১৯৩৫ সালে কিশোরগঞ্জ মহকুমার তৎকালীন সেকেন্ড অফিসার জনাব কিউ.এম রহমান প্রতিষ্ঠা করেন। এটি প্রতিষ্ঠার অন্যতম কারণ ছিল ওই সময়কার পশ্চাৎপদ মুসলিম সমপ্রদায়কে শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আলোকিত করা। বর্তমান জেলা পাবলিব লাইব্রেরির ত্রিতল ভবনের নিচতলা ভবনে M.I লেখা ভেন্টিলেটর এবং লাইব্রেরির পূবদিকের মূল গেইটের উপরে MUSLIM INSTITUTE লেখা এখনও এর অস্তিত্ব বহন করে চলেছে। তবে লাইব্রেরিতে এর প্রতিষ্ঠার কোনো তারিখ বা কার্যবিবরণী পাওয়া যায়নি।

মুসলিম ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি রূপে আত্মপ্রকাশ করে বিগত ২৫ জানুয়ারি ১৯৫৯ সালে। কিশোরগঞ্জের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক জনাব এ.কে. চৌধুরী আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করেন। বর্তমানে পাবলিক লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত কার্যবিবরণী থেকে জানা যায় বিগত ১৯ ডিসেম্বর ১৯৫৮ সালে স্থানীয় রঙমহল সিনেমা হলে মুসলিম ইনস্টিটিউট এর এক সাধারণ সভায় মহকুমা পাবলিক লাইব্রেরি নামকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন মহকুমা প্রশাসক জনাব এ.কে. চৌধুরী। সভায় মহকুমা প্রশাসককে সভাপতি এবং স্থানীয় আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. সাইদুর রহমানকে সম্পাদক করে ১৭ সদস্যের প্রথম কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়।

আগেই বলা হয়েছে মুসলিম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের আলোকিত করা। ওই সময় হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ইংরেজরা প্রায় দু’শ বছর এদের শাসন ও শোষণ করে। এ সময় মুসলিম সমপ্রদায় শিক্ষা দীক্ষায় পিছিয়ে পড়েছিল। পশ্চাৎপদ ওইসব মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলতে মুসলিম ইনস্টিটিউট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।

১৯৬২ সালে কিশোরগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক ছিলেন জনাব এম.এ. সাইদ (যিনি পরবর্তীতে সিইসি হয়েছিলেন)। একজন শিক্ষানুরাগী ও সমাজহিতৈষী হিসাবে যিনি যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। তার আন্তরিক উৎসাহ ও আগ্রহে মহকুমা পাবলিক লাইব্রেরির দ্বিতল ভবন নির্মাণ হয়। এ সময় এর সম্পাদক ছিলেন আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনাব মো. মতিউর রহমান। সম্পাদক হিসেবে তিনিও একজন সফল ব্যক্তি। তার আন্তরিকতা ও নিরলস প্রচেষ্টায় পাবলিক লাইব্রেরি এতদ অঞ্চলে একটি জ্ঞান ভাণ্ডার ও দর্শনীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। তারপর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন এডভোকেট নাসির উদদীন ফারুকী। তিনি প্রায় ১২ বছর এ দায়িত্বে ছিলেন। গত ২০০৩ সালে সম্পাদকের দায়িত্ব লাভ করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক জনাব মু.আ. লতিফ। তিনি অদ্যাবধি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে যাচ্ছেন।

কিশোরগঞ্জ জেলা পাবলিক লাইব্রেরির নথিপত্র দৃষ্টে জানা গেছে এ প্রতিষ্ঠানটি নানা কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারসহ আলোকোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে চলেছে। ১৯৬৩ সাল থেকে বেশ ক’বছর এ লাইব্রেরি থেকে পাঠাভ্যাস সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ভ্রাম্যমান লাইব্রেরি পরিচালনা করা হয়। এছাড়াও লাইব্রেরির মাধ্যমে ‘ইকবাল-নজরুল সোসাইটি’র কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ লাইব্রেরির উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে সাহিত্য সাময়িকী ‘সৃষ্টি’র আত্মপ্রকাশ এবং ‘কিশোরগঞ্জ জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থ প্রকাশ। এছাড়াও পাবলিক লাইব্রেরিতে সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষা তহবিল এবং এখান থেকে পরিচালিত হয়েছে জেলা বাস্তবায়ন কমিটির সংগ্রাম।

