কিশোরগঞ্জ শহরের উপকন্ঠ বত্রিশে প্রামানিক বাড়ীর কীর্তি বিরাট দিঘী ও প্রাচীন সৌধমালার ধ্বংসস্তুপ রয়েছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত ও বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত এসব সৌধমালার মধ্যে ‘একুশ রত্ন’ বলে খ্যাত দেউলটির স্থাপত্যশৈলী ও সৌকর্যের কথা ইতিহাসেও বিধৃত।১৮৯৯ ও ১৮৯৭ সালেরভূমিকম্পে বিধ্বস্ত এসব সৌধমালা ও এ পরিবারটি নিয়ে স্থানীয় এলাকায়  প্রচুর কাহিনী ও কিংবদন্তী জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। এখানে আমরা সে জনশ্রুতি ও কিংবদন্তীগুলো পরিহার করে যতদুর সম্ভব প্রাচীন দলিল দস্তাবেজ ও ইতিহাসের আলোকে এ কীর্তির আলোচনায় অবতীর্ণ হচ্ছি।

যতদুর জানা যায় প্রামানিক বাড়ীর প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণদাস প্রামানিকের পৈতৃক বাড়ী ছিল নান্দাইল থানাধীন বারপাড়া গ্রামে।সপ্তদশ শতাব্দীর প্রাক্কালে নরসুন্দার তীরবর্তী বর্তমান আঠারবাড়ী কাছারী এলাকায় ফরাসী বনিকদের মসলিন, শুটকী, লবন ও মাছের কুঠি ছিল। বর্তমান যেখানে রামকৃষ্ণ আশ্রম সে স্থানের আশেপাশে মুন্নী মার্কেট ও মীর খালেক এর বস্ত্রালয়ের দোকানপাট রয়েছে সে সব স্থানে। অর্থাৎ সে স্থানটি ছিল তখন নরসুন্দা নদী তীরবর্তী এলাকা। কৃষ্ণদাস সে কুঠিতে –কুঠি সরকারের চাকুরী করতেন।

পরবর্তীকালে রাজনৈতিক বিবর্তনে ফরাসীরা এদেশ ত্যাগে বাধ্য হলে কৃষ্ণদাস প্রামানিক নামমাত্র মুল্যে কুঠীটি হস্তগত করেন এবং লবন ও মসলিনের ব্যবসায় মনযোগ দেন। রামকৃষ্ণ আশ্রম সংলগ্ন ছিল ফরাসী কুঠি। বাণিজ্য লক্ষীর বদৌলতে অল্পদিনের মধ্যেই কৃষ্ণদাস প্রচুর ধন-দৌলতের অধিকারী হন এবং সেই সঙ্গে ধর্মের প্রতিও অধিক অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এ সময় তিনি স্বীয় ভবন সংলগ্ন একটি মন্দির নির্মাণ করে ‘লক্ষী নারায়ণ’ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন।ব র্তমান আঠারবাড়ী কাছারী সংলগ্ন রামকৃষ্ণ আশ্রমের মন্দিরটিই কৃষ্ণদাস নির্মিত প্রথম বিগ্রহ মন্দির। পরে কৃষ্ণদাস পরিত্যাক্ত এ মন্দিরটি কে সংস্কার করে বর্তমান শতাব্দীর প্রথম পদে রাম ‘রামকৃষ্ণ’ সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পর কৃষ্ণদাস ব্যবসা থেকে দেবসেবা, দেব আরাধনার প্রতিই বেশী ঝুঁকে পড়েন।

এ সময়েই ব্যবসাসূত্র থেকে নাটোর মহারাজের সঙ্গে প্রামাণিকের যোগসূত্র স্থাপিত হয়। এ যোগসূত্রে মহারাজ তার অধিকৃত পরগনা থেকে বর্তমান কিশোরগঞ্জ এলাকার বেশ কয়েকটি তালুক দেবাগত প্রান কৃষ্ণদাস প্রামাণিকের নামে দেব সেবার জন্য লাখেরাজ দেন। এ থেকে একদিকে ব্যবসা ও অন্যদিকে তালুকের আয়ে কৃষ্ণদাসের ধনভাবডার দিন দিনই বাড়তে থাকে এবং এ সময়ে তিনি আরো কয়েকটি নতুন তালুক ক্রয় করেন।

এমনি করে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথ এগিয়ে শেষ বয়সে ধর্মপ্রান কৃষ্ণদাস ইচ্ছে প্রকাশ করলেন যে, প্রতিষ্ঠিত দেবতার জন্য একটি দেবপুরী নির্মাণ করে দেবতাদের পাদপাদ্মে তার সমস্ত ভৈবব বিলিয়ে দেবেন। কিন্তু ইতিমধ্যে অন্তিমকাল উপস্থিত হওয়ায় কৃষ্ণদাস তার অন্তিম ইচ্ছাটি পূরনের জন্য ৬ষ্ঠ পুত্র ধর্মপ্রান নন্দকিশোর প্রামাণিককে ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে একটি লিখিত দলিলের মাধ্যমে দায়িত্ব দিয়ে যান।পু রোনো বাংলা লিখন পদ্ধতিতে লিখিত সেই মূল দলিলের নকলটি এখানে উদ্ধৃত করা হল-

