বাংলার শাসনকর্তা সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের নামে এ হোসেনপুর পরগনাটি পরিচিত। ব্রহ্মপুত্রের নদের যে তীরে তিনি অবস্থান করেছিলেন তা আজো হোসেনপুর বলে ৪৫৬৮৮ টাকা আট আনা নির্ধারিত হয়। অতঃপর ১৯৯৭ খ্রিঃ পরগনাটি সহ অপরাপর বাইশটি পরগনা সম্রাট আকবর ঈঁশা খাঁকে প্রদান করেন।তার মৃত্যুর ১০০ বছরের মধ্যে এটি তার আমলা বেত্রটির দেওয়ানদের হস্তগত হয়।সুবেদার মুর্শেদকুলি খাঁর সময় তা ঢাকা নেয়াবৎ এ ইৎনাম দায়ী হুজুরী সেরেস্তার অন্তর্গত জমিদার ভবানী প্রসাদের অধীনে ছিল।উল্লেখ্য,এর মধ্যবর্তী সময়ে এটি সরকার বাজুহার অন্তর্গত রাজস্ব বিভাগ হিসেবে রাজশাহীর অন্তর্গত ছিল।অষ্টাদশ শতাব্দীতে নাটোর রাজবংশের প্রাধান্যের সময় এটি নাটোরের শাসনাধীনে আসে।১৭৯৩ খ্রিঃ মহারাজ রামকৃষ্ণ এর জমিদারী খাজনার দায়ে নিলামে উঠে।এ পরগন্টী খাজা আরাতুন নামক একজন আর্মেনীয় ক্রয় করেন।একই বছর এটি রাজশাহী থেকে ময়মনসিংহ কালেক্টরের অধীনে আসে।১৮২২ খ্রিঃ আরাকানের দুই কন্যা বিবি কেথারিনা, বিবি এজিনা এবং তার দুই আত্মীয় ওয়াইজ স্টিফেন্স এবং কেসপার্জ প্রত্যেকে চাবি আনা অংশে এই পরগনার জমিদারী লাভ করেন।১৮৫৩ খ্রিঃ আআথারবাড়ির শম্ভুচন্দ্র রায় বিবি এজিনার অংশ (মতান্তরে অরফে হোমস এর অংশ)মোহিনী মোহন রায় বিবি কেথারিনার অংশ ওয়াইজ সাহেব এ দেশ ত্যাগ করে যাবার সময় তার জমিদার হোসেন শাহের চার আনা মুক্তাগাছার জমিদার রাম কিশোর আচার্য চৌধুরী এবং অবশিষ্ট অংশ গাংগাটিয়ার দীণনাথ চক্রবর্তী,মসুয়ার হরি কিশোর রায়,সরারচরের জয় গোবিন্দ রায় ও টি টি কেলা নোজ এর নিকট বিক্রয় করেন।

মুক্তাগাছার রাম কিশোরের অংশ তার পুত্রের আমলে নিলাম করলে আঠার বাড়ির মনিম চন্দ্র রায় এই অংশ খরিদ করেন।অন্যান্য শরীকগন ক্রমশঃ আঠারবাড়ীর জমিদারের নিকট তাদের অংশ বিক্রয় করেন। ফলে বিগত সতাব্দীর প্রথম দিকে ১৯০৪ খ্রিঃ আঠারবাড়ির জমিদার জ্ঞানদা সুন্দরী চৌধুরানীর স্বামী উত্তরাধিকার ও ক্রয়সুত্রে এ পরগনার চৌদ্দ আনার মালিক ও পাওনাদার ছিলেন।অবশিষ্ট দুই আনা গাংগাটিয়ার অতুলচন্দ্র চক্রবর্তী ও অন্যান্য ক্ষুদ্র অংশীদারের ছিল। এই অন্যান্য ক্ষুদ্র অংশীদারের মধ্যে ছিলেন বত্রিশের কৃষ্ণদাস প্রামানিক।এ ক্ষুদ্র অংশের মালিকানা নিয়েই মুলত মোকদ্দমা ছিল।