আমাদের গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন এ লাইব্রেরি থেকে খোয়া যায় বহু মূল্যবান গ্রন্থ ও সামগ্রী। বর্তমানে লাইব্রেরিতে সংগৃহীত রয়েছে প্রায় চৌদ্দ হাজার মূল্যবান ও দুষপ্রাপ্য গ্রন্থরাজি। ইতোমধ্যে লাইব্রেরি বহুভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে। বর্তমান সম্পাদকের একান্ত আগ্রহ ও প্রচেষ্টায় এর অবকাঠামো ও উন্নয়ন যথেষ্ট বেড়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে সুদৃশ্য ত্রিতল ভবন। ইতোমধ্যে প্রসারিত হয়েছে ‘কিশোরগঞ্জ গ্যালারি’ যেখানে জেলার লেখক ও প্রকাশকদের গ্রন্থরাজিতে ভরে উঠেছে। পাবলিক লাইব্রেরিতে স্থাপিত হয়েছে আইটি কর্নার। আধুনিক প্রযুক্তি সহজলভ্য ও সাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে এটি স্থাপন করা হয়েছে। কিশোরগঞ্জের ভূতপূর্ব জেলা প্রশাসক জনাব এ.এস.এম মাহবুবুল আলমের একান্ত আগ্রহ ও বদান্যতায় এ প্রকল্পটি চালু করা সম্ভব হয়েছে। কিশোরগঞ্জ জেলা পাবলিক লাইব্রেরি জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠান। এর পেছনে বহুজনের সাধনা শ্রম ও সাহায্য রয়েছে। এখানে বহু মূল্যবান ও গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রয়েছে। স্থানীয় হয়বতনগর দেওয়ানবাড়ির মরহুম আলীম দাদ খানের লাইব্রেরির ধ্বংসাবশেষ এই লাইব্রেরিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। পাবলিক লাইব্রেরির ত্রিতলে রয়েছে একটি মিনি মিউজিয়াম। মিউজিয়ামে সংগৃহীত আছে বহু পুরনো গদা, রামদা ও তরবারি- যা ইশা খাঁ’র আমলের বলে ধারণা করা হয়। মিউজিয়ামে রয়েছে হাতে লেখা পবিত্র কোরআন শরীফ, মহাভরত। এছাড়াও রয়েছে এগারসিন্দুর থেকে প্রাপ্ত শিলালিপি, পাথরখণ্ড প্রভৃতি।

এই পাবলিক লাইব্রেরি পরিদর্শন করেছেন দেশের বহু খ্যতিমান ব্যক্তিবর্গ। বহুভাষাবিদ ও জ্ঞানতাপস ড. মহম্মদ শহীদুল্লাহ এটি পরিদর্শনে এসে লাইব্রেরিটিকে ‘কিশোরগঞ্জের গৌরব’ বলে মন্তব্য করেছেন। পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীন গ্রন্থাগারটিকে ‘এ দেশের বড় সম্পদ, জাতীয় সম্পদ’ বলে মন্তব্য করেছেন।

জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে সভাপতি হিসাবে ও তাকে নিয়ে মোট ১৫ সদস্যের একটি কমিটি তিন বছর অন্তর অন্তর নির্বাচনের মাধ্যমে এটি পরিচালনা করে থাকেন। বর্তমান কমিটির নেতৃত্বে লাইব্রেরিটি উত্তরোত্তর উন্নতি ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

– পোষ্টটি সংগ্রহিত, স্বত্ব পাওয়া যায়নি