট্ট-ধান্যে মাছে ভরা উজান ভাটির দেশ জেলা কিশোরগঞ্জ একটা বিচিত্র বসুন্ধরা।

কিশোরগঞ্জের কবি চন্দ্রাবতী তার কাব্যে বলেছেন-গোলায় গোলায় ধান আর গলায় গলায় গান ছিল এখান মানুষের লোকঐতিহ্য। লোক সাহিত্য লেখক সংস্কৃতির এমন একটি দেশ আছে যার নাম পূর্ব মৈমনসিংহ,  মৈমনসিংহ গীতিকার দেশ কিশোরগঞ্জ।উজান ভাটির হাওর বাওড় বিল ঝিল ছাড়াও সবুজ শ্যামল প্রকৃতিময় শস্যক্ষেত্র আর আছে সুখশান্তি,স মৃদ্ধির অফুরন্ত ভান্ডার। কিশোরগঞ্জের দর্শণীয় স্থানসমূহের বর্ণানা করার আগে কিশোরগঞ্জ নামে বাংলাদেশে একটি জেলা অন্যটি থানা এ নিয়ে একটু আলোকপাত করতে চাই।

বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় কিশোরগঞ্জ নামের মহকুমার সৃষ্টি হয় ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে।এ কই দিনে কিশোরগঞ্জ নামে থানা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অত্র মহকুমায় থানার সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ টি। যথা কিশোরগঞ্জ, নিকলী ও বাজিতপুর।অন্যদিকে গোটা বাংলাদেশের ইতিহাসে নীলফামারী জেলার অন্তর্গত ‘কিশোরীগঞ্জ নামে একটি থানার সৃষ্টি হয় ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ শে নভেম্বর  অর্থাৎ ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ শে নভেম্বর হল সেই অঞ্চলের স্থানীয় জমিদার ‘কিশোরী’ মোহনের নামানুসারে থানা প্রতিষ্ঠিত হয়।ব র্তমানে এটি একটি উপজেলা। কিন্তু অভিযোগ বা দুঃখের বিষয় হল ‘কিশোরীগঞ্জ নামাকরণটি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের আগ ও পরও বেশ কিছু দিন পর্যন্ত টিকে ছিল।

বর্তমানে এর অফিস আদালতে, স্কুল কলেজে কিংবা দোকানপাটের সাইন বোর্ডে লিখার প্রবনতা বেড়ে এ নামের বিকৃত নাম হয়েছে কিশোরগঞ্জ। অথচ সেই অঞ্চলে ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে কিশোরীগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়।এ বিদ্যালয়টি এখনও এই নামে আছে। কিন্তু বর্তমানে একটি কলেজের নামকরণ করা হয়েছে বর্তমানে ‘কিশোরগঞ্জ’ ডিগ্রী কলেজ নামে।গত ২৬,২৭,২৮ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল বাংলাদেশের এশিয়াটিক সোসাইটির লোক সংস্কৃতির সন্মেলন ২০০৭। এ অনুষ্ঠানে এ প্রতিবেদক ও প্রবন্ধকার এবং সংগ্রাহকও গবেষক হিসেবে যোগদান করি। সেখানে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার যারা উপস্থিত ছিল আর জেলা কিশোরগঞ্জের যারা উপস্থিত ছিলাম তাদের মধ্যে ‘কিশোরগঞ্জ’ নাম উচ্চারন হলেই একটি জেলা অন্যটি উপজেলার মধ্যে একটু অসুবিধার সৃষ্টি হতো। আমার প্রশ্ন হল প্রকৃত নাম মুছে বিকৃত নাম সরকারী ও বেসরকারীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে ঢাকা বা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এমনকি বিভিন্ন মন্ত্রনালয় থেকে লিখিত চিঠিপত্র অহরহ রদবদল হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায় ডাক বিভাগে। ফলে অনেকেই দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

আমরা প্রকৃত  কিশোরগঞ্জ নাম নিয়েই আছি। এ নামেই আমাদের পরিচয়। কিশোরগঞ্জ নামকরণ বত্রিশ প্রামানিক পরিবারের যে সদস্যের নামে নামকরণ করা হয়েছিল সেই বত্রিশ প্রামানিক বাড়িটি কেমন ছিল তার দুর্লভ ছবিটি প্রদর্শনের মাধ্যমেই অন্যান্য ফটো ফিচারগুলির বর্ণনা উপস্থাপন করা হলঃ

প্রামানিক বাড়ির প্রাচীন ছবিঃ

ধারাবাহিকঃ চলবে