“শ্রীনন্দ কুমার দাস সুচরিতেষু লিখনং কার্যাঞ্চগে তুমি মদ লক্ষী নারায়নের সেবার কার্যেতে ব্রত আছে। অতএব লোকদেবালয় নির্মাণ করার কারন আমার তালুক গলগলিয়া কাটাখালী দেবোত্তর করিয়া দেওয়া গেলো গ্রাম মজা পুকুরের মধ্যস্থল একতপুরী করিবে যাহাতে সর্বদা বাসস্থান ও গ্রীষ্মকালে জলটঙ্গী বসন্তকালের পুষ্পবাস, বাঁশুলী, দুলমঞ্চ আদি দূর্গাপূজার স্থান,চতুর্দশ কালীপূজার স্থান, মঙ্গলচঁন্ডীর পূজার স্থান, কার্তিক বিষহরি প্রভৃতি কৌলিক নানা দেবতার স্থান ও শিবালয় করিয়া তাহাতে শিব স্থাপন করিয়া সর্বশ্রেষ্ঠ সতের রত্নে স্থাপিত করিয়া তুমি ও তোমার পুত্র-পোত্রাদি পুরুষানুক্রমিক সেবা করিতে রহ তালুক মজা পুকুরের রাজস্ব সিমলিয়া নখয়াটি সামিল আমি আদায় করিব। তোমার স্থানে কখন তলব হইবেনা।পুরী যে পর্যন্ত প্রস্তুত না হয় ততদিন পর্যন্ত দর্মা খরচ ৭৫০ টাকা আমার সরকারে পাইবা।

শ্রীকৃষ্ণদাস
ইতি সন- ১১৬৫ বাঙ্গালা,
তারিখ ১১ ফাল্গুন।

দলিলের মর্মনুযায়ী নন্দকিশোর পিতার অন্তিম এচ্ছা পুরণের জন্য মজাপুকুর বা মজাপুকুর গ্রামে(বর্তমান বত্রিশ) প্রায় তিনদ্রোন জমি নিয়ে পুকুর ও পুরী নির্মাণ শুরু করলেন। এ তথ্য পাঠে জানা যায়, বত্রিশ এলাকার প্রাচীন নামকরণ ছিল মজাপুকুর গ্রাম। এ সময়ে ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে দেখা দিলো ‘ছিয়াত্তোরের মন্বন্তর’। এ মন্বন্তর বা আকালে নন্দকুমার খাদ্য ও বস্ত্রের বিনিময়ে অনাহারক্লিষ্ট হাজার হাজার নরনারীকে পুরী ও পুকুর কাটার জন্য নিয়োজিত করলেন।মন্বন্তর চলাকালীন সারা বছর লক্ষ লক্ষ লোকের শ্রমে অবশেষে ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হলো কৃষ্ণদাসের স্বপ্নের পুরী-দোলমঞ্চ, গোলদলান শিবমন্দির, রাসমন্ডপ, অতিথিশালা, শিবালয় ও একুশরত্ন।

বাড়ীর পূর্বাংশে এক দ্রোণ জমির উপর কাটানো হল বিরাট পুকুর এবং পুকুরের মধ্যস্থলে নির্মিত হল ত্রিতল গ্রীষ্মবাস’ জলটঙ্গী’  টঙ্গীর সঙ্গে শুন্যে রাস্তা তৈরী করে একুশ রত্নের সাথে যোগ করা হল। পিতা কৃষ্ণদাসের ইচ্ছা ছিল সতের রত্ন তৈরীর।কি ন্তু নন্দকিশোর আরো অধিক একুশ রত্ন তৈরী করালেন। পুরীটি তৈরী হওয়ার পর তিনি এটি লক্ষী নারায়নের নামে উৎসর্গ করেছিলেন।এই উৎসর্গ ও নব নির্মিত পুরীতে বিগ্রহ উপস্থাপন উপলক্ষ্যে নন্দকিশোর একটি বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন।সাতদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত এই উৎসবটি উপলক্ষ্যে পুরীর আঙ্গিনায় বিভিন্ন পণ্যের মেলাও বশে ছিলো।

সে মেলাটিই পরবর্তীকালে ঝুলন মেলা নামে প্রতি বছর ঝুলনের সময় বসতো একনাগারে তিনমাস কাল স্থায়ী হতো। তিন মাস স্থায়ী এ মেলাটি পণ্য সম্ভারে ক্রয় বিক্রয়ে প্রসিদ্ধ অর্জন করেছিল যে দেশ বিদেশের অনেক সওদাগর এতে যোগ দিতেন। এ মেলা উপলক্ষ্যে আগত মনিপুর রাজ্যের সওদাগরেরা প্রামাণিক বাড়ীর পূর্বপাশে কাটাখালের যে ঘাটে তাদের পণ্যযান গুলো রাখত- সে স্থান টি আজও “মনিপুরী ঘাট” নামেই পরিচিত হয়ে আসছে।ম নিপুর ঘাটএ লাকায় এক কালে মনিপুর নামে উপজাতিদের বাসস্থান ছিল। সে কারনেও ভারতের মনিপুর রাজ্যের উপজাতি সওদাগরেরা এখানে মেলা উপলক্ষ্যে পণ্যযান নিয়ে ছুটে আসতেন এই কিশোরগঞ্জ মনিপুর নামক নরসুন্দার নদীঘাটে। এখানে বর্তমান কালে একটি ব্রিজ নির্মিত হয়েছে।

১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে নাটোর মহারাজের জমিদারি নিলাম হয়ে গেলে কৃষ্ণদাসের প্রাপ্ত লাখেরাজ হিসেবে প্রাপ্ত তালুকগুলো খাজা আরতুন নামে জনৈক আর্মেনিয়ান বনিক ক্রয় করেন।এতে আরতুনের সঙ্গে প্রামাণিকদের মোকদ্দমা সুরু হয়।সে মোকদ্দমা দীর্ঘ বছর চলতে থাকে। অবশেষে প্রামাণিক পরিবার নাটোর মহারাজ রামকৃষ্ণ রায়ের স্বাক্ষরযুক্ত দানপত্রটি দেখিয়ে মোকদ্দমায় জয়লাভ করেন।