হোসেন শাহীর পরগনাটি নীল চাষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল।এর অনেক গ্রাম চিরস্থায়ী মধ্যস্বত্ত্বে মেসার্স ওয়াইজ কার্নেগী, ও কালানৌজ প্রমূখ নীলকরদের পত্তন দেয়া হয়।এক সময় নীলকর ওয়াইজের নামে ময়মনসিংহ জেলার আবাল বৃদ্ধ বনিতা ভীত সন্ত্রস্ত ছিল।

পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ বিধৌত হোসেনপুর উপজেলাটি নদের বিস্তীর্ণ পূর্ব তীর দিয়ে অবস্থান করছে।নদের আমেজ আজ আর নেই,নরসুন্দা নদীও মৃত প্রায়। নদীর গতি পরিবর্তন শুধু ব্রহ্মপুত্র নদ কিংবা শাখা নরসুন্দা নয় বরং কিশোরগঞ্জ ও হোসেনপুর কে করেছে ম্রিয়মান।এই মোকদ্দমায় বত্রিশের প্রামানিক কৃষ্ণদাস জয়লাভ করেছিলেন।কিন্তু প্রামাণিক পরিবারের এই জয়জয়কার তিন পুরুষের বেশী টিকেনি। তিন পুরুষের মধ্যেই পরিবারটিতে আত্নম্ভরিতা ও বিলাস-ব্যসন ঢুকে পড়ে।যার ফলে একে একে কয়েকটি তালুক বন্ধক পড়তে থাকে।এ থেকে নিজেদের মধ্যে শুরু হয় আত্মকলহ।এমনি অবস্থায় এ পরিবারের একজন অংশীদার তার চারিআনাঅনশ নিয়ে বর্তমান রথখোলায় চলে আসেন এবং বসতি স্থাপন পূর্বক রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা ও বিগ্রহের নামে তার অংশ উৎসর্গ করেন।সেটিই বর্তমানে রথখোলা পৌনেচারিয়ানার বাড়ী নামে পরিচিত।দেবোত্তর সে বাড়িটি আজো জমজমাট।আর সে বাড়ির রথযাত্রা ও রাসমেলা এবং ঝুলনমেলা আজো বিখ্যাত।এ দুটি পার্বণী মেলাতেই স্থানীয় পণ্যের বিপুল স্মাবেশ ঘটে।অপরদিকে ১৮৯২ খ্রিঃ ভূমিকম্পে একুশ রত্নের চূড়াগুলো ভেঙ্গে পড়ে ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে একুশ রত্ন সহ সমস্ত সৌধমালাই ধ্বংশ হয়ে পড়ে।কিন্তু ভগ্ন জলটুঙ্গি,ছনের দোচালা প্যাটার্ণের তৈরী ৬ টি শিবালয় ও অতিঠিশালা কালের ভ্রুকটি অগ্রাহ্য করে বিগত পাকিস্তান আমলেও বিদ্যমান ছিল।পাকিস্তান আমলেই সরকার এ বাড়িটি “একোয়ার” করে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন করার জন্য অতিথিশালা সহ ধ্বংসস্তুপটি অপসারন করেন।তবে এক দ্রোন জমি নিওয়ে কাটানো বিরাট পুকুর ও পুকুরের উপর ভগ্ন জলটঙ্গি টি আজো বিদ্যমান থেকে প্রামাণিকের অতীত কীর্তির কথা ঘোষনা করছে।

এখানে এলাকার নাম প্রসঙ্গে আলোকপাত করা প্রয়োজন।বর্তমান এলাকাটি প্রামাণিকদের তিন পুরুষ পর্যন্ত কাটাখাল বা কাঠখাল নামেই পরিচিত ছিল।পরবর্তী কালে মুক্তাগাছার জমিদার এখানে বত্রিশটি তালুক ক্রয় করেন এবং উক্ত তালুকগুলোর রাজস্ব আদায় করার জন্য প্রামাণিক বাড়ীর পাশেই একটি ডিহি নির্মাণ করেন।যখানে আজ এতিম খানা সেখানে ছিল এই ডিহি বা কাছারী। সে থেকেই মুক্তাগাছার জমিদার এই এলাকাটিকে বিত্রিশ নামে চিহ্নিত করেন। বর্তমানে দুঃস্থ ও এতিম নিবাস এলাকাটি ‘রাজার কাছারী’ নামে পরিচিত এবং এখানেই ছিল মুক্তাগাছার জমদারের বত্রিশটি তালুকের রাজস্ব আদায়ের ডিহি।